ডাউনলোড করুন
ভগবান বুদ্ধ এবং অঙ্গুরিমালের ইতিহাস
বুদ্ধ সমকালীন কোশল জনপদের রাজধানী ছিল
শ্রাবস্তী। ঐ কোশল জনপদের রাজা ছিলেন কোশলরাজ প্রসেনজিৎ। তাঁর রাজপুরোহিতের
নামি ছিল ব্রাহ্মণ ভার্গব। চৌর-নক্ষত্রে তাঁদের প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়।
তাঁর জন্মের সময় রাজার অস্ত্রাগারে হঠাৎ অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটে, ব্রাহ্মণ
ভার্গব ছিলেন শাস্ত্রে পারদর্শী অশুভ নক্ষত্রে ছেলের জন্ম হওয়াতে তিনি গননা
করে জানতে পারলেন তাঁর ছেলে বড় হলে মানুষ হত্যা করবে। এবং রাজ্যে এক ভয়ানক
পরিস্থিতিরর সৃষ্টি করবে। রাজ্যের মঙ্গল কামনায় ভার্গব ছেলেকে হত্যা করতে
চাইলে, কোশলরাজ প্রসেনজিৎতের হস্তক্ষেপে নবজাতক শিশুর জীবন রক্ষা পায়। এবং
কোশলরাজ ভার্গবকে বললেন, অমঙ্গল আসলে কেউ ঠেকাতে পারবে না, এতে এই নবজাকের
কি দোষ। বিপদ যখনি আসবে তখনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাকে উপযুক্ত বিদ্যা
শিক্ষা দিয়ে বড় করা হোক।
সম্ভাব্য দোষমুক্তি অবলম্বন করে তারা
সন্তানের নাম করণ করেন ” অহিংসক “। এ নামকরণের পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল এ
শুভ নামের প্রভাবে এ সন্তান কারো প্রতি হিংসাভাব পোষণ করবে না। আবার তার
প্রতিও কেউ হিংসা পোষণ করবে না। এ উপায়ে নরসংহার ও কোশল জনপদবাসীকে রক্ষা
করা যাবে। দিনে দিনে মাতাপিতা ও পাড়া-প্রতিবেশীদের স্নেহআদরে বড় হতে থাকে
অহিংসক। তার স্বাভাবিক আচরণে চৌর-লগ্নে যে তার জন্ম সে কথা গণকদের
ভবিষ্যবাণীর কথা সবাই ভুলে যেতে থাকে। বন্ধু-বান্ধব সকলের কাছে অতি প্রিয়
হয়ে উঠতে থাকে অহিংসক। বাল্যকাল কাটিয়ে উঠলে তার মাতাপিতা তাদের সন্তানকে
শাস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী করতে তৎকালীন বিখ্যাত আচার্যের নিকট
শিক্ষা-দীক্ষাদানের উদ্দেশ্যে অনান্য বাল্য-বন্ধুদের সাথে তক্ষশীলায়
পাঠালেন।
অল্প সময়ের মধ্যে অহিংসক লেখা-পড়ায়,
খেলা-ধূলায়, তার বিনম্র চাল-চলনে, আচার-ব্যবহারে শিক্ষকগণের বিশেষত আচার্য ও
গুরুমাতার মনে স্থান নিয়ে নেয়। অনান্য সহপাঠীদের তুলনায় সে অধিক প্রিয়ভাজন
হতে থাকে। আচার্যের ভালবাসায় শ্রাবস্তীর রাজপরিবারস্থ বন্ধু-বান্ধবরা
অপেক্ষাকৃতভাবে অহিংসকের প্রতি ঈর্ষাভাব পোষণ করতে লাগলো। কোন কিছুতেই তাকে
পরাজিত করতে না পেরে নিজেরাই তাদের ঈর্ষানলে জ্বলতে থাকে।
দিন যত যায় অহিংসক বুঝতে পারে তার
বাল্য-বন্ধুরা সেই আগের মত নেই। আগের মত তাকে ভালভাবে খোলামেলা ভাবে গ্রহন
করছে না। এদের এমন আচরণ দেখেও অহিংসক তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার ঈর্ষাপরায়ণ
না হয়ে নিজের লেখা-পড়ায় আরো অধিকতর মন দেয়। তার পরিপেক্ষিতে অহিংসকের
প্রতি তার বন্ধুরা আরো অনেক বেশি ঈর্ষাপরায়ণ হতে থাকে। ঈর্ষানলের আগুনে
থাকতে না পেরে এবার তারা অহিংসকের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে শুরু করে। তার
চাল-চলনের ব্যাপারে কুৎসা রটানো শুরু করে। শিক্ষকদের তার বিরুদ্ধে মিথ্যা
অভিযোগ করতে থাকে। কিন্তু শিক্ষকরা অহিংসকের চাল-চলনে অনেক খুশি। তাই তারা
এগুলা মাথায় রাখেন না।
এত কিছুর করার পরেও যখন কিছু করতে পারতেছে
না তখন তারা নাছোড়-বান্দা হয়ে মাঠে নামে। এবার তারা দুরাচারী হবার অস্ত্র
প্রয়োগ করেন। শেষ চালের অংশ হিসেবে তারা একে একে কয়েকবার গুরুমায়ের সাথে
অহিংসকের অনৈতিক দৈহিক সম্বন্ধের কথা শুনিয়ে শুনিয়ে আচার্যের কান ভারী করতে
শুরু করে। গুরু প্রথমে এগুলা পাত্তা না দিলেও ক্রমশ তা দিনকে দিন বাড়তে
থাকে। এদিকে আচার্য তার স্ত্রীর প্রতি দূর্বল ছিলেন। সবার মুখে এ কথা শুনে
আচার্যের বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে ক্ষুদ্ধ হন আর অহিংসকে কিভাবে আশ্রম হতে
বিতাড়িত করা যাই তার ফন্দি করতে থাকেন।
একদিন হঠাৎ আচার্য নির্দেশ প্রদান করলেন
অহিংসক যেন এ আশ্রম থেকে চলে যায়। এ খবর পেয়ে মাতৃস্নেহে গুরুমাতাও অনেক
কষ্ট পান। গুরুর অপ্রত্যাশিত নির্দেশে অহিংসক বড়ই ব্যথিত হয়। এ নির্দেশ
প্রত্যাখান করার মানসে গুরুর কাছে আকুতি মিনতি করতে থাকে অহিংসক। এত কিছুর
পরেও আচার্যের পাষাণ হৃদয় গলে নি। আচার্য ঈর্ষানলে এতটায় বশীভূত ছিলেন যে
শুধু আশ্রম থেকে নয়, এমনকি তক্ষশীলা হতে আজীবন নির্বাসন হয় তার ব্যবস্তা
করেন। অহিংসকের পীড়াপীড়িতে শেষ মেষ আচার্য বলেন- ঠিক আছে এক শর্তে আমি
তোমাকে রাখতে পারি। তখন অহিংসক স্ব-আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে ফেলে- যে শর্তই
হোক না কেন আমি তা পূর্ণ করবো। আমায় আপনাদের স্নেহ-আদর হতে বঞ্চিত করবেন
না গুরুদেব।
আচার্য বললেন- তোমাকে এর জন্য গুরু দক্ষিণা দিতে হবে ।
অহিংসক বলে- কি রকম দক্ষিণা বলুন, আমি দিতে রাজি আছি।
আচার্য- আমাকে এক হাজার মানুষের ডান হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল এনে দাও।
আচার্যের মুখে এমন বর্বর শর্ত শুনে হতবাক। এ সব শুনে অহিংসক বলে উঠলেন-
গুরুদেব মানুষ হত্যা, এ তো মহা পাপ। আপনি আর অন্য যে কোন দক্ষিণার কথা
বলুন! মনুষ্য হত্যা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমাকে ক্ষমা করুন।
অহিংসকের এমন কথা শুনে আচার্য বললেন-
হ্যাঁ, এটা যে পাপ তা আমি মানি, কিন্তু গুরুর আদেশ অমান্য করা এটা কি পাপ
নয়? যদি আমাকে সত্যিকারের গুরু দক্ষিণা দিতে চাও, তাহলে ঐ একহাজার
বৃদ্ধাঙ্গুলি আমাকে উপহার দাও। যদি আমাকে ঐ একহাজার আঙ্গুলি এনে দাও তাহলে
বিদ্যা-শিক্ষার বাকিটুকু শিক্ষাদান করবো। যাও এ মূহুর্তে এখান হতে বের হয়ে
আমাকে গুরুদক্ষিণা দাও।
অহিংসক আর কোন কথা না বলে ভরাক্রান্ত হৃদয়ে আশ্রম থেকে বেরিয়ে পড়ে।
তক্ষশীলার সীমানা পার হয়ে কোশল জনপদের
সীমানায় পা রাখতেই চিন্তাই ভেঙ্গে পড়ে , এখন এ অবস্থায় কি করবে সে। গুরুকুল
হতে বিতারিত হবার অপমান আর গুরু কর্তৃক এক হাজার মানুষের আঙ্গুল দক্ষিণা, এ
সব কিছু ভাবতেই সে কষ্টের আগুনে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। এভাবে কয়েকদিন চললেও
বিতারিত হবার অপমান এবং গুরুদক্ষিণা দেবার আদেশ তার সুন্দর কোমল মনকে দূষিত
করে ফেলে। অহিংসকের হৃদয়ে হিংসার আগুন সঞ্চার হতে লাগলো। মানবের আর মানব
সমাজের প্রতি তার হিংসার দাবানলের আগুন তীব্র হতে তীব্রতর হতে থাকে। আর
অহিংসক হিংসকে রূপান্তরিত হয়ে সংকল্পবদ্ধ হলেন যে, গুরুদক্ষিণা দিয়ে
অপমানের বদলা নিবে।
আঙ্গুল নিতে তো হত্যা করতে হবে। কিন্তু
শ্রাবস্তীর লোকলয়ে থেকে ঐ ভয়ানক সংকল্প কখনোই পূরণ করা সম্ভব নয়। সেজন্যে
অহিংসক লোকালয় ছেড়ে দিয়ে গভীর অরণ্যে অবস্থান গ্রহন করে। কিভাবে এই অপমানের
বদলা, কিভাবে আবার গুরুকুলে গিয়ে তার বাকি শিক্ষা অর্জন, কিভাবে
বাবা-মায়ের কাছে যোগ্য সন্তান হয়ে ঘরে ফিরে যাবে, সে চিন্তায়-দিনে একটা
দুইটা করে মানুষ হত্যা করে তাদের আঙ্গুল মালা বানিয়ে গলায় ধারণ করতে লাগলো।
ছেলে, বুড়া, নর-নারী কেউ আর তার হাত হতে
রক্ষা পেত না। কেউ যদি পালিয়ে জীবন বাঁচাতে চাইতো তরিৎ গতিতে ছুটে তাকে
হত্যা করে আঙ্গুল কেঁটে নিত। সেই হতেই অহিংসক নাম পরিবর্তিত হয়ে অঙ্গুলিমাল
রূপে পরিচিত লাভ করে। সবাই তার ভয়ে অন্যপথ দিয়ে যাতায়াত করতে থাকে।
বণিকেরাও তার ভয়ে অন্য রাস্তা ব্যবহার করতে থাকে। মানুষ যতই কমতে থাকে
অঙ্গুলিমালও তার অবস্থান বদলাতে থাকে।
লোকমুখে শুধু একটিই নাম অঙ্গুলিমাল। তার
কারনে কোশল রাজ্যে যাবার সব পথ অবরুদ্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়ে পড়ে। এভাবে
অবরুদ্ধ হয়ে পড়াতে রাজ দরবারে গিয়ে সবাই বিক্ষোভ করতে লাগলো।
রাজা প্রসেনজিৎ রাজপুরোহিত ভার্গবের কাছে তলব পাঠান, সে যেন অঙ্গুলিমালকে
বুঝিয়ে নিয়ে আসেন। সবাই তার ভয়ে অস্থির। অঙ্গুলিমালের পিতা ভর্গব রাজাকে
সরাসরি জবাব দেন—- এমন কুলঙ্গার, কলঙ্কিত পুত্র আমাদের প্রয়োজন নেই। রাজার
যেমন ইচ্ছা তেমন করা হোক।
এদিকে কোশলবাসীর ক্ষোভের মুখে রাজা
প্রসেনজিৎ তাঁর রজ্যের সেনাবাহিনীকে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়োজিত
করেন। এবং তাদের নির্দেশ প্রদান করা হয়, যে কোন ভাবেই হোক, অঙ্গুলিমালকে
জীবিত অথবা মৃত তার সামনে আনতে হবে। আর যদি তা সম্ভব না হয়, অঙ্গুলিমালের
মাথা কেটে আনা হোক।
এদিকে রাজা এ আদেশ রাজ্যের সমস্ত প্রান্তে
ঘোষনা করা হয়। এ ঘোষনাতেও অঙ্গুলিমালের কাজের মাত্রার কমতি নেই, বরং দিনকে
দিন বাড়তে থাকে। এতদিনে তার গলায় আঙ্গুলের সংখ্যাও বেড়ে গিয়ে নয়শত
নিরানব্বই। আর মাত্র একটি আঙ্গুল সংগ্রহ করতে পারলেই লক্ষ্যন পূরণ। এদিকে
মানুষের যাতায়াত কমে যাওয়াতে অঙ্গুলিমালের দুচিন্তার শেষ নাই, সে প্রলাপ
বকতে থাকে– আর মাত্র একটি আঙ্গুল, আর মাত্র একটি আঙ্গুল যদি সংগ্রহ করতে
পারি তাহলে আমার মন বাসনার পাশাপাশি গুরু দক্ষিণা দিয়ে গুরুর উপযুক্ত জবাব ও
গুরুমায়ের স্নেহ-ভালবাসায় পুনঃ সিক্ত হব! যে কোন ভাবেই হোক আমার আঙ্গুল
চাই চাই চাই।
অন্যদিকে অহিংসকের মা রাজার এ ঘোষনা শুনে
ভয়ে তটস্থ। মায়ের মন ছেলের জন্য কাঁদতে থাকে, পুত্রের জীবন বাঁচাতে বৃদ্ধা
মা ছুটে চললেন ছেলের সন্ধানে, পথে পথে তাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। সেনাবাহিনীর
সেনারা তাকে আটকে রাখতে চাইলেও পারলো না। ছেলেকে খুঁজতে অরণ্যে ছুটেই
চললেন।
জনশূন্য হওয়াতে অঙ্গুলিমাল কোশল জনপদের বেশ
কাছেই অবস্থান করছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর অবস্থান টের পেয়ে আবারো গভীর
অরণ্যে চলে যায়। মা, বনের ভেতর প্রবেশ করতেই ডাকতে লাগলেন— অহিংসক, অহিংসক,
আমার অহিংসক, তুমি কোথায় বাবা, একবার এ বৃদ্ধা মায়ের কাছে আস, কতদিন
দেখিনি তোমায়, তুমি কেমন আছ, কি খেয়েছ, কেমন দেখতে হয়েছ, আস বাবা আামর কাছে
আসো।
এভাবে যোজন, যোজন পথ অতিক্রম করতে করতে শ্রাবস্তী হতে তিন যোজন দূরে, জালিনী (জালি) বনে পৌঁছান।
এদিকে হঠাৎ মানুষের অবস্থান আর শব্দ শুনে
অট্টহাসি দিতে লাগলো—উ, হা,হা, হা,। মায়ের মুখে অহিংসক নাম শুনে
অঙ্গুলিমালের হৃদয় কিছুটা ব্যাকুল হলেও বহুদিনর পাওয়া থেকে বঞ্চিত আঙ্গুলের
তীব্রপীড়া তাকে বিদারিত করে। এবং বলতে থাকে আজকে তার গর্ভধারণীকে হত্যা
করে হলেও গুরু দক্ষিণা আমি দিবই দিব। আর বলতে লাগলো– কোথায় অহিংসক, এখানে
কোন অহিংসক থাকে না, এখানে শুধু একমাত্র অঙ্গুলিমাল, সবাই আমাকে এই নামেই
ডাকে। দেখছ না, আমার গলায় আঙ্গুলের মালা, এখানে নয়শত নিরানব্বইটি আঙ্গুল,
আর মাত্র একটি আঙ্গুল দরকার। আবারো সেই ভয়ানক অট্টহাসি। তখন করুণা ঘন
আবেগের কন্ঠে বৃদ্ধা মা বললেন– বাছা, অহিংসক, আমি তোমার মা, আমাকে চিনতে
পারছিস না বাবা অহিংসক। অঙ্গুলিমাল অট্টহাসি দিয়ে উত্তর দেয়, কে মা, কার
মা, আমি কাউকে চিনি না। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার আঙ্গুল। এই বলে খড়গ উঁচিয়ে
দৌড়াতে থাকে অঙ্গুলিমাল।
তথাগত বুদ্ধ তখন জেতবনে বিংশতম বর্ষাবাস
যাপন করতেছিলেন। প্রতিদিনকার নিয়ম অনুসারে প্রত্যূষকালে শ্রাবস্তীর
জেতবন-আরামে দিব্যদৃষ্টি বিস্তার করে ত্রিলোক অবলোকন করতে থাকেন।
তখনি দেখতে পেলেন অঙ্গুলিমাল ও তার বৃদ্ধা মাকে। বুদ্ধ আরো জানতে পারলেন- এ
জন্মে যদি অঙ্গুলিমাল তার মাকে হত্যা করে, তাহলে মাতৃ হত্যাজনিত ঘৃণিত
পাপের কারনে অবীচি নরকে গমন করবে। এবং সাথে সাথে বুদ্ধ জানতে পারলেন,
অঙ্গুলিমালের অরহত্বফল প্রাপ্তির সম্ভবনাও আছে।
মাতৃ হত্যাজনিত পাপের ফলে অঙ্গুলিমালের
জীবন ধংস এবং অপায়ে গমন করা হতে বিরত করতে করুণা বশতঃ মহাকারুণিক বুদ্ধ
তৎক্ষণাৎ ঋদ্ধিশক্তি প্রয়োগ করে জালিনী বনে বৃদ্ধা মা এবং আঙ্গুলিমালের
মাঝে উপস্থিত হন। অঙ্গুলিমাল ঠিক যখনি তার খড়গ দিয়ে মাকে হত্যার পরিকল্পনা
করতে থাকে তৎ মুহুর্তে বুদ্ধকে দেখতে পেয়ে মাকে বাদ দিয়ে বুদ্ধকে হত্যার
জন্যে ছুটে চলে।
অঙ্গুলিমালকে আসতে দেখে ভগবান বুদ্ধ তাঁর
এমন ঋদ্ধি প্রয়োগ করলেন যাতে করে, অঙ্গুলিমাল দৌড়ালেও ভগবান বুদ্ধকে ধরতে
না পারে। অঙ্গুলিমাল তার সমস্ত বল প্রয়োগ করেও বুদ্ধের কাছে পৌঁছাতে পারছিল
না। শেষে ক্লান্ত হয়ে সে নুইয়ে পড়ে, এবং ভাবতে থাকে– এ কেমন মানুষ, কে এই
শ্রমণ, আমি ধাবমান হরিণকে তৎক্ষনাৎ ধরতে পারি, অথচ এই শ্রমণকে কেন ধরতে
পারছি না! শেষে আঙ্গুলিমাল দূর্বল হয়ে বলে— হে শ্রামণ, থামো, (কঠিন গলায়)
থামো বলছি, আর এক পাও দৌড়াবে না !
বুদ্ধ– বৎস, আমি দৌড়াচ্ছি না, আমি তো স্থির; বরং তুমিই দৌড়াচ্ছো, তুমিই অস্থির। তুমিই থামো !
অঙ্গুলিমাল ভাবতে থাকে, এ আবার কেমন কথা, আমি এত দৌড় দিয়েও তাকে ধরতে
পারলাম না আর শ্রমণ বলে কিনা সে স্থির। এটা কিভাবে সম্ভব, তখন আঙ্গুলিমাল
বললো– হে শ্রামণ, আমার জানা মতে, শাক্য পুত্রগণ কখনো মিথ্যা কথা বলেন না।
তুমি দৌড়াচ্ছো অথচ আমাকে বলছো তুমি স্থির। এর মানে কি?
বু্দ্ধ– হে অঙ্গুলিমাল, সত্ত্বের কৃত
কর্মের সংযোজনের দন্ড ত্যাগ করেছি। আমি স্থির আছি, কিন্তু আবাগমনের দন্ড
নিয়ে তুমিই ধাবমান। আমি শান্ত আছি এবং স্থির। তুমিও স্থির হও। আমার ন্যায়
শান্ত হও। তাই তোমাকে শান্ত এবং স্থির হতে পরামর্শ দিয়েছি।
অঙ্গুলিমাল এবার চিন্তা করলো কে এই শ্রামণ!
এমন মধুর শব্দ আমি তো জীবনেও শুনি নাই, বুদ্ধের অমৃত বাণী শুনা মাত্রই তার
সারা মন-মানসিক, মস্তিস্কে এক অদ্ভুত তরঙ্গ বয়ে যেতে লাগলো। বোধশক্তি ফিরে
পেয়ে ভাবতে লাগলো এ শ্রমণ কোন সাধারণ শ্রমণ নন। নিশ্চয়ই আমার কল্যাণে এই
জনশূণ্য মহাঅরণ্যে আগমন করেছেন। তার হৃদয়ে জ্ঞানের সঞ্চার হয়।
প্রাণী হত্যার কারণ সম্পর্কে অবগত হয়ে উৎসুক হয়ে বলে উঠে– হে শ্রামণ, আপনি কে?
বুদ্ধ– আমি তথাগত গৌতম বুদ্ধ।
বুদ্ধের মুখে বুদ্ধ শব্দ উচ্চারিত হতেই খড়গ ফেলে দিয়ে বুদ্ধের পায়ে লুটিয়ে
পড়ে মাথা নত করে আর্তনাদ করতে থাকে.. এবং বলতে থাকে — ভগবান আমাকে রক্ষা
করতে আপনার এখানে আগমন। আমাকে রক্ষা করুন। তখন বুদ্ধ এস ভিক্ষু বলতেই
পূর্বজন্মের কর্মের প্রভাবে ঋদ্ধিবলে পাত্র-চীবর দিয়ে অঙ্গুলিমালের
উপসম্পদা সম্পন্ন হয়।
এরপর অঙ্গুলিমাল চীবর ধারন করে বুদ্ধের
অনুগামী হন। উভয়ে শ্রাবস্তী ফিরে আসেন। ভগবান বুদ্ধ একে একে সব বিনয় কর্ম
অঙ্গুলিমালকে অবহিত করেন। বুদ্ধের নির্দেশে ধ্যান-সমাধি ও বিনয় ধর্মে ব্রত
হয়ে খুব অল্পদিনের মধ্যে অরহত্ব-ফল লাভ করেন।
এদিকে রাজা প্রসেনজিৎ তাঁর দূতের মাধ্যেমে
জানতে পারলেন যে অঙ্গুলিমাল শ্রাবস্তীতে প্রবেশ করেছে। তখন রাজা প্রসেনজিৎ
অঙ্গুলিমালকে দমন করার জন্য নিজে এবং সসৈন্য-সামন্ত নিয়ে রওনা হলেন। ঐ পথ
দিয়ে যাবার সময় ভগবান বুদ্ধের দর্শন লাভ করার জন্য জেতবনে প্রবেশ করেন।
বুদ্ধের পাশে তখন অঙ্গুলিমাল উপস্থিত আছেন।
রাজাকে যুদ্ধের পোশাকে দেখে ভগবান বু্দ্ধ
জিজ্ঞাসা করলেন- মহারাজ এত হতাসাগ্রস্থ হয়ে স্ব-সৈন্য নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
কোথাও কোন যুদ্ধ আছে নাকি ? উত্তরে রাজা প্রসেনজিৎ বললেন- ভগবান, আমার
রাজ্যে এখন শুধু একটায় দুশ্চিন্তা, আর সেটা হল অঙ্গুলিমাল। ঐ অঙ্গুলিমালকে
যদি বশে আনতে পারতাম তাহলে আমি দুশ্চিন্তা মুক্ত হতাম। শুনলাম শ্রাবস্তীর
আশেপাশে অঙ্গুলিমাল অবস্থান করছে, তাই নিজ হাতে থাকে দমক করার জন্যে আমি
স্ব-শরীরে এসেছি।
মহারাজের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেবার
জন্যে ভগবান বুদ্ধ আর্শীবাদ প্রসঙ্গে বলেন- মহারাজ, কোশলবাসীর হিতার্থে যদি
ঐ অঙ্গুলিমাল আপনার নিকট এসে ধরা দেয়, তবে আপনার অনুভুতি কি হবে ?
রাজা প্রসেনজিৎ – যাকে আমার হাজার হাজার সৈন্য ধরে আনতে পারে নি, সে কি নিজে এসে ধরা দিবে ? এ অসম্ভব।
এবারে বুদ্ধ বললেন- মহারাজ যদি ঐ অঙ্গুলিমালকে সংসার ত্যাগ করা অবস্থায়, চীবর ধারন করা অবস্থায়, ভিক্ষু রূপে দেখেন তখন কি করবেন ?
রাজা প্রসেনজিৎ – ভগবান, আমি নিজ হাতে চীবরাদি পূজা করবো।
ভগবান বুদ্ধ – তখন ভগবান বুদ্ধ অঙ্গুলিমালের দিকে আঙ্গুল দিয়ে সংকেত দিয়ে বললেন- মহারাজ, এনিই অঙ্গুলিমাল।
অঙ্গুলিমাল!! রাজা নাম শুনতেই বসা অবস্থায়
দাঁড়িয়ে যান। রাজার গলার স্বর কেঁপে উঠল, কপাল দিয়ে ঘাম বেরোতে লাগলো। তখন
রাজা মনে মনে চিন্তা করতে লাগলো– এ কি করে সম্ভব। যাকে আমার হাজার হাজার
সেনাবাহিনী ধরতে পারে নি, তাকে কি করে ভগবান বুদ্ধ বিনা অস্ত্রে ধরে আনলেন,
তাও আবার ভিক্ষু রূপে। এ ঘটনা রাজার নিজের চোখে বিশ্বাস হচ্ছে না, এদিকে
আবার ভগবান বুদ্ধের কথাকেও তো অবিশ্বাস করা যায় না। শেষে নিজে গিয়ে নত
মস্তকে বুদ্ধকে এবং বুদ্ধের অনুগামী শিষ্য অঙ্গুলিমালকে নতশীরে বন্দনা
করলেন। আর নিবেদন করলেন– ভন্তে, আজ হতে আপনার চতুর্প্রত্যয় দানের ভার আমার।
প্রত্যুত্তরে অঙ্গুলিমাল বলেন–মজারাজ, আমি তথাগতের নির্দেশে ধুতাঙ্গ শীল
পালন করছি, চতুর্প্রত্যয় দাতার প্রয়োজন নেই।
অঙ্গুলিমালের মুখে এ সব কথা শুনে এবং সুশীল
ভিক্ষুরূপে দস্যু অঙ্গুলিমালকে পেয়ে তাকে হত্যা করে আনার দুশ্চিন্তা মুক্ত
হয়ে সমস্ত সৈন্যবাহিনীকে রাজ্যে ফিরে আসার অনুমতি প্রদান করে। মহাকারুণিক
বুদ্ধের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাজা রাজমহলে ফিরে যায়।
এ অল্প সময়ের মধ্যে শ্রাবস্তীবাসীর কাছে এ
খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অঙ্গুলিমাল ভগবান বুদ্ধের শরণাপন্ন হয়েছেন।
ধুতাঙ্গ-ব্রতধারী ভিক্ষু হয়ে তিনি শ্রাবস্তী-বাসীর দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে
ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করেন। যখন অঙ্গুলিমাল ভিক্ষোন্নে বের হন, তখন কেউ কেউ ভয়ে
দরজা-জানালা বন্ধ করে দেন, আবার কেউ কেউ দরজা-জানালা আধ খোলা অবস্তায়
অঙ্গুলিমালকে দেখতে চান। স্বাভাবিক ভাবে নয়শত নিরানব্বই মানুষ হত্যা কারিকে
কে না দেখতে চাই !!
নিরস্ত্র ভিক্ষুর বেশে অঙ্গুলিমালকে দেখে
অনেকে চমকে যান, আবার যাদের স্বজন অঙ্গুলিমালের হাতে প্রাণ হারিয়েছে, তাদের
স্বজনেরা ভিক্ষা দেওয়ার বদলে, ক্ষোভে ভিক্ষা না দিয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ
করতে থাকে। ইটের কন্ড অঙ্গুলিমালের মাথায়, শরীরে জখম করে তাকে রক্ষাক্ত করে
দেয়। ভাঙ্গা ভিক্ষা পাত্র ও রক্তাক্ত শরীর নিয়ে জেতবনারামে চলে আসেন।
বিহারে আসার পর ভগবান বুদ্ধকে বিস্তারিত বলেন।
ভগবান সব শুনে উপদেশ দিয়ে বললেন- হে
অঙ্গুলিমাল, নয়শত নিরানব্বই জন নিরাপরাধ মানুষের হত্যাজনিত পাপের ভয়ানক
নারকীয় যাতনার তুলনায় এ যাতনা অতি সাধারণ। সহনশীলতা বাড়িয়ে দিয়ে ক্ষমা দিয়ে
মানবতার পরিচয় দেবার উপদেশ প্রদান করেন ভগবান বুদ্ধ।
ভগবান বুদ্ধের নির্দেশ মত অঙ্গুলিমাল
ক্ষুদ্ধ জনতার ক্ষোভ-জনিত সব ধরনের অত্যাচার নীরবে সহ্য করতে থাকেন। এভাবে
কিছুদিন গত করার পর ধীরে ধীরে মানুষের হৃদয়ে ভালবাসার সঞ্চার হতে থাকে।
অঙ্গুলিমালের এত সুন্দর পরিবর্তন দেখে নগরবাসী মুগ্ধ হয়ে ইটপাটকেল ছোঁড়ার পরিবর্তে ভিক্ষাপাত্রে পিন্ডপাত দান দিতে শুরু করেন।
এভাবে দিনে দিনে অঙ্গুলিমাল সবার ভালবাসায় সিক্ত হয়ে জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন।
একদিন শ্রাবস্তীর এক কুটির হতে একজন নারীর করুণ আর্তনাদ শুনতে পান
অঙ্গুলিমাল। কারন জানতে ভিতরে প্রবেশ করে অঙ্গুলিমাল। গিয়ে জানতে পারেন যে
নারীটা গর্ভবতী। প্রসব বেদনায় চটপট করতেছে। নারীর এমন করুণ আর্তনাদ শুনে
অঙ্গুলিমালের হৃদয়ে করুণাবশত ভালবাসার সঞ্চার হল, দৌড়ে ছুটে এলেন ভগবান
বুদ্ধের কাছে, তারপর ভগবান বুদ্ধকে ঐ নারীর প্রসব বেদনা সম্পর্কে অবহিত করে
বললেন যে কি উপায়ে ঐ নারীর প্রসব বেদনা দুর করা যায়।
তখন বুদ্ধ অঙ্গুলিমালকে সত্যেক্রিয়া করতে বলেন- প্রতি উত্তরে অঙ্গুলিমাল জানতে চাই কি উপায়ে সত্যক্রিয়া করা যায় ?
ভগবান বুদ্ধ বললেন- কোন একটা ঘটনাকে নিয়ে অধিষ্ঠান করতে হয়।
অঙ্গুলিমাল- আমাকে শিখিয়ে দিন কিভাবে তা করতে হয়।
ভগবান বুদ্ধ- এ জীবনে আমি একটি প্রাণীরও
জীবন হত্যা করি নি, একথা যদি সত্যে হয় তাহলে ঐ সত্যের প্রভাবে ঐ গর্ভবতী
নারীর প্রসববেদন দূর হোক। এবং সুস্থ সুন্দর ভাবে বাচ্চা প্রসব হোক।
অঙ্গুলিমাল- আমি এ নিষ্ঠাবান সত্য ক্রিয়া করতে পারবো না, অতীত জন্মের কথা
বাদ দেন, এ জন্মে আমি নয় শত নিরানব্বই জন নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করেছি। এর
দ্বারা আমার সত্যক্রিয়া হবে না।
তখন বুদ্ধ বললেন- তাহলে এভাবে বলতে পারো
যে- আমি বুদ্ধের শরণনাপন্ন হবার পর থেকে একটি প্রাণীও হত্যা করিনি, এ
সত্যের প্রভাবে ঐ গর্ভবতী নারীর প্রসববেদন দূর হোক। এবং সুস্থ সুন্দর ভাবে
বাচ্চা প্রসব হোক।
উত্তরে অঙ্গুলিমাল বললেন- ভগবান বুদ্ধ, এ কথা বলতে আামর কোন আপত্তি নেই। কারন এই কথা টা অতিব সত্য।
বুদ্ধ- আয়ুস্মান, যাও এবার ঐ নারীর কাছে গিয়ে তোমার এ সত্যক্রিয়া কর।
ভগবান বুদ্ধের আদেশে অঙ্গুলিমাল কালবিলম্ব
না করে ঐ গর্ভবতী নারীর কুটিরের পাশে একটি পাথরে বসে বুদ্ধের নির্দেশ মত
সত্যক্রিয়া করেন এই ভাবে–
” যতোহং ভগিনী, অরিয়ায় জাতিয়া জাতো,
নাভিজানামি সঞ্চিচ্চ পাণং জীবিতা বোরোপেতা,
তেন সচ্চেন সোথ্থি তে হোতু গব্ভস্স “
অনুবাদ : হে ভগিনী বুদ্ধের শরণাপন্ন হয়ে
আর্যজাতিতে অহর্ৎ হবার পর থেকে সজ্ঞানে আমি একটি প্রাণীও হত্যা করি নি। যদি
এ কথা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এ সত্যের প্রভাবে আপনার প্রসব-বেদনা অচিরেই
দূর হোক।
অঙ্গুলিমাল অধিষ্ঠান শেষ করতেই ঐ গর্ভবতী
নারীর প্রসব-বেদনা দূর হয়। এবং একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন। এ ঘনটার পর
অঙ্গুলিমাল অনেক আনন্দিত হন। এবং সত্যক্রিয়ার যে মহৎফল সেটা ভাবতে ভাবতে
আনন্দিত হয়ে বিহারে এসে ভগবান বুদ্ধকে প্রণাম জানিয়ে সব কথা খুলে বলেলেন।
এদিকে এ কথা শ্রাবস্তীর অলিতে-গলিতে
লোক-জনের মুখে মুখে যে-অঙ্গুলিমালের সত্যক্রিয়ার প্রভাবে এক গর্ভবতী নারীর
প্রসব-বেদনা দূর হয়ে ঐ মহিলা একটি পুত্র সন্তান জন্মদান করেন।
সবাই অঙ্গুলিমারে প্রসংসায় পঞ্চমুখ।
এর পর হতেই এ সত্যক্রিয়া বৌদ্ধ সমাজে ” অঙ্গুলিমাল-পরিত্তং” নামে খ্যাতি অর্জন করে।
তথ্যঃ – জয়মঙ্গল অষ্টগাথা