কৃষ্ণ ও অর্জুনের নির্দেশে ঘটোৎকচ যখন কর্ণকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার দিকে ছুটে যান, তখন ছিল মধ্যরাত। এই সময়ে রাক্ষসদের ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী থাকে এবং এজন্যই কৃষ্ণ এই সময়টায় কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ঘটোৎকচকে প্রেরণ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ভগদত্ত ও অশ্বত্থামা দ্বৈরথ যুদ্ধে ঘটোৎকচকে পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু ভগদত্ত ঘটোৎকচকে পরাজিত করেছিলেন পরিপূর্ণ দিনের আলোয়, যখন রাক্ষসদের শক্তিমত্তা থাকে তুলনামূলকভাবে কম এবং অশ্বত্থামা ঘটোৎকচকে পরাজিত করেছিলেন রাতের প্রথম প্রহরে, যখন রাক্ষসদের শক্তিমত্তা বৃদ্ধি পায় বটে, কিন্তু শীর্ষে থাকে না। অন্যদিকে, ঘটোৎকচ যখন কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হন, তখন ছিল মধ্যরাত এবং ঘটোৎকচ ছিলেন তার শক্তির শীর্ষে।
উল্লেখ্য, ঘটোৎকচ দিনের বেলায় যে কম ভয়ঙ্কর যোদ্ধা ছিলেন, এমনটি মোটেই নয়। দিনে সংঘটিত যুদ্ধে তিনি দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামা, ভুরিশ্রবা, শল্য ও দুর্যোধনের মতো শীর্ষ কৌরব যোদ্ধাদেরকে পরাজিত করেছেন এবং স্বয়ং ভীষ্মও ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এড়িয়ে গেছেন। কৌরব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধাদের মধ্যে (কর্ণ ব্যতীত) একমাত্র ভগদত্ত ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে অপরাজিত ছিলেন, কারণ তিনি নিজেও ছিলেন অসুর নরকের ছেলে এবং অত্যন্ত শক্তিশালী একজন যোদ্ধা। যুদ্ধের চতুর্দশ রাতের প্রথম প্রহরে অশ্বত্থামা ঘটোৎকচকে একবার পরাজিত করতে সক্ষম হন, কিন্তু ইতিপূর্বে তিনি দিনের বেলায় ঘটোৎকচের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। সুতরাং সামগ্রিকভাবে, মধ্যরাতের যুদ্ধে ঘটোৎকচকে পরাজিত করা ছিল অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার।একটি সুবৃহৎ রথে চড়ে ঘটোৎকচ কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। রথটি বিভিন্ন ধরনের বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল, রথটির আটটি চাকা ছিল (কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ব্যবহৃত সিংহভাগ রথের চাকা ছিল দুইটি) এবং রথটির সঙ্গে চারটি অতিকায় হাতির সমআকৃতির হিংস্র ঘোড়া সংযুক্ত ছিল। হিংস্র চেহারার এক রাক্ষস ছিল ঘটোৎকচের রথের সারথি। বৃহদাকৃতির একটি ধনুক হাতে নিয়ে এবং চতুর্দিকে অত্যন্ত বড় আকৃতির বিপুল সংখ্যক তীর নিক্ষেপ করতে করতে ঘটোৎকচ কর্ণের দিকে অগ্রসর হন। ঘটোৎকচের ভয়াল রূপ দেখে কৌরব সৈন্যরা অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কিন্তু কর্ণ তার রথে চড়ে ঘটোৎকচের দিকে অগ্রসর হন এবং ঘটোৎকচের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।
কর্ণ ও ঘটোৎকচ সজোরে একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন এবং একে অপরের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন। কর্ণ ঘটোৎকচের দিকে সাধারণ তীর নিক্ষেপ করছিলেন, কিন্তু ঘটোৎকচ কর্ণের দিকে অত্যন্ত বড় আকৃতির তীর নিক্ষেপ করছিলেন। তারা একে অপরকে বারবার তীরবিদ্ধ করতে থাকেন এবং একে অপরকে তীরের সাহায্যে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন। কর্ণ ও ঘটোৎকচের শরীরের বিভিন্ন অংশ তাদের একে অপরের তীরে গভীরভাবে বিদ্ধ হয় এবং তাদের দুইজনের শরীর থেকেই রক্ত ঝরতে শুরু করে। কিন্তু উভয়েই অটল থেকে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। ঘটোৎকচের ধনুকের সুতীব্র টঙ্কার শুনে কৌরব ও পাণ্ডব উভয় পক্ষের সৈন্যরাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে কর্ণ ও ঘটোৎকচের মধ্যে সমানে সমানে যুদ্ধ চলে এবং তাদের কেউই অপর জনকে পরাজিত করতে পারছিলেন না। এমতাবস্থায় কর্ণ মন্ত্র উচ্চারণ করে ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে একটি দিব্যাস্ত্রকে আহ্বান করেন এবং সেটিকে ঘটোৎকচের দিকে তাক করেন। এটি দেখে ঘটোৎকচ একটি ভয়ঙ্কর ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করেন। সেটির ফলে তার চতুর্দিকে একটি সুবৃহৎ রাক্ষস সৈন্যদলের আবির্ভাব ঘটে এবং উক্ত ভয়ালদর্শন রাক্ষসরা অস্ত্র হিসেবে গদা, বর্শা, বড় পাথর ও পর্বতশৃঙ্গ বহন করছিল। ঘটোৎকচ কর্তৃক প্রয়োগকৃত ইন্দ্রজালের ফলে একটি ভয়ঙ্কর অস্ত্রের সৃষ্টি হয় এবং ঘটোৎকচ সেটি হাতে নিয়ে তীব্র গর্জন করতে করতে কর্ণের দিকে ছুটে যান। ঘটোৎকচের গর্জন শুনে কৌরব ও পাণ্ডব সৈন্যরা ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ঘটোৎকচ কর্তৃক সৃষ্ট রাক্ষস সৈন্যরা কৌরব সৈন্যদের ওপর অসংখ্য বড় বড় পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে এবং ঘটোৎকচের সৃষ্ট ইন্দ্রজালের ফলে আকাশ থেকে বিপুল সংখ্যক লোহার তৈরি রথের চাকা, অগ্নিগোলক, বিশেষ ধরনের তীর, বর্শা, বল্লম, শতঘ্নী, কুঠার প্রভৃতি অস্ত্র কৌরব সৈন্যদের ওপর পতিত হতে থাকে। এর ফলে কৌরব বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়।
ঘটোৎকচ ও তার রাক্ষস সৈন্যদলের তাণ্ডব দেখে আতঙ্কিত হয়ে কৌরব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন ও তার ভাইয়েরা, কৌরব বাহিনীর সকল রাজরাজড়া এবং সকল শীর্ষ যোদ্ধা পশ্চাৎপসরণ করেন। সেসময় কর্ণ ছিলেন একমাত্র কৌরব যোদ্ধা, যিনি যেখানে ছিলেন সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন। তিনি তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘটোৎকচ কর্তৃক সৃষ্ট রাক্ষস সৈন্যদলকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেন এবং ঘটোৎকচ কর্তৃক প্রয়োগকৃত ইন্দ্রজালকে ধ্বংস করে দেন। এর ফলে কৌরব সৈন্যদের ওপর ঘটোৎকচের সৃষ্ট অস্ত্রবৃষ্টি বন্ধ হয়। ঘটোৎকচ ক্ষিপ্ত হয়ে কর্ণের দিকে বিপুল সংখ্যক তীর নিক্ষেপ করেন এবং সেগুলো কর্ণের শরীর ভেদ করে বেরিয়ে মাটিতে গেঁথে যায়। কর্ণের শরীর থেকে রক্তস্রোত ঝরতে থাকে।
কর্ণ ঘটোৎকচের দিকে ১০টি তীর নিক্ষেপ করেন এবং সেগুলো ঘটোৎকচের শরীরের স্পর্শকাতর অংশগুলোয় আঘাত করে, যার ফলে ঘটোৎকচ তীব্র ব্যথা অনুভব করেন। ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি একটি বিশালাকৃতির রথের চাকা উঠিয়ে নেন এবং সেটিকে সজোরে কর্ণের দিকে নিক্ষেপ করেন। উক্ত চাকাটি ছিল দৈব ক্ষমতাসম্পন্ন, কিন্তু কর্ণের তীরের আঘাতে সেটি টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। ক্রুদ্ধ ঘটোৎকচ কর্ণের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং ঘটোৎকচ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরগুলো কর্ণের রথকে ঢেকে ফেলে। কর্ণ তীরের সাহায্যে ঘটোৎকচ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং ঘটোৎকচের রথের দিকে বিপুল সংখ্যক তীর নিক্ষেপ করেন, যার ফলে ঘটোৎকচের রথ কর্ণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরে ঢাকা পড়ে যায়। এরপর ঘটোৎকচ একটি গদা উঠিয়ে সেটিকে সজোরে কর্ণের দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণের তীরের আঘাতে সেটি টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে যায়।
ঘটোৎকচ তার রথ থেকে শূণ্যে ভেসে ওঠেন এবং তীব্র গর্জন করে কর্ণের বিরুদ্ধে আরেকটি ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করেন। ঘটোৎকচের প্রয়োগকৃত ইন্দ্রজালের ফলে কর্ণের ওপর আকাশ থেকে বিপুল সংখ্যক গাছ পতিত হতে থাকে। কর্ণ তীরের সাহায্যে ঘটোৎকচ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত গাছগুলোকে কেটে ফেলেন এবং ঘটোৎকচকে আকাশে ভেসে থাকা অবস্থাতেই ব্যাপকভাবে তীরবিদ্ধ করেন। এরপর কর্ণের তীরের আঘাতে ঘটোৎকচের রথের রাক্ষস সারথি ও রথটির সঙ্গে যুক্ত অতিকায় ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং কর্ণ তীরের সাহায্যে ঘটোৎকচের সুবৃহৎ রথটিকে টুকরো টুকরো করে ফেলেন। ঘটোৎকচের রথটিকে ধ্বংস করার পর কর্ণ মন্ত্র উচ্চারণ করে ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে একটি দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং এর ফলে ঘটোৎকচ এমনভাবে তীরবিদ্ধ হন যে, তার শরীরের এমন কোনো স্থান ছিল না যেখানে তীর বিদ্ধ হয়নি। কর্ণের তীরে ঘটোৎকচ এমনভাবে ঢাকা পড়ে যান যে, আকাশে তাকে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না।
এমতাবস্থায় ঘটোৎকচ একটি শক্তিশালী ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করে কর্ণ কর্তৃক প্রয়োগকৃত দিব্যাস্ত্রটিকে ধ্বংস করেন এবং তার প্রয়োগকৃত আরেকটি ইন্দ্রজালের ফলে কর্ণের ওপর আকাশ থেকে বিপুল সংখ্যক তীর পতিত হতে থাকে। কর্ণ তীরের সাহায্যে ঘটোৎকচ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। এরপর ঘটোৎকচ আকাশে ভেসে থাকা অবস্থায় একটি অতি ভয়াল রূপ ধারণ করেন এবং তার শরীরে অনেকগুলো ভয়ালদর্শন মাথাকে যুক্ত অবস্থায় দেখা যায়। এই দৃশ্য কৌরব সৈন্যদেরকে আতঙ্কিত করে। কর্ণ মন্ত্র উচ্চারণ করে ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করতে থাকেন, কিন্তু ঘটোৎকচের প্রয়োগকৃত ইন্দ্রজালের ফলে সৃষ্ট মাথাগুলো কর্ণ কর্তৃক প্রয়োগকৃত দিব্যাস্ত্রগুলোকে ভক্ষণ করতে শুরু করে।
কর্ণ ঘটোৎকচের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তাকে ক্ষতবিক্ষত করেন। কর্ণের তীরবৃষ্টিতে ঘটোৎকচ কর্তৃক প্রয়োগকৃত ইন্দ্রজালটি ধ্বংস হয় এবং কৌরব সৈন্যরা দেখতে পায় যে, ঘটোৎকচের বিশাল দেহ অসংখ্য ক্ষত সমেত মাটিতে অনড় অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এটি দেখে কৌরব সৈন্যরা মনে করে যে, ঘটোৎকচ নিহত হয়েছেন এবং এজন্য তারা উল্লসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু শীঘ্রই ঘটোৎকচ নতুন নতুন রূপ ধারণ করে চতুর্দিকে ঘুরতে থাকেন। একবার তিনি অতিকায় আকার ধারণ করেন এবং তার ১০০টি মাথা ও ১০০টি শরীর দেখতে পাওয়া যায়। একবার তিনি হাতের আঙুলের সমান ক্ষুদ্র রূপ ধারণ করে চতুর্দিকে ছুটে বেড়ান। একবার তিনি ভূগর্ভের ভিতরে ঢুকে পড়েন এবং সেখান থেকে বেরিয়ে এসে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন। একেক মুহূর্তে তাকে একেক স্থানে দেখতে পাওয়া যায়। এরপর দেখা যায় যে, তিনি আকাশ থেকে নেমে তার ইন্দ্রজালের সাহায্যে সৃষ্ট একটি রথে চড়ে কর্ণের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন।
কর্ণের কাছাকাছি অগ্রসর হয়ে তিনি কর্ণকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “সুতপুত্র! একটু অপেক্ষা করো! আজকে তুমি আমার কাছ থেকে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারবে না। আজ আমি তোমার যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা মিটিয়ে দেবো!” এই বলে ঘটোৎকচ আবার শূণ্যে আরোহণ করেন এবং অট্টহাসি করে ওঠেন। সেখান থেকে তিনি কর্ণের বিরুদ্ধে আরেকটি ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করেন এবং এর ফলে কর্ণের ওপর আকাশ থেকে তীব্র তীরবৃষ্টি পতিত হয়। সেই তীরগুলোর প্রতিটি ছিল রথের অক্ষের সমান লম্বা। কর্ণ তার রথটিকে একটু পিছিয়ে নিয়ে তীরের সাহায্যে দূর থেকে ঘটোৎকচ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং ঘটোৎকচ কর্তৃক প্রয়োগকৃত ইন্দ্রজালটিকে ধ্বংস করেন। এটি দেখে ঘটোৎকচ ইন্দ্রজালের সাহায্যে অদৃশ্য হয়ে যান।
এরপর ঘটোৎকচ ইন্দ্রজালের সাহায্যে একটি উঁচু পর্বতের রূপ ধারণ করেন, যেটির অনেকগুলো চূড়া ছিল এবং যেটিতে প্রচুর লম্বা গাছ ছিল। উক্ত পর্বত থেকে কর্ণের ওপর বিপুল সংখ্যক গদা, তলোয়ার, বর্শা ও বল্লম বের হয়ে পতিত হতে থাকে। কর্ণ মন্ত্র উচ্চারণ করে উক্ত ইন্দ্রজালের বিরুদ্ধে একটি দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং উক্ত দিব্যাস্ত্রের আঘাতে ঘটোৎকচ কর্তৃক সৃষ্ট উঁচু পর্বতটি ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর ঘটোৎকচ ইন্দ্রজালের সাহায্যে নীল মেঘের রূপ ধারণ করেন, যেটিতে একটি রংধনু দেখা যাচ্ছিল। উক্ত মেঘ থেকে কর্ণের ওপর বিপুল সংখ্যক পাথর ও বিশেষ ধরনের তীর পতিত হতে থাকে। কর্ণ মন্ত্র উচ্চারণ করে উক্ত ইন্দ্রজালের বিরুদ্ধে বায়ব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং এর ফলে উক্ত মেঘটি বিলীন হয়ে যায়। ঘটোৎকচ দৃশ্যমান হয়ে ইন্দ্রজালের সাহায্যে একটি ভয়ঙ্কর অস্ত্র সৃষ্টি করে সেটিকে কর্ণের দিকে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হন, কিন্তু কর্ণ চতুর্দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তীরের সাহায্যে ঘটোৎকচের হাতে থাকা অস্ত্রটিকে ধ্বংস করেন।
ঘটোৎকচ অট্টহাসি করে আরেকটি ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করেন এবং এরপর দেখা যায় যে, ঘটোৎকচের নেতৃত্বে একটি বিশাল রাক্ষস সৈন্যদল কর্ণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। উক্ত রাক্ষসগুলোর একদল ঘোড়ায় চড়ে, একদল হাতির পিঠে চেপে ও একদল রথে চড়ে অগ্রসর হচ্ছিল এবং তারা বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ছিল। এটি দেখে কর্ণ ঘটোৎকচের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ঘটোৎকচ ইন্দ্রজালের সাহায্যে কর্ণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং ঘটোৎকচ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত ৫টি তীর কর্ণকে বিদ্ধ করে। কর্ণ আবার ঘটোৎকচের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ঘটোৎকচ মন্ত্র উচ্চারণ করে কর্ণের বিরুদ্ধে অঞ্জলিকাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং উক্ত অস্ত্রের আঘাতে কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে ও কর্ণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যায়।
কর্ণ আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ঘটোৎকচ কর্তৃক সৃষ্ট রাক্ষস সৈন্যদলটিকে আক্রমণ করেন এবং তাদের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। কর্ণের তীরে উক্ত রাক্ষসগুলো এবং তাদের সমস্ত রথ, হাতি ও ঘোড়া নিহত হয়। কর্ণের হাতে ঘটোৎকচ কর্তৃক সৃষ্ট রাক্ষস সৈন্যদল ধ্বংস হওয়ার পর ক্রুদ্ধ ঘটোৎকচ তার ইন্দ্রজালের সাহায্যে আরেকটি সুবৃহৎ রথ সৃষ্টি করেন। রথটির সঙ্গে অতিকায় হাতির সমআকৃতির চারটি গাধা সংযুক্ত ছিল, যেগুলোর মুখের আকৃতি ছিল পিশাচদের মতো, এবং ভয়ালদর্শন এক রাক্ষস ছিল উক্ত রথটির সারথি। সেই রথে আরোহণ করে ঘটোৎকচ রথটির সারথিকে আদেশ করেন, “আমাকে সুতপুত্রের দিকে নিয়ে চলো!” কর্ণের দিকে অগ্রসর হয়ে ঘটোৎকচ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।
ঘটোৎকচ মন্ত্র উচ্চারণ করে একটি দৈব অশনি (বিশালাকৃতির এক ধরনের অস্ত্র যেটির সঙ্গে আটটি চাকা সংযুক্ত থাকে) উঠিয়ে নেন। এই অস্ত্রটি ছিল স্বয়ং শিবের তৈরি। উক্ত অশনি উঠিয়ে ঘটোৎকচ সেটিকে সজোরে কর্ণের দিকে নিক্ষেপ করেন। কর্ণ ক্ষিপ্রগতিতে তার ধনুক নামিয়ে রেখে তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং তার দিকে তীব্রবেগে ছুটে আসা অশনিটি ধরে ফেলে সেটিকে ঘুরিয়ে ঘটোৎকচের দিকে নিক্ষেপ করেন। এটি দেখে ঘটোৎকচ ক্ষিপ্রগতিতে তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে আত্মরক্ষা করেন এবং উক্ত অশনির আঘাতে ঘটোৎকচের রথটি সেটির রাক্ষস সারথি ও সেটির সঙ্গে যুক্ত পিশাচমুখী অতিকায় গাধাগুলোসহ ভস্মে পরিণত হয়। এভাবে ঘটোৎকচের রথটিকে ধ্বংস করে উক্ত অশনিটি ভূগর্ভে প্রবেশ করে। এটি দেখে কৌরব ও পাণ্ডব উভয় পক্ষের সৈন্যরা কর্ণের প্রশংসা করে এবং কর্ণ ক্ষিপ্রগতিতে তার রথে আরোহণ করে পুনরায় তার ধনুক উঠিয়ে নেন।
এরপর কর্ণ মন্ত্র উচ্চারণ করে ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে একটি দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং এর ফলে কর্ণের ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত অসংখ্য তীর ঘটোৎকচকে সজোরে বিদ্ধ করে। এমতাবস্থায় ঘটোৎকচ আবার অদৃশ্য হয়ে যান এবং অদৃশ্য অবস্থায় একটি ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করে কর্ণ কর্তৃক প্রয়োগকৃত দিব্যাস্ত্রটিকে ধ্বংস করেন। কিন্তু কর্ণ অদৃশ্য ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে শব্দভেদী তীর নিক্ষেপ করে তাকে বিদ্ধ করতে থাকেন। ঘটোৎকচ আরেকটি ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করেন এবং সেটির ফলে চতুর্দিকে বহুসংখ্যক ঘটোৎকচকে দেখতে পাওয়া যায়। এভাবে ঘটোৎকচ কৌরব বাহিনীকে আতঙ্কিত করতে থাকেন। কর্ণ চতুর্দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং ঘটোৎকচের সবগুলো রূপকে তীরবিদ্ধ করে তার প্রয়োগকৃত ইন্দ্রজালকে ধ্বংস করেন।
এরপর ঘটোৎকচ আবার অদৃশ্য হয়ে যান এবং কর্ণের বিরুদ্ধে আরেকটি ভয়ঙ্কর ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করেন। ঘটোৎকচ কর্তৃক প্রয়োগকৃত ইন্দ্রজালের ফলে চতুর্দিক থেকে অসংখ্য ভয়ালদর্শন রাক্ষস, পিশাচ, যাতুধান (এক ধরনের অসুর), সিংহ, বাঘ, হায়েনা, নেকড়ে, চিতা, আগুনে জিহ্বাবিশিষ্ট সাপ এবং লোহার ঠোঁটযুক্ত বড় পাখি কর্ণকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে তার দিকে ছুটে আসে। কর্ণ চতুর্দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তার তীরের আঘাতে বর্ণিত হিংস্র প্রাণিগুলোর প্রত্যেকটি নিহত হয়। এরপর কর্ণ মন্ত্র উচ্চারণ করে ঘটোৎকচ কর্তৃক প্রয়োগকৃত ইন্দ্রজালের বিরুদ্ধে একটি দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং সেটির আঘাতে উক্ত ইন্দ্রজাল ধ্বংস হয়ে যায়।ঘটোৎকচ আবার দৃশ্যমান হন এবং ইন্দ্রজালের সাহায্যে আরেকটি সুবৃহৎ রথ সৃষ্টি করে সেটিতে আরোহণ করেন। রথটির সঙ্গে চারটি অতিকায় ঘোড়া যুক্ত ছিল এবং একটি রাক্ষস ছিল রথটির সারথি। এই রথটিতে চড়ে ঘটোৎকচ কর্ণের দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু কর্ণের তীরের আঘাতে ঘটোৎকচের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয়। ক্রুদ্ধ ঘটোৎকচ কর্ণকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমি এখনই তোমাকে ধ্বংস করবো!” এই বলে ঘটোৎকচ আবারো অদৃশ্য হয়ে যান।
যখন কর্ণ ও ঘটোৎকচের মধ্যে এরকমভাবে যুদ্ধ চলছিল, তখন রাক্ষস অলায়ুধ একটি সুবৃহৎ রাক্ষস সৈন্যদলসহ যুদ্ধক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হন। ইতিপূর্বে পাণ্ডব ভীমের হাতে অলায়ুধের রাক্ষস আত্মীয় বক ও কিরমির এবং বন্ধু হিড়িম্ব নিহত হয়েছিলেন। এজন্য অলায়ুধ পাণ্ডবদের ওপর অত্যন্ত ক্রোধান্বিত ছিলেন এবং এতদিন তিনি তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করছিলেন। কুরুক্ষেত্রে কর্ণ ও ঘটোৎকচের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে, এটি জানতে পেরে তিনি সসৈন্যে কুরুক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হন এবং দুর্যোধনের কাছে গিয়ে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। দুর্যোধন যথারীতি সোৎসাহে অলায়ুধকে সেই অনুমতি প্রদান করেন।
অলায়ুধ একটি সুবৃহৎ ও নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত রথে আরোহণ করে সসৈন্যে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হন। তার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ছিল অতিকায় আকৃতির এবং একটি হিংস্র চেহারার রাক্ষস ছিল সেটির সারথি। সেই রথে চড়ে অলায়ুধ ঘটোৎকচের দিকে অগ্রসর হন এবং অলায়ুধকে দেখতে পেয়ে ঘটোৎকচ কর্ণের সঙ্গে তার চলমান যুদ্ধ পরিত্যাগ করে অলায়ুধের দিকে ছুটে যান। ঘটোৎকচ অলায়ুধের দিকে অগ্রসর হওয়ার পর কর্ণ ভীমের দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু ভীম কর্ণকে এড়িয়ে একটি বৃহৎ সৈন্যদল নিয়ে অলায়ুধের দিকে ছুটে যান এবং অলায়ুধ রথ ঘুরিয়ে ভীমের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। বস্তুত পাণ্ডবদের পরিকল্পনা ছিল এরকম যে, ঘটোৎকচ কর্ণকে হত্যা করবেন। অলায়ুধের কারণে যেন ঘটোৎকচের উদ্দেশ্য পূরণে ব্যাঘাত না ঘটে, সেজন্য ভীম অলায়ুধের গতিরোধ করেন। এমতাবস্থায় কর্ণ ও ঘটোৎকচের মধ্যে আবার যুদ্ধ আরম্ভ হয়।
এদিকে ভীম ও অলায়ুধ পরস্পরকে সজোরে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। অলায়ুধের রাক্ষস সৈন্যরা ভীমের দিকে ছুটে আসে, কিন্তু ভীম তাদের সকলকে তীরবিদ্ধ করেন এবং ভীমের তীরে বিদ্ধ হয়ে তারা পশ্চাৎপসরণ করে। এটি দেখে অলায়ুধ ভীমের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং প্রত্যুত্তরে ভীম অলায়ুধের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অলায়ুধ ভীম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরগুলোকে হয় নিজস্ব তীরের সাহায্যে কেটে ফেলেন নয়তো রথ থেকে লাফিয়ে সেগুলোকে ধরে ফেলেন। ভীম তার ধনুক নামিয়ে রেখে একটি গদা উঠিয়ে নেন এবং সেটিকে সজোরে অলায়ুধের দিকে নিক্ষেপ করেন। অলায়ুধও তার ধনুক নামিয়ে রেখে একটি গদা উঠিয়ে নেন এবং সেটিকে ভীম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত গদাটির দিকে নিক্ষেপ করেন। ভীম ও অলায়ুধ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত গদা দুইটি পরস্পরকে তীব্র বেগে আঘাত করে মাটিতে পড়ে যায়।
এরপর ভীম ও অলায়ুধ আবার তাদের ধনুকদ্বয় উঠিয়ে একে অপরের ওপর তীরবর্ষণ করেন। ভীম অলায়ুধের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অলায়ুধ তীরের সাহায্যে ভীম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। এমতাবস্থায় অলায়ুধের রাক্ষস সৈন্যরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে ভীমের সৈন্যদলকে আক্রমণ করে। উক্ত রাক্ষসদের হাতে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য এবং তাদের হাতি ও ঘোড়া নিহত হয়। অলায়ুধের রাক্ষস সৈন্যদলের আক্রমণে ভীমের নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় কৃষ্ণের পরামর্শে ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, যুধমন্যু, উত্তমৌজ ও উপপাণ্ডবগণ কর্ণের বিরুদ্ধে, সাত্যকি, নকুল ও সহদেব অলায়ুধের রাক্ষস সৈন্যদলের বিরুদ্ধে এবং অর্জুন দ্রোণাচার্যের সৈন্যদলের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন।
এসময় অলায়ুধের তীরের আঘাতে ভীমের ধনুক কাটা পড়ে এবং ভীমের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয়। ভীম একটি গদা উঠিয়ে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং গদাটিকে অলায়ুধের দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অলায়ুধ ক্ষিপ্রগতিতে তার ধনুক নামিয়ে রেখে একটি গদা উঠিয়ে ভীম কর্তৃক নিক্ষিপ্ত গদাটিকে আঘাত করেন এবং সেটি মাটিতে পড়ে যায়। ভীম আরেকটি গদা উঠিয়ে নিয়ে অলায়ুধের দিকে ছুটে যান এবং অলায়ুধ গদা হাতে তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে ভীমের দিকে ছুটে যান। ভীম ও অলায়ুধের মধ্যে তীব্র গদাযুদ্ধ সংঘটিত হয়, কিন্তু গদাযুদ্ধে তাদের কেউ প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে পারেননি। এমতাবস্থায় তারা দুইজনই গদা নামিয়ে রেখে পরস্পরের বিরুদ্ধে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু মল্লযুদ্ধেও তাদের কেউ প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে পারেননি।
এরপর ভীম ও অলায়ুধ তাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা রথের চাকা, অক্ষ ও অন্যান্য অংশ এবং অন্য বিভিন্ন বস্তু উঠিয়ে নিয়ে একে অপরের দিকে নিক্ষেপ করতে থাকেন। এগুলোর আঘাতে তাদের উভয়ের শরীর থেকেই রক্ত ঝরতে থাকে। এই পর্যায়ে এসে অলায়ুধ ভীমকে প্রচণ্ড আক্রমণ করেন এবং ভীম নিশ্চিত পরাজয়ের সম্মুখীন হন। এই পরিস্থিতিতে কৃষ্ণ ঘটোৎকচকে ডেকে কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিত্যাগ করে অলায়ুধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য নির্দেশ দেন এবং ঘটোৎকচকে বলেন যে, তিনি পরবর্তীতে কর্ণকে হত্যা করতে পারবেন। কৃষ্ণের কথায় ঘটোৎকচ কর্ণের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ পরিত্যাগ করে অলায়ুধের দিকে অগ্রসর হন এবং তাকে আক্রমণ করেন। অলায়ুধ ভীমকে ছেড়ে ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।
অলায়ুধ ও ঘটোৎকচের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর কর্ণ ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, যুধমন্যু, উত্তমৌজ ও উপপাণ্ডবদের নেতৃত্বাধীন সুবৃহৎ পাণ্ডব বাহিনীকে আক্রমণ করেন এবং পাণ্ডব বাহিনীর বহুসংখ্যক রাজা ও বহুসংখ্যক শীর্ষ রথী কর্ণের নিকট পরাজিত হন। এদিকে সাত্যকি, নকুল ও সহদেবের তীরে অলায়ুধের রাক্ষস সৈন্যরা নিহত হয় এবং উক্ত রাক্ষস সৈন্যদলটিকে ধ্বংস করার পর তারা কর্ণের দিকে অগ্রসর হন। পাঞ্চালের বহুসংখ্যক শীর্ষ রথী দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হন।
অলায়ুধ–ঘটোৎকচ যুদ্ধ: দুই রাক্ষসের ভয়ঙ্কর দ্বৈরথ
অলায়ুধ ও ঘটোৎকচ রথে চড়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন। অলায়ুধ একটি বৃহদাকৃতির পরিঘা (লোহার কাঁটাযুক্ত ভারী গদা) উঠিয়ে সেটিকে সজোরে ঘটোৎকচের দিকে নিক্ষেপ করেন এবং সেটি তীব্রবেগে ছুটে গিয়ে ঘটোৎকচের মাথায় আঘাত করে। উক্ত পরিঘার আঘাতে ঘটোৎকচ সংজ্ঞাহীন হয়ে তার রথের ওপর বসে পড়েন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটোৎকচ সংজ্ঞা ফিরে পান এবং একটি ভারী গদা উঠিয়ে সেটিকে সজোরে অলায়ুধের দিকে নিক্ষেপ করেন। ঘটোৎকচ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত গদাটিকে তীব্রবেগে ছুটে আসতে দেখে অলায়ুধ ক্ষিপ্রগতিতে তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে আত্মরক্ষা করেন। উক্ত গদাটির আঘাতে অলায়ুধের রথের সারথি ও রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং অলায়ুধের রথটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
অলায়ুধ ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করতে শুরু করেন এবং তার প্রয়োগকৃত ইন্দ্রজালের ফলে ঘটোৎকচের ওপর আকাশ থেকে তীব্র রক্তধারা পতিত হয়। অলায়ুধ কর্তৃক প্রয়োগকৃত ইন্দ্রজালের ফলে সমগ্র আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে যায় এবং তীব্র বজ্রপাত শুরু হয়। এসব দেখে ঘটোৎকচ তার রথ থেকে শূণ্যে আরোহণ করেন এবং তার নিজস্ব ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করে অলায়ুধ কর্তৃক প্রয়োগকৃত ইন্দ্রজালটিকে ধ্বংস করেন। এরপর ঘটোৎকচ তার রথের ওপর নেমে আসেন। অলায়ুধ ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে আরেকটি ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করেন এবং এর ফলে ঘটোৎকচের ওপর আকাশ থেকে একটি তীব্র ও ভয়ঙ্কর পাথরবৃষ্টি পতিত হয়। ঘটোৎকচ তীরের সাহায্যে উক্ত পাথরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। এরপর অলায়ুধ ও ঘটোৎকচ ইন্দ্রজালের সাহায্যে পরস্পরের ওপর নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র, যেমন: পরিঘা, বল্লম, গদা, ক্ষুদ্র দণ্ড, অগ্নিগোলক, ত্রিশূল, তলোয়ার, বর্শা, লম্বা বর্শা, ঘণ্টা, বিভিন্ন ধরনের তীর, চক্র, কুঠার, লৌহগোলক এবং গরুর মাথার আকৃতির অস্ত্র বিপুল পরিমাণে নিক্ষেপ করেন।
তদুপরি, তারা দুইজন বিভিন্ন প্রজাতির গাছ উপড়ে ফেলে একে অপরের দিকে নিক্ষেপ করেন এবং পর্বতশৃঙ্গ ও নানাবিধ ধাতুর সাহায্যে একে অপরকে আঘাত করেন। কোনোভাবেই প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে না পেরে অলায়ুধ ও ঘটোৎকচ একে অপরের বিরুদ্ধে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হন। একে অপরের চুল আঁকড়ে ধরে তারা পরস্পরকে আঘাত করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ঘটোৎকচ অলায়ুধকে তুলে মাটিতে নিক্ষেপ করেন এবং ক্ষিপ্রগতিতে একটি তলোয়ারের সাহায্যে অলায়ুধের মাথা কেটে ফেলেন। এভাবে তীব্র যুদ্ধের পর ঘটোৎকচের হাতে অলায়ুধ নিহত হন।
অলায়ুধ নিহত হওয়ার পর পাণ্ডব সৈন্যরা অত্যন্ত উল্লসিত হয় এবং চতুর্দিকে তাদের শঙ্খধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। এরপর ঘটোৎকচ অলায়ুধের বিচ্ছিন্ন মাথাটি তুলে নিয়ে দুর্যোধনের রথের কাছে যান এবং সেটিকে দুর্যোধনের রথের ওপর ফেলে দেন। অলায়ুধ নিহত হওয়ার পর দুর্যোধন নিজের ও নিজের সৈন্যদের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। অলায়ুধ নিজে থেকে এসে কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন এবং ভীমকে হত্যা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বস্তুত অলায়ুধ ভীমকে প্রায় পরাজিত করে ফেলেছিলেন, কিন্তু ঘটোৎকচ তাদের যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করেন এবং অলায়ুধকে হত্যা করেন। অলায়ুধের মৃত্যুর পর দুর্যোধনের আশঙ্কা হতে থাকে যে, ভীম তাকে ও তার ভাইদেরকে হত্যা করার জন্য যে প্রতিজ্ঞা করেছেন, সেটি হয়ত সত্যি সত্যিই পূর্ণ হয়ে যাবে।
তথ্য সূত্র https://roar.media.com
প্রতিবেদন অসামান্য... ঘটোৎকচের উপর রীতিমত গবেষণা
ReplyDeleteধন্যবাদ
Delete