মহাবীর কর্ণ, দানবীর কর্ণ, ট্র্যাজিক হিরো কর্ণ। মহাভারতের অন্যতম প্রধান
চরিত্র কর্ণের এইসব পরিচয় তো আপনি নিশ্চয় জানেন? কিন্তু রাক্ষস কর্ণ? এর
কথা শুনেছেন কখনও? হ্যাঁ মহাভারত অনুযায়ী, কুন্তীর গর্ভে সূর্যপুত্র হিসেবে
জন্মানোর আগে পূর্বজন্মে রাক্ষস ছিলেন কর্ণ!
পূর্বজন্মে
মহা শক্তিধর এক রাক্ষস ছিলেন কর্ণ। নাম ছিল দাম্বোদভব। সূর্যের একনিষ্ঠ
ভক্ত ছিলেন তিনি। সূর্যের বরে এক হাজার কবচ লাভ করেছিলেন দাম্বোদভব। এই কবচ
ধ্বংস না করে দাম্বোদভবর প্রাণ নেওয়া সম্ভব ছিল না। কবচগুলির বিশেষত্ব ছিল
যে একবারে একটির বেশি কবচ ধ্বংস করা যাবে না। এক হাজার বছর ধরে পূজার্চনা
করেছে, একমাত্র এমন কেউ এই কবচ ধ্বংস করতে পারবে। একটি কবচ নষ্ট করার সঙ্গে
সঙ্গে ধ্বংসকারীর প্রাণ যাবে।
এই
কবচের জোরে গোটা পৃথিবীর ওপর আতঙ্ক ছড়িয়ে বেড়াত দাম্বোদভব। সে হয়ে
উঠেছিল অপরাজেয়। শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে দেখা হয় দুই ব্যক্তির। একজনের নাম
নর, অন্যজন নারায়ণ। দাম্বোদভব যেমন অশুভ শক্তির প্রতীক, এই দু-জন তেমনই
শুভশক্তির প্রতীক। এরা একজন একজন করে দাম্বোদভবর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে।
একজন যখন যুদ্ধ করে, অন্যজন তখন ঈশ্বরের আরাধনা করতে থাকে।
এক হাজার
বছর ধরে যুদ্ধ করে দাম্বোদভবর একটি করে কবচ ধ্বংস করতে পারে নর-নারায়ণ।
একটি কবচ ধ্বংস হলেই নর ও নারায়ণের মধ্যে যে যুদ্ধ করছিল, তার মৃত্যু হয়।
অন্যজন হাজার বছরের পূজার্চনার শক্তিতে তাকে বাঁচিয়ে দেয়। এবার সে যুদ্ধ
করতে শুরু করে, অন্যজন ঈশ্বর আরাধনায় মন দেয়। এই ভাবে ৯৯৯টি কবচ ধ্বংস হয়।
যখন আর মাত্র একটি কবচ অবশিষ্ট, তখন দাম্বোদভব ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়সে
গিয়ে সূর্যের কাছে আত্মগোপন করে। সূর্য নিজের একনিষ্ঠ ভক্তের অনুরোধ
ফেরাতে না পেরে তাকে কুন্তীর গর্ভে স্থাপন করেন। কর্ণরূপে জন্ম হয়
দাম্বোদভবর। অন্যদিকে নর-নারায়ণ অর্জুন রূপে কুন্তীর গর্ভেই জন্মলাভ করে।
এই ভাবে নিজেদের অমীমাংসিত যুদ্ধ সম্পূর্ণ করে দাম্বোদভব এবং নর-নারায়ণ
কিশোরী বয়সে কুন্তী একবার দুর্বাসা মুনিকে তাঁর অতিথি- আপ্যায়নে সন্তুষ্ট
করেছিলেন আর সমাদরের অভিজ্ঞান হিসেবে, তিনি কুন্তীকে একটা মন্ত্র দিয়ে
গিয়েছিলেন যেই মন্ত্রবলে কুন্তী নিজের ইচ্ছে মতন যেকোনো দেবতাকে ডাকতে
পারতেন। একদিন, তিনি এটা পরখ করে দেখতে চাইলেন। তিনি যেই বাইরে গেলেন,
দেখলেন অপরূপ মহিমায় সূর্য উদিত হচ্ছে আর তা দেখে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বলেন
যে, “আমি সূর্যদেবকে চাই।” সূর্যদেব আবির্ভূত হয়ে তাঁকে গর্ভবতী করেন ও
তিনি এক সন্তান প্রসব করেন।
চোদ্দ বছর বয়সী একজন অবিবাহিতা মা হওয়ার দরুন তাঁর
জানা ছিল না যে সামাজিক পরিস্থিতির মুখোমুখি কীভাবে হবেন। শিশুটাকে তিনি
একটা কাঠের বাক্সে রেখে তাকে নদীতে ভেসে যেতে দিলেন, এটা না জেনেই যে তার
পরিণতি কী হবে। এ নিয়ে তিনি নিজের সাথে লড়াই করেছিলেন কিন্তু কুন্তী ছিলেন
দৃঢ়সংকল্প এক নারী। উদ্দেশ্যটা একবার তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলেই, তিনি
যা কিছু করতে পারতেন। মনটা ছাড়া তাঁর সবকিছুই ছিল অমায়িক।
ধৃতরাষ্ট্রের প্রাসাদের এক সারথি অধিরথ, ঘটনাক্রমে যিনি নদীর তীরে
ছিলেন, তিনি এই অলংকৃত বাক্সটা লক্ষ্য করে সেটাকে তুলে নিয়ে খুলে দেখেন।
যখন তিনি ছোট্ট শিশুটাকে দেখেন, খুবই খুশি হন। উনি ছিলেন নিঃসন্তান আর এটা
তিনি তাঁকে দেওয়া ঈশ্বরের উপহার বলে মনে করলেন। তিনি বাক্সসমেত শিশুটাকে
তাঁর স্ত্রী রাধার কাছে নিয়ে গেলেন। দুজনেই তাঁরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে
গেলেন। বাক্সটার আদত দেখে তাঁরা বুঝেছিলেন যে এটা কোনো সাধারণ পরিবারের
হতেই পারে না, নিশ্চয় কোনো রাজা বা রানী এই শিশুটাকে পরিত্যাগ করেছেন।
তাঁরা জানতেন না যে কে তবে তাঁরা খুব খুশি ছিলেন যে তাঁরা এই শিশুটাকে
পেয়েছেন যে তাঁদের সন্তানহীন জীবন ভরিয়ে দিয়েছিল।
কর্ণ, যে নামে তিনি পরিচিত ছিলেন, তিনি ছিলেন একজন নিয়তির সন্তান, আর
তাও আবার, অসামান্য একজন। শিশু অবস্থায় ইতিমধ্যেই তাঁর কানে সোনার মাকড়ি
ছিল আর বক্ষদেশ ঘিরে ছিল একপ্রকার সহজাত বর্ম। তাঁকে বিস্ময়কর দেখাত। রাধা
তাঁকে পরম আদরে বড় করলেন। নিজে একজন সারথি হওয়ার দরুণ অধিরথ তাঁকে শেখাতে
চাইতেন যে রথ কীভাবে চালাতে হয়, কিন্তু কর্ণ তীরন্দাজ হওয়ার জন্য আকুল হয়ে
উঠেছিলেন। সেই সময়ে ক্ষত্রিয় ও যোদ্ধা শ্রেণীভুক্ত লোকেরাই কেবল যুদ্ধের
শিল্প তথা মার্শাল আর্ট ও অস্ত্রশস্ত্রের প্রশিক্ষণ লাভ করতে পারত। রাজার
ক্ষমতা রক্ষা করার এটাই ছিল একটা সহজ উপায়। অস্ত্র কী করে ব্যবহার করতে হয়
তা যদি সবাই শিখে যায়, তাহলে অস্ত্র ব্যবহারে আর কোনো লাগাম থাকবে না।
ক্ষত্রিয় না হওয়ায়, কর্ণকে কোনো আচার্যই স্বীকার করলেন না।
দ্রোণ ফিরিয়ে দিলেন
সেসময়ে, পরশুরাম ছিলেন দেশের সবচেয়ে দক্ষ যোদ্ধাদের মধ্যে একজন। তিনি
দ্রোণের প্রশিক্ষকও ছিলেন। দ্রোণের হাতে নিজের অস্ত্র তুলে দেওয়ার আগে,
পরশুরাম একটা শর্ত রেখেছিলেন যে দ্রোণ যেন কখনোই কোনো ক্ষত্রিয়কে এইসব
শক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্রের বিষয়ে কিছু না শেখান। দ্রোণ তাঁকে এই প্রতিশ্রুতি
দেন কিন্তু সোজা হস্তিনাপুরে গিয়ে এই অস্ত্রগুলো কী করে ব্যবহার করতে হয়
তা ক্ষত্রিয়দের শেখানোর জন্য রাজার কাছে কর্মসংস্থানের খোঁজ করেন। তিনি
এরকমই ছিলেন – একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ; নিয়মাবদ্ধ কিন্তু বিবেকহীন। তিনি
সব ধর্ম, শাস্ত্র, নিয়ম ও ধর্মগ্রন্থ জানতেন কিন্তু তাঁর একেবারেই কোনো
সঙ্কোচ ছিল না। একজন মহান শিক্ষক কিন্তু এক কুটিল ও লোভী মানুষ।
দ্রোণাচার্যের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ শুরু হল আর এর সাথে সাথে পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হল শুরু।
দ্রোণ হস্তিনাপুরে আসার আগে, পাণ্ডব ও কৌরব উভয় পক্ষকেই যুদ্ধের শিল্প
তথা মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন কৃপাচার্য। একদিন, ছেলেরা বল
খেলছিল। সেকালে বলগুলো রবার,চামড়া বা প্লাস্টিকের তৈরি হত না – সেগুলো
সাধারণত আগাছার তৈরি হত যা খুব কষে বাঁধা থাকত। ঘটনাক্রমে বলটা একটা কুয়োর
মধ্যে পড়ে যায়। তারা বলটাকে কুয়োর মধ্যে ভেসে থাকতে দেখে কিন্তু কারোর কোনো
ধারণা ছিল না যে কীভাবে এটাকে তুলে আনা যায় কারণ কুয়োটা ছিল গভীর আর তাতে
কোনো সিঁড়িও ছিল না।
দ্রোণ হাজির হয়ে পরিস্থিতি দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা বুঝি ক্ষত্রিয়
নও?” তারা বলে, “হ্যাঁ, আমরা ক্ষত্রিয়।” “তাহলে তোমাদের মধ্যে কি কেউ
ধনুর্বিদ্যা জানে না?" অর্জুন বলে, “হ্যাঁ, আমি একজন তীরন্দাজ আর আমি
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ হতে চাই।” দ্রোণ তাকে মেপে নিয়ে বললেন, “তুমি
যদি একজন তীরন্দাজ হয়েই থাক, তাহলে এই বলটাকে তুলতে পারছ না কেন?” তারা
জিজ্ঞাসা করে, “ধনুর্বিদ্যা কাজে লাগিয়ে একটা বলকে কী করে আমরা কুয়ো থেকে
তুলে আনতে পারি?” জবাবে তিনি বলেন, “আমি তোমাদের দেখাব।”
তিনি ঘাসের শক্ত একটা ফলক নিয়ে বলটার দিকে সবেগে নিক্ষেপ করলেন। এটা
বলটায় গিয়ে বিঁধে গেল আর তিনি পরপর কয়েকটা ঘাসের ফলক একটার ওপর আরেকটা
নিক্ষেপ করতে লাগলেন যাতে এগুলো একটা ছড়ির মতন তৈরি করে যেটা দিয়ে তিনি
বলটাকে তুলে আনতে পারবেন। তাঁর কলাকৌশল দেখে ছেলেরা অবাক হয়ে গেল – এটা
প্রায় যাদুর মতনই মনে হল। তিনি কীভাবে এটা করলেন সেটা তারা তাদের শেখাতে
বলল। দ্রোণ বললেন যদি না তারা তাঁকে তাঁদের গুরু বলে গ্রহণ করে, তিনি
শেখাবেন না। ছেলেরা তাঁকে ভীষ্মের কাছে নিয়ে গেল। ভীষ্ম তৎক্ষণাৎই দ্রোণকে
চিনতে পারলেন – ভীষ্ম জানতেন দ্রোণ কে ও তিনি তাঁর পারদর্শিতার প্রশংসা
করলেন। তিনি তাঁকে রাজগুরু হিসেবে নিযুক্ত করলেন। রাজগুরু হলেন ভবিষ্যতের
রাজাদের শিক্ষাদাতা।
দ্রোণাচার্যের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ শুরু হল আর এর সাথে সাথে পাণ্ডব ও
কৌরবদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হল শুরু। কয়েক বছর প্রশিক্ষণের পর, তাঁরা সবাই
মহান যোদ্ধা হয়ে ওঠার জন্য বেড়ে উঠলেন। বর্শা বা বল্লমে, যুধিষ্ঠির ছিলেন
সেরা। গদায়, ভীম আর দূর্যোধন ছিলেন সমান সমান। তাঁরা নিজেদের মধ্যে লড়তে
লড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন তাও কেউ কাউকে হারাতে পারতেন না। ধনুর্বিদ্যার
প্রসঙ্গ এলে, অর্জুন অদ্বিতীয়। তরবারি চালনা ও অশ্বারোহণে, নকুল ও সহদেব
আধিপত্য করতেন।
সূতপুত্রের ছলনা
একজন মহান ধনুর্বিদ হওয়ার আকাঙ্খায়, কর্ণ দ্রোণের কাছে গেলেন কিন্তু
দ্রোণ সূতপুত্র সম্বোধন করে তাঁকে ফিরিয়ে দিলেন। সূতপুত্রের আক্ষরিক অর্থ
হল "একজন সারথির পুত্র"। দ্রোণ পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি
নিচু-জাতের। এই অপমান কর্ণকে কুরে কুরে খেল। তিনি যে নিত্য বৈষম্য ও
অপমানের সম্মুখীন হতেন তা একজন ভীষণ সৎ ও অবিচল মানুষকে অত্যন্ত হীনচেতা
মানুষে পরিণত করেছিল। প্রতিবার যেই তিনি শুনতেন কেউ তাঁকে সূতপুত্র বলে
ডাকছে, তাঁর নীচতা বেড়ে গিয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছত যা তাঁর স্বাভাবিক
প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য ছিল না। দ্রোণ যেহেতু তাঁকে ক্ষত্রিয় না হওয়ার জন্য
প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কর্ণ মনস্থির করেন যে তিনি পরশুরামের কাছে যাবেন
যিনি ছিলেন যুদ্ধের শিল্প তথা মার্শাল আর্টের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষক।
সেকালে, শুধুমাত্র হাতাহাতি দ্বন্দ্বযুদ্ধই নয় বরং সব ধরণের
অস্ত্রশিক্ষাও যুদ্ধের শিল্প তথা মার্শাল আর্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেখানে
বিশেষ জোর দেওয়া হত ধনুর্বিদ্যার ওপর। কর্ণ জানতেন যে পরশুরাম কেবল
ব্রাহ্মণদেরই তাঁর শিষ্যরূপে গ্রহণ করবেন। শেখার অধীরতায়, তিনি একটা নকল
পৈতে জড়িয়ে পরশুরামের কাছে গিয়ে ব্রাহ্মণ হওয়ার ভান করলেন। পরশুরাম তাঁকে
শিষ্যরূপে গ্রহণ করে তিনি যা যা জানেন তার সব শেখালেন। কর্ণ অত্যন্ত দ্রুত
শিখে গেলেন। অন্য কোনো শিষ্যের এইরকম সহজাত দক্ষতা বা পারদর্শিতা ছিল না।
পরশুরাম তাঁর প্রতি অতিশয় সন্তুষ্ট ছিলেন।
তখন এরই মধ্যে পরশুরামের বয়স হয়েছিল। একদিন, যখন তাঁরা বনের মধ্যে
প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন, পরশুরাম খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে মূর্ছা যান। তিনি কর্ণকে
বলেন যে তাঁর শুয়ে পড়া প্রয়োজন। কর্ণ বসে পড়েন কেননা পরশুরাম যাতে তাঁর
কোলে মাথা দিতে পারেন ও পরশুরাম তন্দ্রা যান। একটা রক্তচোষা পোকা কর্ণের
কোলে ধীরে ধীরে বেয়ে উঠে তাঁর ঊরু থেকে রক্ত চুষতে শুরু করে। তাঁর ভীষণ
যন্ত্রণা হয় ও রক্ত বেরোতে থাকে কিন্তু তিনি তাঁর গুরুর ঘুমে ব্যাঘাত না
ঘটিয়ে পোকাটাকে সরিয়ে ফেলতে পারছিলেন না আর গুরুর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে তিনি
চাইছিলেন না। ধীরে ধীরে রক্ত পরশুরামের কান অবধি পৌঁছতে শুরু করে আর এই
অনুভূতিটাই তাঁকে জাগিয়ে দেয়। তিনি চোখ খুলে দেখেন যে কর্ণ পুরো রক্তে
রক্ত। “এটা কার রক্ত?” তিনি জিজ্ঞাসা করেন। কর্ণ বলেন, “আমার।”
পরশুরাম তখন কর্ণের ঊরুতে উন্মুক্ত ক্ষতটা লক্ষ্য করলেন,যেখানে
মাংসপেশীর গভীরে ঢুকে রক্তচোষা পোকাটা কামড়ে যাচ্ছে আর তাসত্ত্বেও ছেলেটা
কোনোরকম নড়াচড়া না করে স্থির হয়ে বসে রয়েছে। পরশুরাম তাঁর দিকে তাকিয়ে
বললেন, "তুমি ব্রাক্ষণ হতে পার না – যদি তুমি হতে, তুমি চিৎকার করতে। এমনকি
কোনোরকম ছটফট বা নড়চড় করা ছাড়া যে তুমি এতখানি যন্ত্রণা সহ্য করতে পেরেছ –
তুমি নিশ্চয়ই কোনো ক্ষত্রিয় হবে।” কর্ণ বলেন, “হ্যাঁ, আমি ব্রাহ্মণ নই।
দয়া করে আমার ওপর রেগে যাবেন না।” পরশুরাম রাগে ফেটে পড়লেন, “ওহে নির্বোধ,
তুমি কী ভেবেছ আমার থেকে এসব শেখার জন্য তুমি এখানে নকল পৈতে পরে এসে আমার
সাথে ছলনা করতে পারো? আমি তোমায় অভিশাপ দেব।" কর্ণ কাকুতি-মিনতি করলেন, "
দয়া করুন – আমি কোনও ব্রাহ্মণ নই তবে আমি ক্ষত্রিয়ও নই। আমি একজন
সূতপূত্র, তার মানে এটা কেবল অর্ধেক মিথ্যা।"
গৌরবের আকাঙ্ক্ষা
পরশুরাম তাঁর কথা শুনলেন না। যেই মুহূর্তে তিনি ওই পরিস্থিতিটা দেখেন,
তিনি যথার্থই অনুমান করেন যে কর্ণ একজন ক্ষত্রিয় ও তিনি বলেন, "তুমি আমাকে
ছলনা করেছ। আমি তোমায় যা যা শিখিয়েছি সেগুলো সবই তুমি উপভোগ করবে কিন্তু
যখন সত্যিই দরকার পড়বে, যেসব মন্ত্র তোমার দরকার তুমি সেগুলো ভুলে যাবে
আর সেটাই হবে তোমার শেষ।" কর্ণ তাঁর পায়ে পড়ে মিনতি করলেন, "দয়া করে
এমনটা করবেন না। আমি কোনও ক্ষত্রিয় নই আর আপনাকে ছলনা করারও কোনও
অভিপ্রায় আমার ছিল না। বিষয় শুধু এটাই যে আমি শেখার জন্য মরিয়া হয়ে
উঠেছিলাম আর অন্য কেউই আমাকে শেখাতে ইচ্ছুক ছিলেন না। আপনিই একমাত্র ছিলেন
যিনি একজন অ-ক্ষত্রিয়কে শিখতে দিতেন।"
পরশুরামের রাগ ঠাণ্ডা হলে তিনি বললেন," তা হলেও,তুমি মিথ্যা কথা বলেছ।
পরিস্থিতিটা তোমার আমার কাছে খুলে বলা উচিত ছিল। তোমার আমার সাথে তর্ক করা
উচিত ছিল কিন্তু আমাকে মিথ্যা বলা তোমার উচিত হয়নি। আমি অভিশাপটা ফিরিয়ে
নিতে পারব না তবে আমি বুঝতে পারছি যে তোমার আকাঙ্ক্ষা ধনুর্বিদ্যা, রাজ্য
বা ক্ষমতার জন্য নয় – তোমার আকাঙ্ক্ষা শুধুমাত্র গৌরবের জন্য আর তুমি সেটা
পাবেও। মানুষ সবসময় তোমাকে একজন গৌরবময় যোদ্ধা হিসেবে মনে রাখবে কিন্তু
তোমার ক্ষমতা বা রাজ্য কোনোটাই থাকবে না বা তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ
হিসেবেও পরিচিত হবে না কিন্তু তোমার গৌরব সবসময়ই বেঁচে থাকবে আর এটাই
তোমার আকাঙ্ক্ষা।”
নিজের ওপরে এই অভিশাপ নিয়ে, কর্ণ এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তিনি
যে এই প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তাতে তিনি খুশি ছিলেন, নিজের প্রতিভা নিয়েও খুশি
ছিলেন – কিন্তু তা প্রকাশ করবেন কোথায়? একজন ক্ষত্রিয়ই কেবল কোনো যুদ্ধ বা
প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারত। চোখ বন্ধ করে তিনি যেকোনো নিশানায় মারতে
পারতেন কিন্তু তিনি নিজের পারদর্শিতাগুলো জাহির করতে পারছিলেন না। চাওয়ার
মধ্যে তিনি কেবল গৌরবই চেয়েছিলেন আর সেটা থেকেই তাঁকে বঞ্চিত করা হয়েছিল।
নিরাশ হয়ে, তিনি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে হেঁটে সমুদ্রতটে বসলেন, বর্তমান
উড়িষ্যা রাজ্যের কোণার্কের কাছাকাছি কোনও একটা জায়গায়, যেখানে সূর্যের কৃপা
সবচেয়ে ভালোভাবে লাভ করা যায়।
জোড়া-অভিশাপবিদ্ধ
তিনি কঠোর সংযম শুরু করলেন ও দিনের পর দিন ধ্যানে বসে রইলেন। সেখানে
খাবার কিছু ছিল না, কিন্তু তাসত্ত্বেও, তিনি বসে ধ্যান করে গেলেন। যখন তিনি
প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লেন, তিনি কয়েকটা কাঁকড়া ধরে খেয়ে ফেললেন যেগুলো
তাঁকে পুষ্টি জোগাল ঠিকই কিন্তু তাঁর ক্ষুধা দিল আরও বাড়িয়ে। কয়েক সপ্তাহ
সাধনার পর, সবকিছুর থেকে বড় হয়ে দাঁড়াল তাঁর ক্ষুধা। এই অবস্থায়, তিনি
লক্ষ্য করলেন একটা জন্তু ঝোপের ভেতর নড়াচড়া করছে। এ নিশ্চয় কোনো হরিণ হবে
এই ভেবে তীর-ধনুক তুলে নিয়ে হঠকারিতা করে তিনি তীর ছুঁড়লেন আর শুনতে পেলেন
তীরটা গিয়ে বিঁধেছে ঠিক নিশানাতেই। শিকারের হরিণের মাংস দিয়ে ক্ষুধা
নিবৃত্তির ছবিটা তিনি মনে মনে কল্পনা করলেন কিন্তু যেই না তিনি ঝোপের মধ্যে
গেলেন, আতঙ্কিত হয়ে আবিষ্কার করলেন যে সেটা ছিল আসলে একটা গোরু।
গোহত্যা কোনো আর্যের পক্ষে করার মতো সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ বলে গণ্য করা
হত। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তিনি গোরুটার দিকে তাকালেন আর গোরুটাও চিরতরে তাঁর
চোখ বোজানোর আগে পাল্টা তাঁর দিকে অমায়িক,কোমল চাহনিতে চাইল। কী করণীয় না
জেনে তিনি পাগলপ্রায় হয়ে উঠলেন। ঠিক তখনই, একজন ব্রাহ্মণ এসে উপস্থিত হলেন,
মরা গোরুটার দিকে তাকালেন ও কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। তিনি বললেন, “তুমি
আমার গোরুকে মেরে ফেলেছ! তোমার যেন অভিশাপ লাগে। তোমায় যোদ্ধার মতো
দেখাচ্ছে, তো আমি তোমায় অভিশাপ দিলাম যে যখন তুমি যুদ্ধক্ষেত্রে আর সত্যিই
কঠিন সময় উপস্থিত, তোমার রথ মাটিতে এত গভীরভাবে বসে যাবে যে তুমি সেটাকে আর
উদ্ধার করতে পারবে না আর যেভাবে তুমি এই অসহায় গোরুটাকে হত্যা করেছ, যখন
তুমি অসহায় অবস্থায় থাকবে, তোমাকেও হত্যা করা হবে।” কর্ণ তাঁর পায়ে পড়ে
মিনতি করলেন, “দয়া করুন – আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত ছিলাম। আমি জানতাম না যে এটা
কোনো গোরু ছিল। আপনি যদি চান, আমি আপনাকে এর পরিবর্তে একশোখানা গোরু দেবো।”
সেই ব্রাহ্মণ বললেন, “এই গোরুটা আমার কাছে কেবল একটা প্রাণীই ছিল না। আর
সব কিছুর চেয়ে সেই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয়। যা পূরণ করা যায় না তা পূরণ
করার প্রস্তাব দেওয়ার জন্য, আমি তোমাকে আরো বেশি করে অভিশাপ দিচ্ছি।"
এই জোড়া অভিশাপ নিয়ে, কোথায় যাবেন না জেনেই কর্ণ এগিয়ে চললেন। তাঁর
তীর দিয়ে তিনি একটা ধূলিকণাকেও নিশানাভেদ করতে পারতেন, কিন্তু কী লাভ?
তিনি ক্ষত্রিয় ছিলেন না – কেউ তাঁকে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে দিত
না, যুদ্ধের কথা তো ছেড়েই দিন। উদ্দেশ্যহীনভাবে তিনি এদিক-ওদিক ঘুরে
বেড়াতে লাগলেন................তারপর.....................
No comments:
Post a Comment