১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর মেদিনীপুর জেলার হাবিবপুর গ্রামে ক্ষুদিরামের জন্ম হয়।
পিতা ত্রৈলোক্যনাথ বসু এবং মা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। এঁদের
দুই পুত্র
শৈশবেই
মৃত্যুবরণ
করেন। তাই তিন কন্যার পর
যখন তাঁর জন্ম হয়, তখন পরিবার-পরিজনের
কথা
শুনে, তিনি এই পুত্রকে তার বড় বোনের কাছে তিন
মুঠি খুদের
(শস্যের
খুদ) বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। খুদের বিনিময়ে ক্রয়কৃত শিশুটির নাম পরবর্তীতে
ক্ষুদিরাম রাখা হয়।
১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিতা ত্রৈলোক্যনাথ বসু এবং মা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর
মৃত্যু হয়। এই সময় থেকে তাঁকে প্রতিপালন করেন তার বড় বোন
অপরূপা'র
কাছে। গ্রামের বিদ্যালয়ে
প্রাথমিক শিক্ষার পর তমলুকের 'হ্যামিল্টন' স্কুলে লেখপড়া করেন।
১৯০২
খ্রিষ্টাব্দে
ক্ষুদিরাম
ভগ্নীপতি অমৃতের
সাথে মেদিনীপুর
শহরে চলে আসেন।
এই কারণে
তমলুক-এর
'হ্যামিল্টন' স্কুল তাঁকে ত্যাগ করতে হয়।
ভ্গ্নীপতি
তাঁকে
মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি
করে দেন।
১৯০২
খ্রিষ্টাব্দে তিনি
বিপ্লবীদের
একটি নবগঠিত
দলে যুগান্তরে যোগদান করেন।
১৯০২-০৩
খ্রিষ্টাব্দে
যখন বিপ্লবী নেতা শ্রীঅরবিন্দ এবং সিস্টার নিবেদিতা মেদিনীপুর ভ্রমণ করে
জনসম্মুখে বক্তব্য রাখেন।
তখন তাঁদের এই বক্তব্য শুনে
ক্ষুদিরাম বিপ্লবে যোগ দিতে
বিশেষভাবে
অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে
ঋষি রাজনারায়ণ বসুর (১৮২৬-১৮৯৯)
ভাইয়ের ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সান্নিধ্যলাভ করেন।
উল্লেখ্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন
তাঁর শিক্ষক।
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মেদিনীপুরের কলেজিয়েট ভর্তি হন এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত
তিনি শিক্ষা লাভ করেন।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনের দ্বারা ক্ষুদিরাম প্রভাবিত
হন এবং পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সত্যেন বসুর গুপ্ত সমিতিতে যোগ দেন। এই
সমিতিতে তিনি আরও কয়েকজনের সাথে শরীরচর্চা ও রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকেন। এই
সময় সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য নেজেকে তৈরি করার জন্য, পিস্তল চালনা শেখেন। স্বদেশী
আন্দোলনের অংশ হিসেবে, তিনি ইংল্যাণ্ডে উৎপাদিত কাপড় পোড়ানো ও ইংল্যাণ্ড থেকে
আমদানিকৃত লবণ বোঝাই নৌকা ডোবানোর কাজে ক্ষুদিরাম অংশগ্রহণ করেন।
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে মেদিনীপুরের এক কৃষি ও শিল্পমেলায়
বিপ্লবী পত্রিকা
‘সোনার বাংলা’
বিলি করার সময়, ক্ষুদিরাম প্রথম পুলিশের হাতে ধরা পড়েন, কিন্তু পালিয়ে যেতেও
সক্ষম হন। পরবর্তী মাসে একই কাজ করার জন্য তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং আদালতে
বিচারের সম্মুখীন হন। কিন্তু অল্প বয়সের জন্য তিনি মুক্তি পান।
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে
বিপ্লবীদের গোপন সংস্থায় অর্থের প্রয়োজনে,
হাটগাছায় বিপ্লবীরা ডাকের থলি লুট করেন। ধারণা করা হয় ক্ষুদিরাম এই দলের সাথে
ছিলেন। এই বছরের ৬ই ডিসেম্বর নারায়ণগড় রেল স্টেশনের
কাছে বঙ্গের ছোটলাটের বিশেষ রেলগাড়িতে বোমা আক্রমণের ঘটনার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন
বলেও ধারণা করা হয়। একই বছরে মেদিনীপুর শহরে অনুষ্ঠিত এক রাজনৈতিক সভায়
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শিত
হলে, তিনি তাতে অংশগ্রহণ করেন।
ক্ষুদিরামের স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার জন্য, তাঁর জামাইবাবু সরকারি
চাকুরিতে অসুবিধা সৃষ্টি হয়। তাই তিনি ক্ষুদিরামকে অন্য আশ্রয়ে যেতে বলেন। এই সময়
তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন মেদেনীপুরের উকিল সৈয়দ আব্দুল ওয়াজেদের বোন।
এই সময় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনের কর্মীদের কঠোর সাজা ও দমননীতির কারণে,
কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড বাঙালিদের অত্যন্ত ঘৃণার
পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন।
বিশেষ
করে,
আলিপুর আদালত
প্রাঙ্গনে
'বন্দেমাতরম' ধ্বনি উচ্চারণ করার
জন্য কলকাতার প্রেসিডেন্সি
ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড,
সুশীল সেন নামক ১৬ বছরের এক কিশোরকে প্রকাশ্য স্থানে বেত মারার আদেশ দেন।
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে অল্প
কাল পরে কলকাতাস্থ মানিকতলায় মুরারীপুকুরে রবীন কুমার ঘোষের বাগান বাড়িতে একটি সশস্ত্র বিপ্লবী দলটি গঠিত
হয়েছিল। এই দলটি পরবর্তী সময়ে 'যুগান্তর বিপ্লবী দল' নামে পরিচিতি লাভ করে।
যুগান্তর বিপ্লবী দলের পক্ষ থেকে
'কিংসফোর্ড'কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
নিরাপত্তার
কারণে
কিংসফোর্ডকে
বিহারের
মজফফরপুরে
বদলি
করা
হয়।
ফলে
কিংসফোর্ড'কে
হত্যা
করার দায়িত্ব পড়ে
প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরামের উপর।
১৯০৮
সালের
৩০শে
এপ্রিল
রাত ৮টার সময় ক্ষুদিরাম
বসু
ও
প্রফুল্ল
চাকী
রাতের
অন্ধকারে,
স্থানীয় ইউরোপীয় ক্লাবের গেটের কাছে একটি গাছের আড়াল থেকে
কিংসফোর্ডের
গাড়ি
ভেবে,
একটি
ঘোড়ার
গাড়িতে
বোমা
নিক্ষেপ
করে।
এর ফলে এই গাড়িতে বসা
নিরপরাধ
মিসেস
কেনেডি
ও
তার
কন্যা
মৃত্যুবরণ
করেন। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে, পুলিশ সমগ্র অঞ্চল জুড়ে তল্লাসি চালাতে থাকে।
ক্ষুদিরাম
বসু
হত্যাকাণ্ডের
স্থল
থেকে
প্রাণ
২৫
মাইল
দূরে
ওয়েইনি
১লা
মে
স্টেশনে
ধরা
পড়েন।
এই সময়
অপর বিপ্লবী প্রফুল্ল
চাকীকেও
ধরার
চেষ্টা
করা
হলে,
তিনি
নিজের
রিভলবারের
গুলিতে
আত্মঘাতী
হন।
তিনি বোমা নিক্ষেপের সমস্ত দায়িত্ব নিজের উপর নিয়ে নেন। কিন্তু অপর কোনো সহযোগীর
পরিচয় দিতে বা কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ করতে রাজি হন নি। ভারতীয় দণ্ডবিধি ৩০২ ধারা
অনুসারে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ফাঁসির আদেশ শুনে ক্ষুদিরাম
বসু হাসিমুখে বলেন যে, মৃত্যুতে তাঁর কিছুমাত্র ভয় নাই।
ফাঁসী
কার্যকর
করার
আগে তাঁর শেষ ইচ্ছা কি জানতে চাওয়া হলে- তিনি বলেন যে, তিনি বোমা বানাতে পারেন।
অনুমতি দিলে তিনি তা সকলকে শিখিয়ে
দিতে পারেন। বলাই বাহুল্য এই ইচ্ছা ব্রিটিশ কর্মকর্তারা গ্রহণ করেন নি। এরপর এর
পরিবর্তে দ্বিতীয় ইচ্ছা পূরণের কথা বলা হলে- তিনি তাঁর বোন অরূপাদেবীর সাথে দেখা
করতে চান। কিন্তু তাঁর জামাইবাবুর বাধায় সে ইচ্ছা পূর্ণ হয় নি। তবে
মেদেনীপুরের উকিল সৈয়দ আব্দুল ওয়াজেদের বোন (নাম জানা যায় নি), তাঁকে বোনের স্নেহে
আশ্রয় দিয়েছিলেন। তিনি বিপদ মাথায় নিয়ে ক্ষুদিরামের সাথে দেখা করেছিলেন।
মজফফরপুর
জেলেই
১৯০৮
খ্রিস্টাব্দের
১১
আগস্ট
ক্ষুদিরাম
বসুর
ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এই সময় তাঁর বয়স ছিল ১৮ বৎসর ৭ মাস ১১দিন।
No comments:
Post a Comment