Saturday, January 9, 2021

Post # 1015 Bengali Amarchitra Katha 135

                                                                       ডাউনলোড করুন

 

 

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস পড়তে পড়তে প্রশ্ন জাগে, একি শুধুই কল্পনা, নাকি বাস্তবের চরিত্রকেই দেওয়া হয়েছে দস্যুরানির রূপ? বাংলাদেশে তো বটেই, এই রাজ্যেরও তিন প্রান্তে অন্তত তিনটি দেবী চৌধুরানী মন্দিরের সন্ধান মেলে। তবে কি চরিত্র নিছকই কাল্পনিক নয়?

 

দেবী চৌধুরানী! নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুচিত্রা সেনের মুখ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসটির সম্মোহন ক্ষমতা টলেনি এই জেট-যুগেও। বঙ্কিম স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, এটি মোটেও ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। তবু ভবানীপাঠক, ডাকাত দল, সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে স্বামী পরিত্যক্তা এক তথাকথিত সাধারণ মেয়ের অসাধারণ হয়ে ওঠার এই কাহিনি পড়তে পড়তে মনে প্রশ্ন জাগে, কত আনা বাস্তব আর কত আনা কল্পনার মিশেলে সাহিত্যসম্রাট বুনেছিলেন প্রফুল্লের চরিত্র? খোঁজ-খবর নিতে গেলে হাবুডুবু খেতে হয় তথ্য-সমুদ্রে। কিন্তু তাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ সংরক্ষিত হয়নি বাংলার মহিলা রবিনহুডের ইতিহাস।

বাংলাদেশে তো বটেই, এই রাজ্যেরও তিন প্রান্তে অন্তত তিনটি দেবী চৌধুরানী মন্দিরের সন্ধান মেলে। দুর্গাপুর, ডায়মন্ড হারবার এবং জলপাইগুড়ি। তবে তিন জায়গার মধ্যে সবচেয়ে জোরালো দাবি কিন্তু জলপাইগুড়ির জেলার। বঙ্কিম যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রফুল্ল নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে যেখানে অগাধ গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছিল, অর্থাৎ মৃত্যুপথযাত্রী কৃষ্ণগোবিন্দ দাস যে অট্টালিকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তা উত্তরবঙ্গে। কারণ উপন্যাসে উল্লেখ রয়েছে যে, এই অট্টালিকাটি উত্তরবঙ্গের নীলধ্বজবংশীয় শেষ রাজা নীলাম্বর দেবের। উপন্যাসেই প্রমাণ মেলে, অবিভক্ত বাংলার উত্তরাংশের ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন দেবী চৌধুরানী। তাই দক্ষিণবঙ্গ বা রাঢ়বঙ্গ নয়, আজকের কথা শুধু জলপাইগুড়ি নিয়েই।

দেবী চৌধুরানী বা ভবানী পাঠকের নামে একাধিক মন্দির আছে এই জেলায়। জলপাইগুড়ি শহরের গোশালা মোড়ে রয়েছে দেবী চৌধুরানী কালী মন্দির। সন্ন্যাসীকাটা মার্কেটের কাছে শিকারপুর চা-বাগানে রয়েছে ভবানী পাঠকের মন্দির। বেলাকোবা-রাধামালি রোডে রয়েছে মন্থনী মন্দির।

উপন্যাসের দস্যুরানির বিচরণ ক্ষেত্র ছিল রংপুর। বাংলাদেশের এই রংপুরের সঙ্গে জলপাইগুড়ির কী সম্পর্ক? পুরনো নথি ঘাটলে চোখে পড়ে, অবিভক্ত বাংলায় জলপাইগুড়ি জেলা গঠনের আগে মূলত তিস্তার পশ্চিম পাড়ের অংশের নাম ছিল বৈকুণ্ঠপুর। ভবানী পাঠকের মন্দির রয়েছে যে শিকারপুরে, তা-ও কিন্তু এখনকার বৈকুণ্ঠপুরের মধ্যেই পড়ে। যাই হোক, সেই আমলে ইংরেজদের করদ রাজ্য হিসেবে বৈকুণ্ঠপুর ছিল রংপুর কালেক্টরেটের অন্তর্গত। ১৮৮২ সালে ডেপুটি ম্যাজস্ট্রেট হিসেবে এই অঞ্চলে এসেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাসটি।

উপন্যাসে বারবার ত্রিস্রোতা নদীর কথা বলেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। এই ত্রিস্রোতা নদীতেই বজরা ভাসাতেন দেবী চৌধুরানী। সেই ত্রিস্রোতাই আজকের তিস্তা বলে মনে করা হয়। আবার ভ্রামরী দেবীর মন্দির রয়েছে জলপাইগুড়ির ত্রিস্রোতা নামক স্থানে। তিনটি নদীর সঙ্গমস্থলে মন্দিরটি অবস্থিত বলে এহেন স্থাননাম। তাহলে কি ত্রিস্রোতার অস্তিত্ব এখানেই ছিল?

আদতে কে ছিলেন বাংলার একান্ত নিজস্ব রহস্যময়ী এই ‘ব্যান্ডিট কুইন’?


সালঙ্কারা দস্যুরানি বজরায় বসে কোনও অপার পূর্ণিমা রাতে বীণা হাতে রহস্যের ছায়া বিস্তার করেন যেন আজও। উত্তর খুঁজতে খুঁজতে ডুবে যেতে হয় আরও ধাঁধায়। কারণ পুরোনো নথি বলছে, সেই সময় রংপুরে মোট ১২ জন দেবী চৌধুরানী ছিলেন। বহু জমিদার-পত্নীর পরিচয় সেখানে নথিভুক্ত করা হয়েছে ‘দেবী চৌধুরানী’ নামে। তাহলে এঁদের মধ্যে সেই বীরাঙ্গনা কে, যাঁর বিশাল পাইক-বরকন্দাজের কথা বঙ্কিম উল্লেখ করেছেন? যিনি এক হাতে লুঠতরাজ চালিয়ে অন্য হাতে বিলিয়ে দিয়েছেন গরিব প্রজাদের মধ্যে?

এই জট ছাড়াতে সাহায্য নিতে হয় এক চারণকবির। রংপুর সাহিত্য পরিষদের পাক্ষিক পত্রিকার সম্পাদক পঞ্চানন সরকার গোটা জেলা ঘুরে জাগ গান সংকলন করেছিলেন। তারই একটিতে বর্ণনা পাওয়া যায় এমন এক জমিদার-পত্নীর, যাঁর তেজ-সাহসিকতার তুলনা করা যায় দেবী চৌধুরানীর সঙ্গে। চারণকবি রতিরাম দাসের সেই লেখায় পাওয়া যায়, ‘মন্থনার কর্ত্তী জয় দুর্গা চৌধুরাণী\বড় বুদ্ধি বড় তেজ সকলে বাখানি।’ এই রচনায় কুখ্যাত দেবী সিংহের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বড় ভূমিকা নিতে দেখা যায় জয়দুর্গাকে। ছিয়াত্তরে মন্বন্তরের প্রসঙ্গ তুলে রতিরাম লিখেছেন, ‘আকালে দুনিয়া গেল দেবী চায় টাকা\মারি ধরি লুট করে বদমাইশ পাকা।’ যখন কুখ্যাত দেবী সিংহের অত্যাচারে রতিরামের ভাষায় ‘প্রজা ভাজা ভাজা’, তখন রাজারায়ের পুত্র শিবচন্দ্র রায় তাঁর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন। ইটাকুমারীতে ছিল তাঁর রাজত্ব অর্থাৎ জমিদারি। এহেন শিবচন্দ্রকে মন্ত্রণা দিতেন জয়দুর্গা। রতিরামের কথায়, ‘শিবচন্দের কাজকর্ম তার বুদ্ধি নিয়া\তার বুদ্ধির পতিষ্ঠা করে সক্কল দুনিয়া’। তার অর্থে জয়দুর্গা।

অত্যাচারী দেবী সিংহকে পরাস্ত করতে ‘সব জমিদার আইসে শিবচন্দ্রের ঘরে\পীরগাছার কর্ত্তী আইল জয়দুর্গা দেবী।’

মন্থনা তথা পীরগাছা হল বাংলাদেশের উপজেলা। পীরগাছার কর্ত্রী জয়দুর্গা সেই যুগে দেবী সিংহ দমনে অন্যতম পরামর্শদাতা, বলছে চারণকবির গান।

উপন্যাসেও রয়েছে দেবী সিংহের অত্যাচারের কথা। যে দশ বছর প্রফুল্ল প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন ‘দেবী চৌধুরানী’ হয়ে ওঠার, বঙ্কিম লিখেছেন, সেই দশ বছর ভালো কাটেনি প্রফুল্লর শ্বশুরমশাই হরবল্লভেরও। কারণটা ইজারাদার দেবী সিং। তাঁর কাছে ৫০ হাজার টাকা দেনা হয়ে যায় হরবল্লভের।

পুরোনো নথি বলছে, এই জয়দুর্গার নেতৃত্বে দেবী সিংহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন প্রজারা। মনে করা হয়, এই জয়দুর্গার আদলেই উপন্যাসের নায়িকাকে গড়ে তুলেছিলেন বঙ্কিম। স্বামী নরেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর নিঃসন্তান জয়দুর্গা ১৭৬৫-১৮০১ পর্যন্ত মন্থনা এস্টেটের দায়িত্ব সামলেছিলেন একা হাতে। সেই সময় ওয়ারেন হেস্টিংসের নির্দেশে বৈকুণ্ঠপুর অঞ্চলের কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের জন্য অমানবিক অত্যাচার শুরু করে দেবী সিং। তাঁর হাত থেকে দরিদ্র প্রজাদের বাঁচাতে বড় ভূমিকা নেন জয়দুর্গা। তিনি হয়ে ওঠেন রক্ষাকর্ত্রী।

লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের রিপোর্ট, ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্টস অফ বেঙ্গল-রংপুর (১৮৭৬) ঘাঁটলেও জানা যায় যে, ওই সময় কৃষক বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। ইটাকুমারীর শিবচন্দ্র এবং ভবানী পাঠকের একাধিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিলেন জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী। তিন জনেই ছিলেন বিদ্রোহের নেতৃত্বে।

ইজি গ্লেজিয়ারের ‘এ রিপোর্ট অন দ্য ডিসট্রিক্ট রংপুর (১৮৭৬)’য়ে পাওয়া তথ্য বলছে, রংপুরের তিস্তা অববাহিকা এবং জলপাইগুড়ির করলা অববাহিকা জুড়ে ছিল দেবী জয়দুর্গা চৌধুরানীর কাজের পরিধি। এই সব অঞ্চলেই ভবানী ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন তিনি। কখনও দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন ধনরাশি।
গোশালা মোড়ের কালী মন্দিরে দেবী চৌধুরানী পুজো দিতে আসতেন বলে কথিত। শিকারপুরের প্যাগোডা আকৃতির ভবানী পাঠকের মন্দিরটির সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে দেবী চৌধুরানীর নাম। তবে ২০১৮ সালে সেটি আগুনে পুড়ে যায়। রাজগঞ্জ থানার মন্থনী মন্দিরও দেবীর স্মৃতিবিজড়িত। মন্থনী গ্রামের নামটিও এসেছে জয়দুর্গার মন্থনা এস্টেটের নামের থেকে। মন্থনী দেবীও পূজিত হন এই গ্রামে।

যাঁকে ঘিরে এত মিথ, এত জনশ্রুতি, এত গল্প তিনি কি স্রেফ একজন দস্যুরানি নাকি কৃষক অভ্যুত্থানের নেত্রী? সাহেবদের গুরুগম্ভীর নথি, তাঁকে ডাকাতরানি বানিয়েছে, আর সাহিত্যসম্রাট তাঁকে অমর করেছেন সোনার কলমে!




 

6 comments: