বিজ্ঞান মতে সূর্য হল সমস্ত শক্তির আধার। সমস্ত জৈবনিক ক্রিয়াকলাপ চালু থাকে সূর্যের শক্তি নিয়েই। আবার দেবতা হিসেবে সূর্যের উপাসনা ছিল প্রাচীন সভ্যতার অঙ্গ। সে-সময় ধর্মবিশ্বাস এবং প্রকৃতিনির্ভরতা মানুষের জীবনচর্যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ছিল। ঋগ্বেদে সবিতা, আদিত্য, বিষ্ণু, বরুণ, পুষা, অর্যমা, ভগ, মিত্র, সূর্য প্রভৃতি নানা নামে যে দেবতার পরিচয় পাওয়া যায় তিনিই পুরাণে সূর্য অভিধায় অভিহিত হয়ে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। পৌরাণিক অভিধান মতে, আর্যদের উপাস্য দেবতা হল সূর্য। সূর্য, সবিতা, আদিত্য, বিবস্বান, বিষ্ণু-পাঁচটি নামে সূর্যের স্তুতি পাওয়া যায়। আর্যজাতির বিভিন্ন শাখায় সূর্যের উপাসনা দেখতে পাওয়া যায়। ইনি গ্রীকদের 'হেলিয়স' নামে, লাতিনদের কাছে 'সল', টিউটনদের কাছে 'টিয়ার', ইরানীদের কাছে 'খুরসিদ' নামে পরিচিত। হেলিয়স থেকে হেলিওথেরাপি বা সূর্যালোক হাজার হাজার বছর ধরে চর্মরোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। চিকিৎসায় হেলিওথেরাপি প্রয়োগের প্রমাণ পাওয়া যায় ১৪০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। ত্বকের বিভিন্ন রোগে কিছু উদ্ভিজ পদার্থকে ব্যবহার করে রোগীকে সূর্যস্নান করানোর পদ্ধতি চালু ছিল। সূর্যরশ্মি যে-সমস্ত রোগের নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে সেগুলি হল সোরিয়াসিস, ভিটিলিগো, ক্যান্সার ইত্যাদি। এমনকি উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নিলস রিবার্গ ফিনসেন (১৮৬০-১৯০৪) সৌরশক্তির রোগনিরাময় ক্ষমতা নিয়ে গবেষণা করেন এবং ১৯০৩ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। সুতরাং সহজেই অনুমেয় যে দেবতা রূপে, শক্তির আধার রূপে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে সূর্যের গুরুত্ব অপরিসীম। আবার আমাদের মহাকাব্যেও সূর্যের আলোকোজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত এবং শম্ভুনাথ কুণ্ডু প্রণীত 'প্রাচীন বঙ্গে পৌরাণিক ধর্ম ও দেবভাবনা' গ্রন্থ উল্লেখ করে বলা যায় যে, বৈদিক যুগে বিষ্ণু ও সূর্য ছিলেন অভিন্ন। কিন্তু পৌরাণিক দেবভাবনায় তাঁরা ভিন্ন হলেন এবং বিষ্ণুকে কেন্দ্র করে একটি পৃথক সম্প্রদায় শুধু গড়ে ওঠেনি---ক্রমশ বিস্তার ও ব্যাপ্তি লাভ করে। অপরপক্ষে যে সূর্যের প্রতি প্রার্থনা বা স্তূতি সীমিত ছিল ব্রাহ্মণদের গায়ত্রীমন্ত্রে তিনি ক্রমশ একটি মূর্তি হিসেবে পূজিত হতে লাগলেন, যখন শাকদ্বীপ থেকে মগদ্বিজরা এসে সেই মূর্তিপূজার বিধিমতো ব্যবস্থা করলেন। বঙ্গদেশীয় বিভিন্ন লেখমালায় তাঁর সশ্রদ্ধ উল্লেখ তাঁকে স্বমহিমায় বরেণ্য করেছে।
রাজশাহী জেলার জগদীশপুর তাম্রশাসনে গুল্মগন্ধিকায় সহস্ররশ্মি (সূর্য)-র মন্দির নির্মাণ এবং পুজোর ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য ভূমিদান করেন ক্ষেমার্ক, ভোয়িল ও মহিদাস নামে তিন গৃহস্থ। আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগে বর্ধমান জেলার গলসীর কাছে প্রাপ্ত গোপচন্দ্রের বর্ধমানভুক্তির মল্লসারুল তাম্রশাসনে লোকনাথ ধর্মের উদ্দেশে প্রণাম নিবেদিত হয়েছে---'জয়তী শ্রীলোকনাথঃ ষঃ পুংসাং সুকৃৎ-হেতু।/সত্য-তপোময়মূর্ত্তিল্লোকদ্বয়-সাধনো ধর্মঃ।।'' বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্ণনা ও মূর্তিবিচারে লোকনাথ ধর্মরূপী সূর্যই। এই সূর্য শাকদ্বীপী মগ ব্রাহ্মণগণ আনীত উদীচ্যবেশী। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে গুপ্ত এবং গুপ্তোত্তর পর্বে বাংলাদেশে সৌরধর্ম কতকাংশে প্রতিপত্তি লাভ করে এবং তাকে কেন্দ্র করে একটি বিশিষ্ট সৌর সম্প্রদায়ও গড়ে উঠেছিল। দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর এবং হুগলি জেলা থেকে প্রাপ্ত দুটি পূর্ণাবয়ব সূর্য মূর্তি, বর্ধমান জেলা থেকে ভগ্ন অবস্থায় উদ্ধার হওয়া একাধিক সূর্য মূর্তি, নবগ্রহ মূর্তি স্থান পেয়েছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহশালায়। বেলকাশ থেকে মল্লসারুলের দূরত্ব আহামরি কিছু নয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহশালায় রক্ষিত বর্ধমান জেলা থেকে পাওয়া একাধিক সূর্যমূর্তি বর্ধমান এবং সংলগ্ন এলাকার সৌরসম্প্রদায়ের স্তূতি বা ব্যাপ্তি যে ছিল তার মান্যতা দেয়।
দিনাজপুর জেলার বৈরহাট্টা গ্রামে প্রাপ্ত আসীন সূর্যমূর্তির পাদপীঠে উৎকীর্ণ লিপি 'সমস্ত-রোগাণাং হর্ত্তা' বঙ্গদেশে সূর্যের রোগবিনাশী রূপটি প্রকাশ করে। ভবিষ্য, শাম্ব, বরাহ, স্কন্দ প্রভৃতি পুরাণে সূর্য কর্তৃক কৃষ্ণ ও জাম্ববতীর পুত্র শাম্বের কুষ্ঠরোগমুক্তির কাহিনিকে সমর্থন করে। শাম্ব কর্তৃক মথুরায় প্রতিষ্ঠিত সূর্যবিগ্রহের নাম শাম্বাদিত্য। কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে কবি ময়ূরভট্ট 'সূর্যশতক' রচনা করেছিলেন। সূর্যদেবতার কুষ্ঠরোগ নিবারক গুণটির জন্য তিনি জনগণের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। পরবর্তীকালে ধর্মঠাকুরের মধ্যেও সূর্যের এই গুণটি আরোপিত হয়েছিল। মনে করা হয় যে বঙ্গদেশে ধর্মঠাকুরের ব্যাপক জনপ্রিয়তার জন্য সূর্যের বিগ্রহ পূজার চলন হ্রাস পায়।
দক্ষিণ দামোদরের শাঁকারি গ্রামের কবি নরসিংহ বসু যে ধর্মঠাকুরকে দেখে ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনায় (১৭১৪ খ্রিস্টাব্দ) হাত দিয়েছিলেন সেই জুজুটি গ্রামের ধর্মঠাকুরের খোঁজে গিয়ে বর্তমান প্রবন্ধে আলোচ্য সূর্যমূর্তিটি নজরে আসে লেখকের। সহকর্মী মিলিকপাড়ার শ্রীমন্ত মণ্ডলের পরিচিত পাশাপাশি গ্রাম জুজুটি। তারই দ্বিচক্রযানে ফেরার পথে বেলকাশ গাজনতলার উল্টোদিকে বাঁধের লাগোয়া হাতির পিঠের মতো প্রাচীন বাংলার দোচালা রীতির ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়ানো একটি মন্দির চোখ টেনেছিল। মন্দিরের ওপরের দুটি অশ্বত্থ গাছের শিকড় গ্রাস করেছে গোটা মন্দিরটিকে। পাতলা ছোটো ইটে তৈরি মন্দিরের বাইরের দিকের আর্চওয়ে এবং লম্বালম্বি প্যানেলে কিছু টেরাকোটার নিদর্শন এখনও চোখে পড়ে। সামনের দিকে ত্রিখিলান যুক্ত প্রবেশপথগুলি দামোদরের পুরোনো বাঁধের মাটিতে প্রায় পোঁতা। সামান্য অংশই দেখা যায়। মূল প্রবেশপথের (এখন বন্ধ) ওপরের দেওয়ালের ইট সরিয়ে কিছুটা কেটে আলোর পথ করা হয়েছে। কারো মতে, এই পথ দিয়েই মন্দিরের মূর্তি চুরি হয়েছে স্মরণাতীত কালে। কেন এসেছি এই কৌতূহলে জুটে যায় কিছু উৎসাহী মানুষও। সংলগ্ন রায়পরিবারের কর্তা মন্দিরের ভেতরে নিয়ে যান। পিছন দিকে এক খিলানযুক্ত প্রবেশপথে মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়। অন্ধকার ভেতরে টর্চ বা মোবাইল জ্বালালে চোখে পড়বে এই মন্দিরের পক্ষে অবাক করা একটি সূর্য মূর্তি।
গৃহকর্ত্রী শিবানী রায় এবং তাঁর পুত্র রানা পাশের দামোদর নদে মাছ ধরে জীবন যাপন করেন। বছর পাঁচেক আগে দামোদরে ফাঁদি জাল পেতে মাছ ধরার সময় মায়ের পায়ে ঠেকে পাথরটি। কী জিনিস আগ্রহে তুলে দেখেন সেটি একটি মূর্তি! ভারি মূর্তিটি পুত্রের মাথায় তুলে বাড়ি নিয়ে এসে পরিষ্কার করে বসান ভাঙা মন্দিরে। মূর্তি দেখতে আসা মানুষজনের কাছে তিনি জানতে পারেন সেটি সূর্যমূর্তি। বর্ধমানে এই সূর্য মূর্তি নিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় প্রথম আলোকপাত করেন আঞ্চলিক ইতিহাসসন্ধানী সঞ্জীব চক্রবর্তী।
পাথরে খোদিত সূর্যমূর্তিটি দৈর্ঘেপ্রস্থে যথাক্রমে ২৭ এবং ১৪.৫ ইঞ্চি। মূর্তিশৈলী বিশেষজ্ঞদের মতে মূর্তিটি পাল-সেন যুগের। কোমরবন্ধ সহ মূর্তিটি কীরিটধারী, সনাল পদ্ম দুই হাতে। আছেন দণ্ডী ও পিঙ্গল এবং অন্ধকারকে চ্যালেঞ্জ জানানো ঊষা ও প্রত্যুষা। সপ্তাশ্ববাহিত রথের সারথি অনূরু বা অরুণ। পুরাণ মতে অনূরু কশ্যপ ও বিনতার পুত্র, গড়ুরের জ্যেষ্ঠ। প্রসূত ডিম্ব দীর্ঘদিন বিদীর্ণ না হওয়ায় বিনতা অকালে তা বিদীর্ণ করেন। অর্ধপুষ্ট অরুণ ঊরুহীন হওয়ায় তাঁর নাম অনূরু। নারদের নির্দেশে অরুণ শিবকে সন্তুষ্ট করে সূর্যরথের সারথ্য লাভ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সূর্যরথের সাতটি ঘোড়া সংস্কৃত সাত ছন্দের নামে---গায়ত্রী, বৃহতি, উষ্ণিক, জগতি, ত্রিষ্টুপ, অনুষ্টুপ এবং পঙ্ক্তি।
তাঁর সূর্য ঠাকুরের পুজো কী ভাবে করান জানতে চাওয়ায় শিবানী রায়ের প্রথম উত্তর ছিল, আমার নিজেরই খাওয়া জোটে না তো ঠাকুরকে কী খাওয়াবো! ঠাকুর পেয়ে প্রথমবার ব্রাহ্মণ ডেকে হোম করিয়ে সবাইকে খিচুড়ি প্রসাদ খাওয়ান। আর পেরে ওঠেন না। নিত্যদিন জল-বাতাসাও দেওয়া হয়ে ওঠে না তাঁর। মূর্তি দেখতে আসে মানুষজনের কেউ কেউ মালিকানাহীন মন্দিরটি সারিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে তা হয়নি। প্রতিবেশীদের কাছে সাহায্য চেয়েও বিফল হয়েছেন শিবানী রায়। পরিবারের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে মূর্তি নিয়ে নেবার লোভ দেখাচ্ছেন। দোটানায় পড়ে যাচ্ছেন শিবানীদেবী। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় বা স্থানীয় প্রশাসন এগিয়ে এলে রক্ষা পায় আগলহীন মন্দিরে একেবারেই অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকা সূর্যমূর্তিটি।
murtir chhobiti dile valo lagto aro
ReplyDeleteপাইনি
DeleteThanks dada for so much information.
ReplyDeletewelcome .
DeleteThanxs Indra da.
ReplyDeletewelcome.
Delete