পঞ্চপান্ডবদের বারো বছর বনবাস আর একবছর অজ্ঞাতবাসকালে ঘটনাটি ঘটেছিল গান্ধারদেশে। সেটা ছিল পান্ডবদের বনবাসের শেষ বছর। এরপরই শুরু হবে অজ্ঞাতবাস। ধর্মযুদ্ধ আগত। আর সেই ধর্মযুদ্ধে জয়ী হয়ে যুধিষ্ঠির হবেন সম্রাট। তাই যমের ইচ্ছা হল ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে একবার পরীক্ষা করে দেখার।
যম হরিণরূপে এক ব্রাহ্মণের অরণি-মন্থ চুরি করেন। অরণি-মন্থ হল একটি দণ্ড যা পাথরে ঘষে যজ্ঞের আগুন জ্বালানো হয়। তাই ঋষির যজ্ঞ নষ্ট হতে বসেছে। ঋষি যুধিষ্ঠিরের শরণাপন্ন হলেন। যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে বললেন, আমার অরণি আর মন্হ গাছে টাঙ্গানো ছিল, এক হরিণ এসে তার শিঙ্গে আটকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। আপনারা সেটি উদ্ধার করে দিন যাতে আমাদের যজ্ঞের অগ্নিহোত্রের হানি না হয়।
এ কথা শুনে যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের সঙ্গে নিয়ে যাত্রা করলেন হরিণের খোঁজে। বনমধ্যে হরিণকে দেখতে পেয়ে বাণ নিক্ষেপ করলেন কিন্তু কিছুতেই বিদ্ধ করতে পারলেন না। তারপরে আর দেখা গেল না সেই হরিণকে। পঞ্চপান্ডব তো হরিণকে আর খুঁজে পায় না ! পাবে কি করে সে তো যম। আর তিনি তো অদৃশ্য রয়েছেন।
পাণ্ডবরা বনে বনে ঘুরতে ঘুরতে গভীর জঙ্গলে এক বটবৃক্ষতলে এসে পৌছাল। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে তারা সেই বটগাছের শীতল ছায়ায় বসলেন। যুধিষ্ঠিরের আদেশে তখন নকুল বটগাছে উঠে চারদিক চেয়ে জানালেন, জলের ধারে জন্মায় এমন অনেক গাছ দেখা যাচ্ছে। সারসের রবও শোনা যাচ্ছে, অতএব কাছেই জল পাওয়া যাবে।
যুধিষ্ঠির বললেন, নকুল তোমার ভ্রাতারা সবাই ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত। তুমি খুব তাড়াতাড়ি জল নিয়ে এস তূণে করে। নকুল গাছ থেকে নেমে সেখানে গিয়ে সারস বেষ্টিত নির্মল জলাশয় দেখে যেই জল পান করতে ঝুঁকলেন, তখনই এক দৈববাণী শুনতে পেলেন। অন্তরীক্ষ থেকে কে বলছে, "বৎস, এই জল আমার অধিকারে আছে। জল পানের চেষ্টা কর না। আমার একটা নিয়ম আছে। আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। তারপর জল পান কর এবং নিয়ে যাও''। কিন্তু পিপাসিত নকুল সেই আদেশ অগ্রাহ্য করে শীতল জল যেই পান করল আর অমনি অচেতন হয়ে মাটিতে ঢলে পরল।
নকুলের বিলম্ব থেকে কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির বীর সহাদেবকে পাঠালেন। সেও নকুলের মত দৈববাণী না শুনে জল স্পর্শ করামাত্র অচেতন হয়ে মাটিতে পরে গেল। তারপর ধর্মরাজ সব্যসাচী অর্জুনকে পাঠালেন। তারও একই গতি হল। তারপর ভীম, দাদার আদেশ মত সেও গেল এবং তিন ভাইকে এমন অবস্থা দেখে অত্যন্ত রাগান্বিত হল। এবং সেও দৈববাণী না শুনে জলে হাত দিল এবং তারও একই দুর্দশা হল।
ভ্রাতারা কেউ ফিরে এলেন না দেখে উদ্বিগ্ন যুধিষ্ঠির নিজেই জলাশয়ের সামনে গেলেন। দেখলেন স্বর্নময় পদ্মশোভিত সরোবর। সেই সরোবরের তীরে ভ্রাতারা সকলে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছেন। যুধিষ্ঠির এসব দেখে বিলাপ করতে লাগলেন শোকে আকুল হয়ে। ভ্রাতাদের গায়ে আঘাতের চিহ্ন এবং ভূমিতে অন্য কারো পদচিহ্ন নেই দেখে তিনি ভাবলেন, কোনও মহাপ্রাণী বধ করেছে এঁদের, অথবা দুর্যোধন কিংবা শকুনি করিয়েছে এই গুপ্তহত্যা।
এবার সরোবরে নেমে জল পান করতে গেলেন যুধিষ্ঠির। এমন সময় উপর থেকে শুনলেন, "আমি মৎসশৈবালভোজী বক। তোমার এই মহাতেজস্বী ভ্রাতাদের আমিই পরলোকে পাঠিয়েছি। এই স্থানটি আমার অধিকারে। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, তারপরে জল পান কর। আমার প্রশ্নের উওর না দিয়ে যদি জল পান কর তাহলে তুমিও যাবে সেখানে"।
যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি কোন দেবতা ? আমার মহাবীর চার ভ্রাতাকে নিপাতিত করেছেন আপনি। আপনার কি অভিপ্রায় তা বুঝতে পারছি না। অত্যন্ত ভয় হচ্ছে আমার, কৌতুহলও হচ্ছে। ভগবান, কে আপনি ?
যুধিষ্ঠির এই উওর শুনলেন "আমি যক্ষ"। তখন তালগাছের মতো মহাকায় বিকটাকার সূর্য ও অগ্নির মতো তেজস্বী এক যক্ষ গাছে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মেঘগম্ভীর স্বরে বললেন, "আমি বহুবার বারণ করেছিলাম তবুও তোমার ভ্রাতারা গিয়েছিল জল পান করতে, তাই মেরেছি তাদের। যুধিষ্ঠির, আগে আমার প্রশ্নের উওর দাও, তারপর জল পান কর"।
যুধিষ্ঠির বললেন, যক্ষ, তোমার অধিকূত বস্তু আমি নিতে চাইনা। তুমি প্রশ্ন কর, আমি নিজের বুদ্ধি অনুসারে উওর দেব।
এরপর যক্ষ একে একে অনেকগুলি প্রশ্নগুলি করলেন এবং রাজা যুধিষ্ঠিরও একে একে তার উওরগুলি দিলেন।
যক্ষ - কে সূর্যকে উর্ধ্বে রেখেছে ? সূর্যের চতুর্দিকে ভ্রমন করে কে ? কে তাঁকে অস্তে পাঠায় ? কোথায় প্রতিষ্ঠিত আছেন তিনি ?
যুধিষ্ঠির - ব্রহ্ম সূর্যকে উর্ধ্বে রেখেছেন, দেবগণ তাঁর চতুর্দিকে বিচরণ করেন, তাঁকে অস্তে পাঠায় ধর্ম, তিনি প্রতিষ্ঠিত আছেন সত্যে।
যক্ষ - ব্রাহ্মণের দেবত্ব কি কারণে হয় ? কোন ধর্মের জন্য তাঁরা সাধু ? কেন তাঁদের মানুষভাব হয় ? অসাধুভাব কেন হয় ?
যুধিষ্ঠির - বেদাধ্যায়নের ফলে তাঁদের দেবত্ব, তপস্যার ফলে সাধুতা, তাঁরা নশ্বর এজন্য তাঁরা মানুষ, তাঁরা অসাধু হন পরনিন্দার জন্য।
যক্ষ - ক্ষত্রিয়ের দেবত্ব কি ? সাধুধর্ম কি ? মানুষভাব কি ? অসাধুভাব কি ?
যুধিষ্ঠির - অস্ত্রনিপুণতাই ক্ষত্রিয়ের দেবত্ব, যজ্ঞই সাধুধর্ম, ভয় মানুষভাব, শরণাগতকে পরিত্যাগই অসাধুভাব।
যক্ষ - পৃথিবী অপেক্ষা গুরুতর কে ? আকাশ অপেক্ষা উচ্চতর কে ? বায়ু অপেক্ষা অধিক দ্রুতগামী কে ? তৃণ অপেক্ষা বিস্তৃত কে ?
যুধিষ্ঠির - মাতা পৃথিবী অপেক্ষা গুরুতর, আকাশ অপেক্ষা উচ্চতর পিতা, বায়ু অপেক্ষা দ্রুতগামী মন, চিন্তা তৃণ অপেক্ষা বিস্তৃত।
যক্ষ - সুপ্ত হয়েও চক্ষু মুদ্রিত করে না কে ? জন্মগ্রহণ করেও স্পন্দিত হয় না কে ? কার হৃদয় নেই ? বেগ দ্বারা বৃদ্ধি পায় কে ?
যুধিষ্ঠির - নিদ্রাকালেও চক্ষু মুদ্রিত করে না মৎস্য, অন্ড প্রসূত হয়েও স্পন্দিত হয় না, পাষাণের হৃদয় নেই, বেগ দ্বারা বৃদ্ধি পায় নদী।
যক্ষ - প্রবাসী, গৃহবাসী, আতুর ও মুমূর্ষু - এদের মিত্র কারা ?
যুধিষ্ঠির - প্রবাসীর মিত্র সঙ্গী, গৃহবাসীর মিত্র ভার্যা, চিকিৎসক আতুরের মিত্র, মুমূর্ষুর মিত্র দান।
যক্ষ - কি ত্যাগ করলে লোকপ্রিয় হওয়া যায় ? কি ত্যাগ করলে শোক হয় না ? কি ত্যাগ করলে মানুষ ধনী হয় ? কি ত্যাগ করলে সুখী হয় ?
যুধিষ্ঠির - অভিমান ত্যাগ করলে লোকপ্রিয় হওয়া যায়, ক্রোধ ত্যাগ করলে শোক হয় না, কামনা ত্যাগ করলে লোকে ধনী হয়, লোভ ত্যাগ করলে সুখী হয়।
তারপর যক্ষ বললেন, বার্তা কি ? আশ্চর্য কি ? পথ কি ? এবং সুখী কে ? আমার এই চার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জল পান কর।
বনবাসী রাজা যুধিষ্ঠির উওর দিলেন, পৃথিবীর এই মোহময় কড়াতে সূর্য্যরূপ অগ্নিদ্বারা, দিবারাত্রিরূপ কাষ্ঠ দ্বারা, মাসঋতুরূপ হাতাদ্বারা ঘাঁটিয়া ‘কাল’ জীবগণকে পাক করিতেছে, ইহাই বার্তা। প্রতিদিন জীবগণ মরিতেছে, অথচ অবশিষ্ট সকলে অমরত্ব আকাঙ্ক্ষা করে, ইহা অপেক্ষা আর আশ্চর্য কি ? বেদ বিভিন্ন, স্মৃতি বিভিন্ন, নানা মুনির নানা মত, ধর্মের মর্ম্ম অমীমাংসিত ভাবে রহিয়াছে; অতএব মহান ব্যক্তিগণ যে পথে গিয়াছেন, তাহাই মানুষের অনুকরণীয় পথ। অঋণী ও অপ্রবাসী হইয়া যে ব্যক্তি বেলাশেষে নিজগৃহে শাকমাত্র পাক করিয়া খায়, হে বারিচর, সেই সুখী। য
যক্ষ বললেন, তুমি আমার প্রশ্নের যথাযথ উওর দিয়েছ, এখন বল, পুরুষ কে ? সর্বধনেশ্বর কে ?
যুধিষ্ঠির উওর দিলেন, পুণ্যকর্মের শব্দ স্বর্গ ও পৃথিবী স্পর্শ করে, যত কাল সেই শব্দ থাকে তত কালই লোকে পুরুষ রূপে গণ্য হয়। প্রিয় - অপ্রিয়, সুখ - দুঃখ, অতীত ও ভবিষ্যৎ যিনি তুল্য জ্ঞান করেন তিনিই সর্বধনেশ্বর।
যুধিষ্ঠিরের উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে যক্ষ বললেন, রাজা, আমি তোমার প্রতিটি উত্তরদানে প্রসন্ন হয়েছি। আমি তাই তোমার এই চার ভাইয়ের মধ্যে একজনকে জীবনদান করব। তুমি বল, কাকে তুমি বাঁচাতে চাও।
যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি নকুল বা সহদেবের জীবনদান করুন।
যক্ষ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি ভীম বা অর্জুনের জীবন না চেয়ে নকুল বা সহদেবের জীবন চাইলে কেন ? তোমার কাছে তাঁদের জীবন বেশী মূল্যবান কেন ?
উত্তরে যুধিষ্ঠির বললেন, আমি, ভীম এবং অর্জুন মাতা কুন্তীর গর্ভজাত, কিন্তু নকুল ও সহদেব আমাদের অপর মাতা মাদ্রীর গর্ভজাত। আপনি যখন একজনকেই জীবনদান করবেন, তখন নকুল বা সহদেব জীবিত থাকলে দুই মাতারই একজন করে সন্তান এ সংসারে বেঁচে থাকবে। দুই মাতাকেই আমি সমান জ্ঞান করি। যক্ষ বললেন, ভরতশ্রেষ্ঠ, তুমি অর্থ ও কাম অপেক্ষা অনৃশংসতাই শ্রেষ্ঠ মনে কর, অতএব তোমার সমস্ত ভ্রাতাই জীবনলাভ করুন।
ভীমসহ সকলেই প্রাণ ফিরে পেলেন, ক্ষুধাপিপাসাও দূর হল তাঁদের। যুধিষ্ঠির এবার যক্ষকে বললেন, আপনি অপরাজিত হয়ে এই সরোবর তীরে দাঁড়িয়ে আছেন এক পায়ে, কোন দেবতা আপনি ? আমার এই মহাবীর ভ্রাতাদের নিপাতিত করতে পারেন এমন যোদ্ধা আমি দেখি না। এঁরা জাগরিত হয়েছেন সুখে অক্ষত দেহে। বোধহয় আপনি আমাদের সুহৃৎ বা পিতা।
যক্ষ বললেন, বৎস, আমি তোমার জনক ধর্ম। তুমি আমার কাছে বর চাও।
যুধিষ্ঠির বললেন, যাঁর অরণি ও মন্হ হরিণ নিয়ে গেছে সেই ব্রাহ্মণের অগ্নিহোত্র যেন লুপ্ত না হয়।
ধর্ম বললেন, তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য আমিই মৃগরূপে হরণ করেছিলাম অরণি ও মন্হ। এখন তা ফিরিয়ে দিচ্ছি। তুমি এখন অন্য বর চাও।
যুধিষ্ঠির বললেন, আমাদের বারো বছর অতিবাহিত হয়েছে বনে। এখন তেরো বছর উপস্হিত। আমরা যেখানেই থাকি না কেন, কোনও লোক যেন চিনতে না পারে আমাদের।
ধর্ম বললেন, তাই হবে। তোমরা নিজ রূপে বিচরণ করলেও কেউ চিনতে পারবেনা তোমাদের। তোমরা তেরো বছর অজ্ঞাত হয়ে থেকো বিরাট রাজার নগরে। তোমরা যেমন ইচ্ছা সেইরকম রূপ ধারণ করতে পারবে।
.
No comments:
Post a Comment