Wednesday, July 29, 2020

Post # 980 Bengali Amarchitra Katha 026

                                                                        ডাউনলোড করুন


  হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে সূর্যদেবতার ঔরসে ও কুন্তী দেবীর গর্ভে এঁর জন্ম হয়েছিল একবার মহর্ষি দুর্বাসা কুন্তীর গৃহে অতিথি হিসাবে আসেন কুন্তীর অতিথি সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে- দুর্বাসা কুন্তীকে একটি মন্ত্র দান করেন এই মন্ত্রের দ্বারা ইনি যে দেবতাকে স্মরণ করবেন, সেই দেবতাই এসে কুন্তীকে সংগম দ্বারা পরিতৃপ্ত করে পুত্র দান করবেন কৌতুহলবশতঃ কুমারী অবস্থাতেই একবার কুন্তী সূর্য দেবতাকে ডেকে বসেন এবং সূর্যদেবের সাথে মিলনের ফলে ইনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন যথা সময়ে ইনি একটি পুত্র সন্তান লাভ করলে, লোকলজ্জার ভয়ে সেই পুত্রকে একটি পাত্রে রেখে জলে ভাসিয়ে দেন এই পুত্রের নামই কর্ণ সূতবংশীয় অধিরথ ও তাঁর স্ত্রী রাধা কর্ণকে জল থেকে উদ্ধার করে প্রতিপালন করেন রাধার পুত্র হিসাবে কেউ কেউ তাঁকে রাধেয় নামে ডাকতো। এই দম্পতি কর্ণের নাম রেখেছিলেন বসুষেণ।
ইনি অন্যান্য দেশের রাজপুত্রদের সাথে দ্রোণাচার্যের অস্ত্রশিক্ষা করেন অস্ত্রশিক্ষা শেষে ইনি অর্জুনের সকল অস্ত্রকৌশল দেখান এবং অর্জুনকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহ্বান করেন কর্ণের পরিচয় অজ্ঞাত থাকায় অর্জুন এই আহ্বানে সাড়া দেন নাই কর্ণের এরূপ বীরত্বের পরিচয় পেয়ে দুর্যোধন তাঁর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে অঙ্গরাজ্যের রাজপদে অভিষিক্ত করেন এরপর দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় ইনি লক্ষ্যভেদের চেষ্টা করলে দ্রৌপদী ঘোষণা দেন যে, সূতপুত্রের গলায় মালা দেবেন না সে কারণে ইনি এই প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকেন অর্জুন লক্ষ্যভেদে দ্রৌপদী লাভ করলে অন্যান্য রাজন্যবর্গের সাথে ইনি পাণ্ডবদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং অর্জুনের কাছে পরাস্ত হন ইনি দ্রোণাচার্যের কাছে ব্রহ্মাস্ত্র বিদ্যা শিখতে চাইলে, সূতপুত্র বলে দ্রোণাচার্য তাঁকে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন
এরপর ইনি পরশুরামের কাছে গিয়ে ব্রাহ্মণ পরিচয়ে এই বিদ্যালাভ করেন একদিন পরশুরাম এঁর কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলেন এমন সময় অলর্ক নামক একটি কীট কর্ণের উরু বিদীর্ণ করে গুরুর ঘুম ভেঙে যাবার ভয়ে ইনি যন্ত্রণা সহ্য করতে থাকলেন একসময় পরশুরাম ঘুম ভেঙে উঠে সকল বিষয় দেখে এবং কর্ণের কষ্ট সহিষ্ণুতা লক্ষ্য করে তাঁর প্রকৃত পরিচয় জানতে চাইলেন অবশেষে কর্ণ ব্রাহ্মণ নয় জেনে এবং গুরুকে প্রতারণা করার জন্য অভিশাপ দিয়ে বললেন যে, কপট উপায়ে ব্রহ্মাস্ত্র লাভের জন্য, কার্যকালে কর্ণ এই অস্ত্রের কথা ভুলে যাবেন আর একবার ইনি এক ব্রাহ্মণের হোম ধেনু হত্যা করার জন্য, উক্ত  ব্রাহ্মণ তাঁকে অভিশাপ দিয়ে বলেন যে, যুদ্ধকালে এঁর মহাভয় উপস্থিত হবে, পৃথিবী তাঁর রথের চাকা গ্রাস করবে এবং কোন এক বিশেষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করতে সচেষ্ট হলে তাঁর হাতেই কর্ণের মৃত্যু হবে।  
পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত করে ইনি কলিঙ্গরাজের কন্যার স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হন সেখানে কলিঙ্গরাজ জরাসন্ধের সাথে যুদ্ধ হয় এই যুদ্ধে জরাসন্ধ সন্তুষ্ট হয়ে কর্ণকে মালিনীনগর দান করেন কর্ণ দুর্যোধনের পরামর্শদাতাদের অন্যতম ছিলেন পাণ্ডবদের জতুগৃহ দাহে ইনি পরামর্শ দিয়েছিলেন পাণ্ডবদের বনবাসকালীন সময়ে দ্বৈতবনে অবস্থানের সময় শকুনি ও কর্ণের পরামর্শে দুর্যোধন পাণ্ডবদের দুর্দশা দেখতে যান সেখানে গন্ধর্বরাজের কাছে দুর্যোধন পরাজিত ও বন্দী হলে কর্ণ তাদের উদ্ধার করতে ব্যর্থ হন অবশেষে অর্জুন তাদের রক্ষা করেছিলেন দুর্যোধনের বৈষ্ণবযজ্ঞকালে ইনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, অর্জুনকে হত্যা না করা পর্যন্ত পাদ-প্রক্ষালন বা জল গ্রহণ করবেন না আসুরব্রত অবলম্বন করে ইনি আবার প্রতিজ্ঞা করেন যে অর্জুন নিহত না হওয়া পর্যন্ত, এঁর কাছে কেউ কোন কিছু প্রার্থনা করলে তাকে তিনি বিমুখ করবেন না 
কর্ণের দানশীলতা পরীক্ষা করার জন্য কৃষ্ণ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে এসে আহার করার জন্য তাঁর ছেলে বৃষকেতুর মাংস চান কর্ণ তাঁর পুত্রকে হত্যা করে কৃষ্ণকে আহার করতে দেন কৃষ্ণ কর্ণের এই ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে এই সন্তানের জীবন দান করেন এই ব্রত পালনের সময় অর্জুনের পিতা ইন্দ্র ব্রাহ্মণবেশ ধারণ করিয়া অর্জুনের জন্য তাঁর কুণ্ডলদ্বয় ও কবচ প্রার্থনা করেন। কর্ণের পিতা সূর্য এ বিষয়ে কর্ণকে পূর্বেই সতর্ক করে দিলেও সত্য রক্ষার্থে কর্ণ তা ইন্দ্রকে দান করেন তবে সূর্যের পরামর্শে অর্জুনকে হত্যা করার জন্য ইন্দ্রের কাছ থেকে একাগ্নি বাণ প্রার্থনা করেন ইন্দ্র এই অস্ত্র একবার মাত্র ব্যবহারের সূযোগ দেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চতুর্দশ দিবসে কর্ণ ঘটোৎকচ বধে এই অস্ত্র প্রয়োগ করেছিলেন।   
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে কৃষ্ণ তাঁর জন্ম পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন যে- পাণ্ডবদের সে অগ্রজ সুতরাং সে কারণে কর্ণের উচিৎ এই যুদ্ধ পরিহার করে পাণ্ডবদের সাথে ভাই হিসাবে মিলে যাওয়া কর্ণ এই  প্রস্তাবে রাজি হলে- অগ্রজ হিসাবে যুধিষ্ঠীরের পরিবর্তে কর্ণই রাজা হতেন কর্ণ রাজি হননি বেশ কয়েকটি কারণে-
কুন্তি তাঁকে পরিত্যাগ করলে যাঁরা তাঁকে পিতামাতা হিসাবে পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁদের সে পরিচয়েই পরিচিত থাকতে চেয়েছিলেন
দুর্যোধন তাঁকে রাজ্যদান করে সম্মান দিয়েছিলেন এবং তাঁর ভরসাতেই দুর্যোধন এই যুদ্ধে অগ্রসর হয়েছেন সুতরাং কর্ণ সেখান থেকে ফিরে দুর্যোধনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবেন না যুধিষ্ঠির যাতে এই ঘটনা জানতে না পারে সেরূপ অনুরোধ করে কৃষ্ণকে জানান যে- যুধিষ্ঠির জানলে তিনি অগ্রজ হিসাবে কর্ণকে রাজ্যদান করবেন, আর সে রাজ্য কর্ণ দুর্যোধনকে দান করবেন
কর্ণের মাতাপিতা (কুন্তী ও সূর্য) কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে নিষেধ করেছিলেন কিন্তু কর্ণ তা অগ্রাহ্য করেছিলেন তবে প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলেন অর্জুন ছাড়া অন্য কোন পাণ্ডবকে তিনি হত্যা করবেন না যুদ্ধের প্রারম্ভে ভীষ্ম কবচ-কুণ্ডল হীন কর্ণকে নীচ ও গর্বিত বলেছিলেন এবং পশুরাম কর্তৃক অভিশপ্ত বলে ভীষ্ম তাঁকে অবজ্ঞা করেছিলেন সেই কারণে ইনি প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলেন যে ভীষ্ম জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় অস্ত্র ধারণ করবেন না ভীষ্ম শরশয্যায় অবস্থানকালে কর্ণকে তাঁর জন্মবৃত্তান্ত অবগত করিয়ে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে নিষেধ করলে- কর্ণ দুর্যোধনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে বলে তা অগ্রাহ্য করেন। 
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনে কর্ণ অপর ছয়জন মহারথের সাথে মিলিত হয়ে অর্জুন-পুত্র অভিমন্যুকে হত্যা করতে সাহায্য করেন যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে অর্জুনের জন্য রক্ষিত ইন্দ্র-প্রদত্ত একাঘ্নী বাণ নিক্ষেপে ইনি ঘটোত্কচকে হত্যা করেন।  যুদ্ধের ষোড়শ দিনে দ্রোণের মৃত্যুর পর ইনি কৌরব-সেনাপতি পদে অভিষিক্ত হন অর্জুন ছাড়া অপর পাণ্ডবেরা তাঁর কাছে পরাজিত হলেও প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হবে বলে- কাউকেই ইনি হত্যা করেননি পরশুরাম ও ব্রাহ্মণের অভিশাপের কারণে ইনি হীনবল অবস্থায়, অর্জুন অঞ্জলিক বাণে কর্ণের শিরশ্ছেদ করেন। 

কর্ণের স্ত্রীর নাম ছিল পদ্মাবতী তাঁর তিনজন সন্তানের নাম জানা যায় এরাঁ হলেন -বৃষসেন, বৃষকেতু, চিত্রসেন ইনি অঙ্গরাজ্যের অধিপতি ছিলেন বলে- এঁর অন্যান্য নাম ছিল- অঙ্গরাজ, অঙ্গাধিপ, অঙ্গাধিপতি, অঙ্গাধীশ, অঙ্গাধীশ্বর। সূর্যের পুত্র হিসাবে তাঁর নাম ছিল- অরুণাত্মজ, অর্কতনয়, অর্কনন্দন, অর্কপুত্র, অর্কসূত, অর্কসূনু। 

অর্জুন ও কর্ণ পূর্বজন্মে কি ছিলেন...!
রামায়ণ যুগের বানর রাজ সুগ্রীবের নাম নিশ্চয়ই সবাই শুনেছেন? সুগ্রীব ছিল সূর্যদেবের পুত্র! আর তার ভাই মহাশক্তিধর বালি আবার ছিল দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের পুত্র! (অনেকটা অর্জুন ও কর্ণের মত)! বালি এতই শক্তিধর ছিল যে, একদিন সন্ধ্যকৃত্য করার সময় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় রাক্ষস রাজ্ রাবণ বালির উপর আক্রমণ করে বসে! কিন্তু বালি ধ্যানমগ্ন থেকেই নিজের লেজ দিয়ে রাবণ কে ধরে এনে নিজে বগলের নিজে ঢুকিয়ে রাখে!
সুগ্রীব তার সেই মহাশক্তিধর ভাই বালিকে বধ করতে ছল রচনা করেছিল! ঐ ছল রচনার রেশ ধরেই সুগ্রীব অভিশাপগ্রস্ত হয়েছিল এবং রামায়ণ যুগ শেষ হওয়ার পর ও মহাভারত যুগ শুরুর আগে সে এক রাক্ষস হয়ে জন্ম নিয়েছিল! নাম ছিল দম্ভোদভব; পূর্ব জন্মে সূর্যপুত্র সুগ্রীব পরজন্মে ছিল সূর্যের পরম ভক্ত; এবং কঠোর আরাধনা করে সে সূর্যদেব কে প্ৰসন্ন করে উনার কাছ থেকে এক সহস্র কবচের এক মহাশক্তিশালী সুরক্ষা প্রাপ্ত করেছিল! সেই কবচ গুলোর বিশেষত্ব ছিল এই যে, কাউকে সহস্র কবচের এক একটি ভেদ করতে হলে তাকে প্রতিবার এক হাজার বছর তপস্যার করে আসতে হবে এবং একটা কবচ কাটার পর যে কাটবে তার জীবনী শক্তি শেষ হয়ে সে মৃত্যু বরণ করবে! সেই এক হাজার কবচ প্রাপ্তির পর দম্ভোদব রাক্ষস সহস্র কবচ নামে পরিচিত হয়ে উঠল! আর এমন বজ্র কঠিন সহস্র কবচের সুরক্ষা পেয়ে সে মহা অত্যাচারী হয়ে উঠল এবং এক সময় সে দেবতাদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিল!
সেই সময় মহাদেবের পরামর্শে ভগবান বিষ্ণু দুই অংশ হয়ে ব্রহ্মমার মানসপুত্র ধর্ম ও মূর্তির ঘরে জমজ শিশু রূপে জন্ম নিলেন! তাদের নাম হল নর ও নারায়ণ!
হিমালয়ে কেদার নামক পর্বতশৃঙ্গটি মহাদেবের অত্যন্ত প্রিয় এবং বহুকাল আগে থেকেই মহাদেবের আশীর্বাদ ছিল যে, এখানে যদি কেউ একদিন ধ্যান করে সেটা হবে এক হাজার দিন ধ্যানের সমান! একটা সময় নর ও নারায়ণ সেই কেদারশৃঙ্গে গিয়ে মহাদেবের শিষ্যত্ব বরণ করেন এবং মহাদেব কর্তৃক মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের জ্ঞান লাভ করে ধ্যানে লীন হয়ে গেলেন! এই ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বহুকাল কেটে গেল! এক সময় রাক্ষস সহস্র কবচের নিকট সংবাদ পৌঁছল যে, নর ও নারায়ন নামক দুই ঋষি বহুকাল যাবৎ হিমালয়ের একটু পর্বতে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে; এবং তারা এতটাই শক্তি সঞ্চিত করেছে যে, তাদের মন্ত্র উচ্চারণের ত্যাজ পুরো পর্বতমালা কম্পিত হচ্ছে!
সহস্র কবচ খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল এবং একদিন সে নর ও নারায়ণের উপর আক্রমণ করে বসল! নর ও নারায়ন একজন একজন করে পর্যায়ক্রমে দম্ভোদবের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলেন এবং একটা একটা করে কবচ কাটতে লাগলেন এবং প্রতিবার কবচ কাটার যখন তাদের জীবনী শক্তি শেষ হয়ে যায় তখন একজন আরেক জন কে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রবলে বাঁচিয়ে তুলেন! এভাবে যখন ৯৯৯ টি কবচ কাটা পড়ল, তখন রাক্ষস সহস্র কবচ পালিয়ে সূর্য দেবের আশ্রয়ে চলে গেল! এবং সূর্যদেব তাকে নর ও নারায়নের হাত থেকে রক্ষা করতে তার অবশিষ্ট একটি কবচ সহ দেবী কুন্তীর গর্বে স্থাপন করে দেন! এবং কুন্তীর সেই পুত্রই হচ্ছে কর্ণ..! যাকে আমরা সূর্যপুত্র কর্ণও বলে থাকি! আর সেই নর ও নারায়ণ কে জানেন ? তাঁরা আর কেউ নন, নর হলেন স্বয়ং অর্জুন এবং নারায়ণ হলেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ !
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় নর ও নারায়ণ বিষ্ণুর যুগল অবতার রূপে পূজিত হন!


তথ্য সূত্র : গজেন্দ্র কুমার মিত্রের পাঞ্চজন্য  ও  onushilon.org ।






 

Monday, July 27, 2020

Post # 979 Bengali Amarchitra Katha 025




                                                      ডাউনলোড করুন
 

 ইংরাজি তে এই কমিকস্‌ এর দুটি পৃথক প্রচ্ছদ হয়েছিল... কিন্তু ভিতরের অলংকরণ একই ছিল। বাংলায় একটি প্রচ্ছদ ই হয়েছিল । 




 ইস আমি ভাবলাম আমি ছাড়াও এইবার কেউ ইন্দ্রজাল ১ - ৪২০ অবধি স্ক্যান ও এডিট করেছেন... 'বেঙ্গলি কমিকস্‌ লাভার' 'ফেসবুক গ্রুপ' এ সকলে খুব খুশি হোল... 'শুভাগত বন্দ্যোপাধ্যায়' জানালেন খুব কষ্ট করে ডাউনলোড করে দেখলেন পর্বতের মূষিক প্রসব... সেই আমার ব্লগের বই নিয়ে ... ইউ টিউব এ দিয়ে সস্তায় বাজি মাৎ  করার এক কদর্য প্রচেষ্টা... এই 'মাইতি' না 'গাইতি' কি নাম যেন... কু কীর্তি টি তার... নিজের কিছু রদ্দি বই এর ভিডিও করে ডাউন লোড দিচ্ছে আমার জল ছাপ মারা বই গুলি...
জীবনে হয়তো স্ক্যানার এ হাত ও দিয়ে দেখেনি...ইউ টিউব এ আমি একটি কমেন্ট ও করে এসেছি দেখতে পাবেন ... স্ক্রিন শর্ট দিলাম । এই সব ছ্যাচড়া  দের ক্ষমতা কোনদিন ও হবেনা ১-১০০ অবধি ইন্দ্রজাল  সংরগ্রহ করার, তারপর তো স্ক্যান আছে, এডিট আছে, পি ডি এফ করা আছে... ব্যাক এন্ড এ আপলোড আছে... 




 তা 'গাইতি স্যার'  ... নিজে কিছু করে দেখাও ... দম আছে ১০০ ঘরের বই ১০০০ - ২০০০ দিয়ে কেনার ?







বিশ্বাসঘাতক আর মীরজাফর এখন যেন সমার্থক। আধুনিক ইতিহাসে আমাদের জানা বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনাগুলির মধ্যে পলাশীর যুদ্ধের সেই ঘটনাই সকলেরই সমধিক জানা। কিন্তু মধ্যযুগীয় ইতিহাসের আরেক বীরের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে আরেক রাজার কথা, যিনি দেশ ও জাতির সাথে ঘাতকতা করেছেন, আর তার চরম শাস্তিও পেয়েছেন।
১১৯১ সালে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে মুখোমুখি হন দিল্লীর রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান আর আফগান সুলতান মহম্মদ ঘোরী। ভারতীয়দের মধ্যে অনৈক্য বহুকাল ধরেই এক জ্বলন্ত সমস্যা,কাজেই বিদেশী শক্তির আক্রমণকে প্রতিহত করার বেলায় কোন শক্তিজোটই গঠন হয়নি।সুলতান ঘোরী যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন রাজস্থানের চৌহান সম্রাট বীর পৃথ্বীরাজ ব্যতীত আর কেউ দেশমাতৃকার সম্মান রক্ষার্থে রুখে দাঁড়াননি।পাশে ছিলেন আরেক রাজপুত বীর সংগ্রাম সিং। ১১৯২ এর খ্যাতনামা তরাইনের প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ করেন পৃথ্বীরাজ, কিন্তু ঘোরীকে মুক্তি দেন।
ঘোরী আফগানিস্তান ফিরে যান ঠিকই, কিন্তু পরাজয়ের যন্ত্রনা ও শত্রুপক্ষের কৃপাপূর্ণ মুক্তি তাঁকে অসম্ভব লাঞ্ছিত করেছিল, কাজেই মনের মধ্যে জ্বলছিল প্রতিশোধের আগুন। আর সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছিল তাঁর মনোজাত অসন্তোষ। চরম ক্রোধে ঘোরী ঠিক করেন, প্রতিশোধ নিতেই হবে। কিন্তু তিনি জানতেন, পৃথ্বীরাজের নেতৃত্বাধীন রাজপুত শক্তিকে পরাজিত করা মুখের কথা নয়।
কাজেই রাজপুতানার অন্তর্দাহকে ব্যবহার করার দিকে এগোন তিনি, আর গ্রহণ করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের 'শত্রুর শত্রু আমার মিত্র' নীতি, হাল আমলের নেতাজী, হিটলার, মুসোলিনি বা আরো বহু রাষ্ট্রনায়কই যা গ্রহণ করেছেন।
সেইসময় কনৌজ ও বারাণসীর অপর রাজপুত রাজা, গাড়োয়াল সম্রাট জয়চন্দ্রের সাথে পৃথ্বীরাজ চৌহানের শত্রুতার কাহিনী ছিল সুপরিচিত। বস্তুত, জয়চন্দ্রের কন্যা সংযুক্তা ও পৃথ্বীরাজের মধ্যেকার প্রেমের সম্পর্কের আগাগোড়া বিরোধী ছিলেন জয়চন্দ্র। এবিষয়ে কন্যার সাথে বারংবার মতবিরোধ হয়
তাঁর।এমতাবস্থায় কন্যার স্বয়ম্বর সভায় পৃথ্বীরাজকে আহ্বান না করে তাকে অপমানও করেন তিনি। কিন্তু, সেইসময়ের প্রচলিত প্রথানুযায়ী, রাজারা তাঁদের পছন্দের রমণীকে 'হরণ' করে নিজের বীরত্বের প্রমাণ দিয়ে বিবাহের পথ প্রস্তুত করবেন। বীর পৃথ্বীরাজ সংযুক্তাকে বীরত্বপূর্বক দিল্লীতে নিয়ে এসে সেই রাজপ্রথার পালন করেন। তাঁর বীরত্ব জয়চন্দ্রকে বুঝিয়ে দেয়, পৃথ্বীরাজের মোকাবিলার জন্য তাঁকে তৃতীয় শক্তির সাহায্য নিতে হবে।
কাজেই কনৌজ সম্রাট জয়চন্দ্র ও আফগান সুলতান মহম্মদ ঘোরীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন হয়। ১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহান পরাস্ত হন তাঁর একদা ক্ষমাপ্রাপ্ত সুলতান ঘোরী এবং শ্বশুর তথা স্বজাত জয়চন্দ্রের কাছে। শোনা যায়, ২৬ বছরের বীরযুবক পৃথ্বীরাজকে অন্ধ করে হত্যা করা হয়। কিন্তু তবুও বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে শানিত অস্ত্রাঘাত তাঁকে অমর করে রেখেছে,সেইসাথে বিমূর্ত প্রেমের এক অমর প্রতীক তিনি। পৃথ্বীরাজ-সংযুক্তার এই প্রেমকাহিনী শুধুই সাহিত্য বা ফিল্ম-টেলিফিল্মের উপজীব্যই নয়, এই প্রেমগাঁথা তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে ভারতীয় ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ যুগের সূচনা করেছে : ভারত ইতিহাসের 'মধ্যযুগ',যা বিস্তৃত ছিল পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) পর্যন্ত। বস্তুত, ১১৯২ সালের এই ভবিতব্য যুদ্ধই ভারত ইতিহাসে প্রাচীন যুগ এবং মধ্যযুগের সন্ধিক্ষণ, আর সেই সাথে দিল্লীতে ঘোর বংশের সাম্রাজ্যস্থাপনের কারণে সুলতানি সাম্রাজ্য এক বিশেষ মাত্রা লাভ করে।
কিন্তু ইতিহাস বিশ্বাসঘাতককে কদাচ ক্ষমা করে! এরপর জয়চন্দ্র ভেবেছিলেন পৃথ্বীরাজ তথা চৌহান বংশের পতনের মাধ্যমে তিনিও বিপন্মুক্ত হলেন, কিন্তু তাঁর পথের কাঁটা যে আরো জাঁকিয়ে বসল,সেটা তিনি বুঝতে পারেনইনি। ঠিক এক বছর পরের ঘটনা। মহম্মদ ঘোরীর এই সাম্রাজ্যবিস্তারের পরম্পরা তাঁর উত্তরসূরীরা মান্য করতে থাকেন।কাজেই দিল্লীকে কেন্দ্রিভূত করে পত্তন লাভ করা সুলতানাত আরো বৃহত্তর হতে থাকে।ধীরে ধীরে তাঁদের সাম্রাজ্যের পরিসীমা দক্ষিণে বাড়তে বাড়তে একসময় কনৌজের সীমানায় এসে পৌঁছোয়। জয়চন্দ্র ভাবেন,যে বীজবৎ সাম্রাজ্যকে তিনি ভূমিভেদে সাহায্য করেছিলেন, আজ তা বিশাল মহীরুহে পরিণতি লাভ করে তাঁকে নিশ্চয়ই বৃক্ষতলে ছত্রছায়া প্রদান করবে।কিন্তু হায়! কুতুবউদ্দিন আইবেক, মহম্মদ ঘোরী ও অন্যান্য সেনাপতিদের নেতৃত্বাধীন ঘোর শক্তি জয়চন্দ্রের সাথে কোনরূপ বাক্যালাপেই রাজি ছিল না, তাঁরা স্রেফ তাঁদের সাম্রাজ্য ও ঔপনিবেশিক শক্তিবৃদ্ধির জন্য সমস্ত প্রকার নিধনে রাজী ছিলেন। কাজেই ১১৯৩ সালে অধুনা ফতেপুরে তাঁরা জয়চন্দ্রের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন, স্বার্থসিদ্ধিবাজ জয়চন্দ্র যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে পলায়নে বাধ্য হন, কিন্তু পারেননি। দেশ,জাতি, মাতৃভূমির এই বিশ্বাসঘাতকের অসাড় দেহ তলোয়ারের কোপে লুটিয়ে পড়ল ফতেপুরের রণক্ষেত্রে। সুলতানি সাম্রাজ্য দখল করল কনৌজ, বারাণসী,গাড়োয়াল সহ বিভিন্ন অঞ্চল, যেগুলি বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, বিহারে বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে।
রাজপুতানার ইতিহাসে এটি অতিপ্রসিদ্ধ একটি কাহিনী। পৃথ্বীরাজ চৌহানের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তাঁর পত্নী তথা কনৌজের রাজকন্যা, জয়চন্দ্র-দুহিতা সংযুক্তা জহরব্রত পালন করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরগতিপ্রাপ্ত হাজারো যোদ্ধার পত্নীরাও আগুনে ঝাঁপ দিয়ে একইভাবে আত্মাহুতি দেন।
না রাজা তাঁর স্ত্রীকে পেলেন দেশের জন্য বলিদান দিয়ে, না নিজেকে বাঁচালেন শত্রুকে ক্ষমা করে, না পিতা তাঁর কন্যাকে পেলেন জামাতাকে হত্যা করে, না পারলেন সু-কন্যার প্রাণই বাঁচাতে, না পারলেন নিজেকে বাঁচাতে। অমর এই প্রেমগাঁথা শুধু তিনটি শীর্ষবিন্দুতে থাকা পিতা-কন্যা-সম্রাটের ত্রিকোণকেই ধ্বংস করল না, ইতিহাসকে এক নতুন মোড় দিল।













Sunday, July 26, 2020

Post # 978 Bengali Amarchitra Katha 024

                                                                    ডাউনলোড করুন



প্রায় ৫০০ বছর আগের ভারতবর্ষ। একের পর এক ভিনদেশি দখলদার শাসকরা সুবিশাল সৈন্যবাহিনী, অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন অংশ একের পর এক আক্রমণ করে দখল করে নিচ্ছে। এদের মধ্যে আফগান, তুর্কি ও মোঘলরা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে সফলও হয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তার তাদের শাসন পাকাপোক্ত করে ফেলেছে। তখনও অজেয় রাজ্যগুলোকে নিজের পতাকাতলে এনে সমগ্র ভারতবর্ষে একচ্ছত্র শাসন কায়েম করার উদ্দেশ্য নিয়ে কখনও যুদ্ধ, কখনও সন্ধির নাটক চলছে। এরকম পরিস্থিতিতে একটি রাজ্য এই বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তার নাম মেবার।
উত্তর ভারতের রাজস্থানের অন্তর্গত এই মেবার নানা ঐতিহাসিক নাটকীয় ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু। আর মেবারের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক নায়ক ছিলেন বীর যোদ্ধা মহারানা প্রতাপ সিং। মেবারের সিংহ নামে পরিচিত এই মহারানা প্রতাপ মুক্তিসংগ্রাম ও দেশপ্রেমের অপর নাম। মোঘলদের বারবার প্রতিরোধ করে সমগ্র ভারতবর্ষের মুক্তির লক্ষ্যে এক নতুন চেতনার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। এই দুর্দান্ত বীরের ইতিহাস যুগে যুগে যেকোনো স্বাধীনতাকামী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্যে তুখোড় প্রেরণার উৎস।
দুর্দান্ত মহারানা প্রতাপ সিং
১৫৪০ সালের ৯ মে রাজস্থানের কুম্বলগড়ে সিসোড়িয়া রাজপুত বংশে জন্ম নেন প্রতাপ সিং। তার পিতা মহারানা দ্বিতীয় উদয় সিং ছিলেন মেবারের রাজা। তার রাজধানী ছিল চিতোর। আর মা ছিলেন মহারানী জয়ন্ত বাই। উদয় সিং এর পঁচিশ জন পুত্রের মধ্যে সবার বড় ছিলেন প্রতাপ সিং। তাই পিতার উত্তরাধিকার তিনিই মনোনীত হন। তার পিতা বিদেশী আক্রমণকারীদের থেকে রাজ্যকে রক্ষা করতে বরাবর বেশ হিমশিম খেয়ে আসছিলেন। তাই উত্তরাধিকার হিসেবে রাজার মুকুটের সাথে এক বিশাল দায়িত্বের বোঝাও মাথায় নেন মহারানা প্রতাপ সিং।
রাজকীয় গুণাবলিতে কোনো অংশে কম ছিলেন না তিনি। ঘোড়সওয়ারী, অস্ত্রচালনা ও যুদ্ধনীতিতে জীবনের একদম গোড়া থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন প্রতাপ। একই সাথে উদারতা, দুর্বারতা ও নির্ভয়তার এক অনন্য সন্নিবেশ ঘটেছিল তার মধ্যে। রাজসভাসদগণ থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই তার গুণগ্রাহী ছিল। ১৭ বছর বয়সে প্রতাপ বিয়ে করেন বিজোলিয়ার সামন্ত বংশীয় আজাদবে পানওয়ারকে। মহারানী আজাদবের পাশাপাশি তার আরও দশজন রানী ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে ১৭ পুত্র ও ৫ কন্যার জনক ছিলেন প্রতাপ সিং।
চিতোরের সেই সুরক্ষিত দুর্গ
১৫৬৭ সালে সম্রাট আকবর ৬০,০০০ সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে চিতোরের দুর্গ অবরোধ করতে এলে প্রতাপের পুরো পরিবার নগর ছেড়ে গোগুন্ডার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এই দুর্গটির বিশেষত্ব, এটি ৫৯০ ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর অবস্থিত ছিল। এর দেয়ালগুলোও ছিল অনেক চওড়া। পূর্বেও অনেক বিদেশী আক্রমণকারী এই দুর্গ দখল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে আকবরের হাতে এর পতন ঘটে। এই দুর্গে পরপর তিনবার জওহর সংঘটিত হয়। শত্রু সেনাদের হাত থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে এক বিশাল সংখ্যক নারী একত্রিত হয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণ করার প্রথাকে জওহর বলে। রাজপুত নারীদের মধ্যে শেষ পথ হিসেবে এই আত্মহনন বেছে নেয়ার চল ছিল।
চিতোর দুর্গে প্রথম জওহর ঘটে রানী পদ্মাবতীর সময়ে, দ্বিতীয়বার ঘটে রানী কর্নাবতীর সময়, আর তৃতীয়বার ঘটে প্রতাপ সিং এর আমলে চিতোরের পতনের সময়। সেদিন ৬০,০০০ মোঘল সৈন্যের বিপরীতে দুর্গে ছিল মাত্র কয়েক হাজার রাজপুত সেনা, যারা প্রাণপণ যুদ্ধ করেও দুর্গ বাঁচাতে ব্যর্থ হয়। বাধ্য হয়ে সম্ভ্রম বাঁচাতে ৫,০০০ নারী আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন। নিজের চোখে এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে ২৭ বছর বয়সী প্রতাপ সিং তীব্রভাবে মর্মাহত হন। সম্রাট আকবরের সাথে তার পিতা উদয় সিং এর চলমান শত্রুতা তখন থেকেই তার নিজেরও শত্রুতায় পরিণত হয়। দেশকে মোঘল আগ্রাসন থেকে মুক্ত করা তার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
সম্রাট আকবর
উদয় সিং চিতোর ছেড়ে এসে উদয়পুর নামে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। ১৫৭২ সালে উদয় সিং পরপারে পাড়ি জমান। মুকুট পরেন প্রতাপ সিং। পিতার মৃত্যু এবং পিতা যে জীবদ্দশায় আর চিতোর দেখতে পেলেন না, এই গ্লানি তাকে গভীরভাবে পীড়া দিতো। তবে পীড়াগ্রস্ত তিনি একাই ছিলেন না, ছিলেন আরও একজন। স্বয়ং সম্রাট আকবর। আকবর চিতোর দখল করেছিলেন, কিন্তু পুরো মেবারের উপর তার আধিপত্য ছিল না। যতদিন মেবারের জনসাধারণ মহারানা প্রতাপের প্রতি অনুগত ছিল, ততদিন অবধি সমগ্র হিন্দুস্তানের একক জাঁহাপনা হবার শখ তার পরিপূর্ণ করা দুষ্কর ছিল।
আকবর কয়েকবার প্রতাপের কাছে সন্ধির জন্য দূত প্রেরণ করেন। কিন্তু প্রতাপ শুধু এমন চুক্তিতেই আগ্রহী ছিলেন যাতে মেবারের পূর্ণ সার্বভৌমত্ব বজায় থাকে। সন্ধির উদ্দেশ্যে পরপর কয়েকবার প্রতাপ সিং এর কাছে প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন আকবর। সর্বশেষ প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্ব দেন আকবরের বিশ্বস্ত সেনাপতি মান সিং। মান সিং নিজেও রাজপুত ছিলেন। একজন রাজপুত হয়েও রাজপুতদের হেনস্তাকারী আকবরের পক্ষ অবলম্বন করাতে মান সিং এর উপর তীব্র রাগান্বিত হন প্রতাপ সিং। বলা বাহুল্য, এই প্রতিনিধি দলও ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। এই ব্যর্থতা যুদ্ধ আর শান্তির মধ্যে মোটা দাগে একটি রেখা টেনে দেয়। আকবর বুঝতে পারেন সন্ধি নয়, যুদ্ধের পথেই তাকে এগোতে হবে।
এদিকে মহারানা প্রতাপও বুঝে নেন আকবরের পরবর্তী ভাষা হবে অস্ত্রের ভাষা। অনিবার্য যুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরুপ প্রতাপ তার রাজধানী নিজ জন্মস্থান কুম্বলগড়ে সরিয়ে নেন। জনসাধারণকে নির্দেশ দেন সবকিছু নিয়ে আরাবল্লি পর্বতের পেছনে চলে যেতে। তার পরিকল্পনা ছিল যুদ্ধটি আরাবল্লির পাহাড়ি এলাকায় সংঘটিত করার। এ ধরণের ভূমিতে রাজপুতরা লড়াই করে অভ্যস্ত ছিল, কিন্তু মোঘলরা ছিল একেবারেই অনভ্যস্ত। এ সুযোগটাই কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন প্রতাপ। তার একটি বাহিনী সবসময় হলদিঘাটি গিরিপথের উপর নজর রাখতো। উত্তর দিক থেকে উদয়পুর প্রবেশের একমাত্র পথ ছিল এই হলদিঘাটি।
১৫৭৬ সালের ১৮ জুন (কোনো বর্ণনামতে ২১ জুন) সংঘটিত হলো হলদিঘাটির সেই বিখ্যাত যুদ্ধ। আকবর মান সিং এর নেতৃত্বে ৮০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন মহারানা প্রতাপের বিরুদ্ধে। এই বিশাল বাহিনীর বিপক্ষে প্রতাপের দলে ছিল মাত্র ২০,০০০ রাজপুত সেনা। গোয়ালিয়রের রাম শাহ তানওয়ার ও তার তিন ছেলে ছিল ছিলেন প্রতাপের বাহিনীর মূল সেনাপতি। এছাড়া হাকিম খান শূরের নেতৃত্বে আফগান সেনার একটি দল এবং ভিল আদিবাসী গোষ্ঠীর একটি তীরন্দাজ বাহিনী প্রতাপের নেতৃত্বাধীন ছিল।
প্রথম ধাক্কায় মোঘল বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে দেয় রাজপুত সেনা। প্রতাপ সিং ‘লোনা’ ও ‘রাম প্রসাদ’ নামে দু’টি হাতি নামিয়ে দেন যুদ্ধক্ষেত্রে। তীর ও গোলার আঘাত অগ্রাহ্য করে এরা মোঘল বাহিনীকে তছনছ করে এগোতে থাকে। শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে একেকটা ঘোড়াকে তুলে ছুঁড়ে ফেলে এরা মোঘল সৈন্যদের লাশের উপর দিয়ে এগোতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না এদের মাহুত মোঘল সেনাদের হাতে নিহত হয়। মহারানা প্রতাপ প্রবল বিক্রমে শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আকবরের এক সেনাপ্রধানকে তিনি তলোয়ারের আঘাতে চিরে দ্বিখন্ডিত করেন।
এক আঘাতেই দ্বিখন্ডিত আকবরের সেনাপ্রধান
হাতির পিঠে বসে যুদ্ধের সামগ্রিক অবস্থা দেখছিলেন মান সিং। বাম ও ডান উভয় দিকের সৈন্যদের পর্যুদস্ত হতে দেখে মাঝের দলটি নিয়ে এগিয়ে যান তিনি। কিন্তু তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখেই ছুটে আসেন মহারানা প্রতাপ। নিজের ঘোড়া চেতকের মাথায় হাতির মতো একটি কৃত্রিম শুঁড় লাগিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। এই ভয়ানক দর্শন ঘোড়াটি চালিয়ে সরাসরি মান সিং এর হাতির উপরে ঝাঁপ দিয়ে উঠে আক্রমণ করে বসেন তিনি। তার বর্শার আঘাত থেকে অল্পের জন্যে বেঁচে যান মান সিং। পরবর্তীতে চেতক এই যুদ্ধে মারা পড়ে। মহারানা প্রতাপের বাহিনী এই অসম যুদ্ধে পরাজিত হতে বাধ্য হয়।
মান সিং এর উপর মারমুখী মহারানা প্রতাপ
হলদিঘাটের যুদ্ধের পরে আকবর আরও অনেকবার মেবার দখলে নেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হন। এই সময়ের মধ্যে প্রতাপও চিতোর পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাতে থাকেন। কিন্তু মোঘল বাহিনীর লাগাতার প্রহারে তার বাহিনী এক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। পাশাপাশি সেনা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থেরও অভাব পড়ে যায় তার। এমন অবস্থায় ভামা শাহ এগিয়ে আসেন এবং তাকে বিশাল পরিমাণ অর্থ দান করেন। এই অর্থ ১২ বছর ধরে মেবারের ২৫,০০০ সৈন্যের বাহিনীকে চালিয়ে নিয়ে যায়।
১৫৮৭ সালের পরে আকবর উত্তর-পশ্চিম ভারত ও পাঞ্জাবের দিকে তার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেন। মহারানা এই সুযোগে মেবারের বেশিরভাগ এলাকা পুনর্দখল করে নেন। কিন্তু চিতোর তিনি আর হস্তগত করতে পারেননি। অবশ্য জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি হৃত নগর পুনরুদ্ধারের আশাও ত্যাগ করেননি, লড়াই থেকেও পিছু হটেননি।
উদয়পুর মহারানা প্রতাপ মিউজিয়ামে সেই বিখ্যাত দৃশ্যটির ভাস্কর্য
১৫৯৭ সালে এক শিকার অভিযানের সময় দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে আহত হন মহারানা প্রতাপ। এই দুর্ঘটনাই তার মৃত্যুর কারণ হয়। ২৯ জানুয়ারী, ১৫৯৭ মেবারের এই সিংহ, বীর যোদ্ধা, ভারতবর্ষের অন্যতম স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা পরপারে পাড়ি জমান।  তিনি আমৃত্যু শত্রুর বশ্যতা স্বীকার করেননি, স্বাধীনতার জন্যেই তিনি বেঁচেছেন, লড়েছেন, স্বাধীনতার স্বপ্ন দু’চোখে নিয়েই তিনি নিজের জীবনকাল পূর্ণ করে পৃথিবী ছেড়েছেন। একজন মহারানা প্রতাপ মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা আদায়ে বিরামহীন প্রয়াসের মূর্ত প্রতীক। মুক্তিকামী মানুষের চিরন্তন প্রেরণার উৎস হয়েই থাকবেন তিনি।
সংগ্রামী জীবন নিয়ে গৌরবান্বিত একজন মহারানা প্রতাপ  pictur source: mmnewstv.com





Thursday, July 23, 2020

Post # 977 Bengali Amarchitra Katha 023

                                                                       ডাউনলোড করুন







ছত্রপতি শিবাজি সম্পর্কে যে কথাগুলো আপনি জানেন না

শিবাজি ভোঁসলে, যিনি ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ নামেই ছিলেন অধিক পরিচিত। বীর যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতিই শুধু নয়, নেতৃত্ব ছিল তাঁর মজ্জাগত। শিবাজি সম্পর্কে কিছু তথ্য নীচে উল্লেখ করলাম।


ধর্মনিরপেক্ষ শাসক: যে সেক্যুলারিজমের কথা আজকাল বারবার বলা হয়, শিবাজি মহারাজ প্রকৃত অর্থেই ছিলেন সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ শাসক। মুসলিমদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলতেন। তাঁর রয়াল আর্মির দেড় লক্ষ সেনার মধ্যে ৬৬ হাজার ছিলেন মুসলিম। মানুষ হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক।

ভারতীয় নৌবাহিনীর জনক: শিবাজিই প্রথম নৌবাহিনী থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। যে কারণে উপকূল অঞ্চলে দুর্গ তৈরি করে, আলাদা নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। উদ্দেশ্য ছিল, মহারাষ্ট্রের কঙ্কনের দিককে রক্ষা করা। অতীতের সাক্ষ্য বহন করে বিজয়দুর্গ, সিন্ধুদুর্গ-সহ কয়েকটি জায়গায় আজও তাঁর তৈরি সেই দুর্গগুলো রয়ে গিয়েছে।



মহিলাদের যথেষ্ট সম্মান করতেন: মহিলাদের হেনস্থা বা তাঁদের ওপর কোনওরকম হিংসার ঘটনা বরদাস্ত করতেন না। কঠোর হাতে তা দমনের পক্ষপাতী ছিলেন। অনেকের বিশ্বাস, মা জিজামাতার প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকেই তিনি মহিলাদের সম্মান করতে শিখেছিলেন। সেনাদের উদ্দেশে কঠোর নির্দেশ থাকত, একজন কোনও মহিলার ওপরও অত্যাচার করা চলবে না। কেউ নির্দেশ অমান্য করলে, কঠোর শাস্তি হত।

অবরুদ্ধ পানহালা থেকে যেভাবে পালিয়েছিলেন: পানহালার দুর্গে শিবাজিকে আটক করে রেখেছিলেন সিদ্দি জৌহরের সেনারা। তাদের চোখে ধুলো দিতে বারবের শিবা নহভিকে তিনি কাজে লাগান। বারবেরকে দেখতে ছিল শিবাজির মতোই। এ জন্য দুটো পালকির ব্যবস্থা করেছিলেন। একটা পালকির মধ্যে ছিলেন বারবের। সিদ্দির সেনারা তাঁকেই ফলো করেন। অন্য পালকিতে চেপে দুর্গ থেকে পালিয়ে যান শিবাজি।

অনুগত আর্মির স্থপতিও শিবাজি: শিবাজির আগে তাঁর বাবা সাধারণ নাগরিক ও কৃষকদের নিয়েই যুদ্ধ করেছেন। যারা শুষ্ক মরশুমে, রাজার জন্য লড়াই করতেন। শিবাজিই প্রথম ডেডিকেটেড আর্মি তৈরি করেন। তাঁদের এ জন্য সারা বছর প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মাস গেলে বেতন দেওয়া হত।

আফজল খানের পরাজয়: আফজল খানের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য শিবাজি নিজেই সময় চেয়েছিলেন। আদিল শাহ, খানের যিনি সেনাপতি, এ জন্য শর্ত আরোপ করেন। শর্ত অনুযায়ী একটি তরোয়াল আর ফুল ছাড়া সঙ্গে কিছু রাখা যাবে না। সেই মতো আয়োজন হয়। কিন্তু শিবাজির আশঙ্কা ছিল, তাঁর ওপর হামলা হতে পারে। যে কারণে, পোশাকের নীচে বর্ম পরেছিলেন। বাঁ-হাতের মধ্যে লুকনো ছিল বাঘনখও। আফজল খানের তরোয়াল তাঁর বিশেষ কিছু ক্ষতি করতে পারেনি। উলটো দিকে, আফজল খান বিদ্ধ হয়েছিলেন বাঘনখে।

গেরিলা যুদ্ধের প্রবক্তা: শিবাজিকে বলা হত পাহাড়ি ইঁদুর। তাঁর কারণ নিজের ভূমির ভূগোলটা তিনি হাতের তালুর মতো চিনতেন। একই সঙ্গে গেরিলাযুদ্ধের প্রবক্তাও।

আগ্রা থেকে পালানো: চোখে ধুলো দিয়ে পালানোটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন শিবাজি। আগ্রা থেকেও সে ভাবেই পালিয়েছিলেন শিবাজি। আগ্রায় ঔরঙ্গজেবের দরবারে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল তাঁকে। আফগান সেনাদের সঙ্গে লড়াই ছাড়া সেখান থেকে পালনোর রাস্তা ছিল না। এরই মধ্যে পরিকল্পনা করে আগ্রার মন্দিরে নিয়মিত মিষ্টি ও ফল পাঠানোর জন্য অনুমতি আদায় করেন শিবাজি। বড় বড় বাক্স ভরে মিষ্টি যেত। একদিন তেমনই একটি মিষ্টির বাক্সে ঢুকে, দুর্গ থেকে বেরিয়ে যান।

দয়ালু রাজা: অত্যন্ত দয়ালু হওয়ায় তাঁকে 'জনতা রাজা' বলে উল্লেখ করা হতো। এমনকী শত্রুপক্ষ তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাইলে, তিনি সেই দয়াই দখাতেন।

সর্বোপরি, রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজনেই ছত্রপতি শিবাজি মহারাজকে অনেক বেশি করে মনে রাখবে। তাঁর নিজের জন্য নয়, ভারতের জন্য লড়াই করতে তাঁর সাম্রাজ্যের প্রত্যটি মানুষকে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন।











Wednesday, July 22, 2020

Post # 976 Bengali Amarchitra Katha 022

                                                                        ডাউনলোড করুন






 
বৈশাখী পূর্ণিমায় জন্ম নিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। এমন প্রচলন আছে। সেই রীতি মেনে এ বছর ৭ মে উদযাপিত হবে বুদ্ধ পূর্ণিমা। পুরাণ মতে গৌতম বুদ্ধকে ভগবান বিষ্ণুর নবম অবতার রূপে ধরা হয়। বৌদ্ধ ধর্ম মতে এই বুদ্ধ পূর্ণিমাকে বুদ্ধজয়ন্তী হিসেবে পালন করা হয়। কথিত আছে, স্বাভাবিক, সৎ ও অহিংস জীবনযাপনে গৌতম বুদ্ধ তাঁর অনুরাগীদের পঞ্চশীল তত্ব মেনে চলতে বলেছিল। তাই বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের কাছে এই পঞ্চশীল মেনে চলা আবশ্যিক। পাঁচ আচার বা পাঁচ রীতির মিশ্রন এই পঞ্চশীল।
দেখে নিন পালি ভাষায় দেওয়া সেই পাঁচ হিতোপদেশের বাংলায় অনুবাদ
1. জীবমাত্র হিংসা থেকে বিরত থাকা।
2.  চুরি করা থেকে বিরত থাকা। অর্থাৎ দেওয়া হয়নি এমন বস্তু বর্জন।
3.ব্যাভিচারী না হওয়া।
4. .  মিথ্যা না বলা
5. মাদক দ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকা
কথিত আছে, এই পঞ্চশীল তত্ত্ব মেনে চললে, মানুষকে দুখ-দুর্দশা অনেকটা কাটিয়ে তোলা সম্ভব।

গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্ম
গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্ম
গৌতম বুদ্ধ ছিলেন প্রাচীন ভারতের এক ধর্মগুরু এবং তাঁর দ্বারা প্রচারিত ধর্ম বিশ্বাস ও জীবন দর্শনকে বৌদ্ধ ধর্ম বলা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গৌতম বুদ্ধের জন্ম। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অনুগামীরা তাঁর জীবনকথা ও শিক্ষা লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর শিক্ষাগুলি প্রথম দিকে মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় চারশো বছর পর এগুলি লিপিবদ্ধ করা হয়।

গৌতম বুদ্ধের পিতা ছিলেন রাজা শুদ্ধোদন আর মাতা ছিলেন মায়াদেবী। মায়াদেবী কপিলাবস্তু থেকে পিতার রাজ্যে যাবারপথে অধুনা নেপালের অন্তর্গত লুম্বিনি গ্রামে বুদ্ধের জন্ম দেন। তাঁর জন্মের সপ্তম দিনে মায়াদেবীর জীবনাবসান হয়। পরে তিনি বিমাতা গৌতমী কর্তৃক লালিত হন। জন্মের পঞ্চম দিনে রাজা ৮ জন জ্ঞানী ব্যক্তিকে সদ্যোজাত শিশুর নামকরণ ও ভবিষ্যৎ বলার জন্য ডাকেন। তাঁর নাম দেয়া হয় সিদ্ধার্থ – যে সিদ্ধিলাভ করেছে বা যার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন বলেন, রাজকুমার একদিন সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে যাবেন এবং বোধিপ্রাপ্ত হবেন।বুদ্ধের বিবাহ সম্বন্ধে দু-ধরণের মত আছে। প্রথম মত অনুসারে ১৬ বছর বয়সে তিনি একটি প্রতিযোগিতায় তাঁর স্ত্রীকে লাভ করেন। আর একটি মত অনুসারে ২৮ বছর বয়সে তাঁকে সংসারের প্রতি মনোযোগী করার জন্য তাঁর পিতা-মাতা তাঁকে রাজকন্যা যশোধরার সাথে বিবাহ দেন।

কথিত আছে, একদিন রাজকুমার সিদ্ধার্থ বেড়াতে বের হলে ৪ জন ব্যক্তির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। প্রথমে তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ, অতঃপর একজন অসুস্থ মানুষ, এবং শেষে একজন মৃত মানুষকে দেখতে পান। তিনি তাঁর সহিস চন্নকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে, চন্ন তাঁকে বুঝিয়ে বলেন যে এটিই সকল মানুষের নিয়তি। একই দিন কিংবা অন্য একদিন তিনি দেখা পেলেন একজন সাধুর, যিনি মুণ্ডিতমস্তক এবং পীতবর্ণের জীর্ণ বাস পরিহিত। চন্নকে এঁর সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেন উনি একজন সন্ন্যাসী যিনি নিজ জীবন ত্যাগ করেছেন মানুষের দুঃখের জন্য। রাজকুমার সিদ্ধার্থ সেই রাত্রেই ঘুমন্ত স্ত্রী, পুত্র, পরিবারকে নিঃশব্দ বিদায় জানিয়ে প্রাসাদ ত্যাগ করেন। সিদ্ধার্থের এই যাত্রাকেই বলা হয় মহানিষ্ক্রমণ। তার মানে মানুষের বৃদ্ধ হওয়া, অসুস্থ হওয়া, মৃত্যু হওয়া, এবং সন্ন্যাসীদের সম্বন্ধে বুদ্ধের কোনো ধারণা ছিল না। তিনি এগুলো জানতে পেরেছেন চন্ন নামের এক ব্যক্তি থেকে।

দুঃখ ও দুঃখের কারণ সম্বন্ধে জানতে সিদ্ধার্থ যাত্রা অব্যাহত রাখেন। প্রথমে তিনি আলারা নামক একজন সন্ন্যাসীর কাছে যান। তাঁর উত্তরে সন্তুষ্ট হতে না পেরে তিনি যান উদ্দক নামক আর একজনের কাছে। কিন্তু এখানেও কোনো ফল না পেয়ে কিছু দিন যাবার পর তিনি মগধের উরুবিল্ব নামক স্থানে গমন করেন। সেখানে প্রথমে একটি উত্তর-পূর্বমুখি শিলাখণ্ডের উপর বোধিসত্ত্ব জানু পেতে বসে আপন মনেই বলেছিলেন যে, "যদি আমাকে বুদ্ধত্বলাভ করতে হয় তা হলে বুদ্ধের একটি প্রতিচ্ছায়া আমার সম্মুখে দৃশ্যমান হোক।" এই কথা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে শিলাখণ্ডের গায়ে তিন ফিট উঁচু একটি বুদ্ধের প্রতিচ্ছায়া প্রতিফলিত হলো। বোধিসত্ত্ব তপস্যায় বসার পূর্বে দৈববাণী হয় যে, "বুদ্ধত্ব লাভ করতে গেলে এখানে বসলে চলবে না; এখান থেকে অর্ধযোজন দূরে পত্রবৃক্ষতলে তপস্যায় বসতে হবে।" এরপর দেবগণ বোধিসত্ত্বকে সঙ্গে করে এগিয়ে নিয়ে যান। মধ্যপথে একজন দেবতা ভূমি থেকে একগাছা কুশ ছিঁড়ে নিয়ে বোধিসত্ত্বকে দিয়ে বলেন যে, এই কুশই সফলতার নিদর্শন স্বরূপ।

বোধিসত্ত্ব কুশগ্রহণের পর প্রায় পাঁচ শত হাত অগ্রসর হন এবং পত্রবৃক্ষতলে ভূমিতে কুশগাছটি রেখে পূর্বমুখী হয়ে তপস্যায় বসেন। কঠোর সাধনার ফলে তাঁর শরীর ভেঙ্গে যায়। কিন্তু এ তপস্যায় তিনি ভয়, লোভ ও লালসাকে অতিক্রম করে নিজের মনের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে সক্ষম হলেন। সহসা তিনি বুঝতে পারলেন এভাবে বোধিলাভ হবে না। তিনি তাই আবার খাদ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। অবশেষে কঠোর তপস্যার পর তিনি বুদ্ধত্বপ্রাপ্ত হলেন। তিনি দুঃখ, দুঃখের কারণ, প্রতিকার প্রভৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করলেন। এ ঘটনাটিই বোধিলাভ নামে পরিচিত। আক্ষরিক অর্থে "বুদ্ধ" বলতে একজন জ্ঞানপ্রাপ্ত মানুষকে বোঝায়। উপাসনার মাধ্যমে উদ্ভাসিত আধ্যাত্মিক উপলব্ধি এবং পরম জ্ঞানকে "বোধি" বলা হয়।

বুদ্ধের দর্শনের প্রধান অংশ হচ্ছে দুঃখের কারণ ও তা নিরসনের উপায়। বাসনা সর্ব দুঃখের মূল। বৌদ্ধমতে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য। এটাকে নির্বাণ বলা হয়। নির্বাণ শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিভে যাওয়া, বিলুপ্তি, বিলয়, অবসান। এ-সম্বন্ধে বুদ্ধের চারটি উপদেশ (Four Noble Truths) যা আর্যসত্য বা চতুরার্য সত্য নামে পরিচিত। বলা হচ্ছে দুঃখ একটি বাস্তবতা – যা বুদ্ধের আগেও সবারই জানার কথা। এই দুঃখের কারণ হচ্ছে কামনা-বাসনা-বন্ধন।

সকল প্রকার কামনা-বাসনা-বন্ধন থেকে মুক্তি লাভই হচ্ছে নির্বাণ। এগুলোকেই বুদ্ধের চারটি উপদেশ তথা "Four Noble Truths" বলা হয়।

বুদ্ধ পরকাল সম্বন্ধেও অনেক কিছুই বলে গেছেন। পরকাল নির্ভর করে মানুষের ইহ জন্মের কর্মের উপর। মৃত্যুর পর মানুষ ৩১ লোকভূমিতে গমন করে। এই ৩১ লোকভূমি হছে ৪ প্রকার অপায়: তীর্যক, প্রেতলোক, অসুর, নরক। ৭ প্রকার স্বর্গ: মনুষ্যলোক, চতুর্মহারাজিক স্বর্গ, তাবতিংশ স্বর্গ, যাম স্বর্গ, তুষিত স্বর্গ, নির্মানরতি স্বর্গ, পরনির্মিত বসবতি স্বর্গ। ১৬ প্রকার রুপব্রহ্মভূমি। ৪ প্রকার অরুপব্রম্মভূমি। মোট ৩১ প্রকার। এই ৩১ প্রকার লোকভুমির উপরে সর্বশেষ স্তর হচ্ছে নির্বাণ (পরম মুক্তি)। যেমন: ইহজন্মে মানুষ যদি মাতৃহত্যা, পিতৃহত্যা, গুরুজনের রক্তপাত ঘটায় তাহলে মৃত্যুর পর সেই মানুষ চতুর উপায়ে (তীর্যক, প্রেতলোক, অসুর, নরক) জন্মগ্রহণ করে, আর ইহজন্মে মানুষ যদি ভালো কাজ করে তাহলে মৃত্যুর পর সেই মানুষ বাকি ২৮ লোকভূমিতে গমন করে।

ত্রিপিটক হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মীয় পালিগ্রন্থের নাম। পালি তি-পিটক হতে বাংলায় ত্রিপিটক শব্দের প্রচলন। তিন পিটকের সমন্বিত সমাহারকে ত্রিপিটক বোঝানো হয়। পিটক শব্দের অর্থ ঝুড়ি যেখানে কোনো কিছু সংরক্ষণ করা হয়। খ্রীষ্টপূর্ব ৩য় শতকে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে ত্রিপিটক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত হয়। এই গ্রন্থের গ্রন্থনের কাজ শুরু হয়েছিল বুদ্ধের পরিনির্বানের তিন মাস পর অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে এবং সমাপ্তি ঘটে খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় ২৩৬ অব্দে। প্রায় তিনশ বছরে তিনটি সঙ্ঘায়নের মধ্যে এর গ্রন্থায়নের কাজ শেষ হয়।

বৌদ্ধ ধর্মে এই মহাবিশ্বের স্রষ্টার কোনো ধারণা নাই। বলা হয়ে থাকে বুদ্ধও নাকি স্রষ্টার প্রশ্নে নীরব ছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের ধর্মগ্রন্থকে স্রষ্টার বাণী হিসেবে বিশ্বাস করা হয় না। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে মাথায় রেখে বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসীদের প্রতি কিছু যৌক্তিক প্রশ্ন রাখা হলো (কোনো প্রকার আক্রমণ বা হেয় অর্থে নয়):

- বৌদ্ধরা জন্মান্তরবাদ তথা কর্মের উপর ভিত্তি করে জন্ম-মৃত্যু'র চক্রে বিশ্বাস করে। তাদের এও বিশ্বাস যে, গৌতম বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে গৌতম বুদ্ধ কী করে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে তিনি সত্যি সত্যি নির্বাণ লাভ করেছেন? বৌদ্ধ ধর্মে অনুসারীরাই বা কীসের উপর ভিত্তি করে তা বিশ্বাস করে। গৌতম বুদ্ধের পর আর কেউ নির্বাণ লাভ করেছেন কি-না?

- মানুষের কর্মের উপর ভিত্তি করে পুনঃ পুনঃ জন্ম-মৃত্যু হবে কি-না – কেউ নির্বাণ লাভ করবে কি-না – এগুলো কে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে?

- গৌতম বুদ্ধের সামনে শিলাখণ্ডের গায়ে তিন ফিট উঁচু একটি বুদ্ধের প্রতিচ্ছায়া কীভাবে প্রতিফলিত হলো, দৈববাণী এবং দেবগণ কোথা থেকে এলো, আর গৌতম বুদ্ধ জ্ঞান লাভই বা করলেন কোথা থেকে?

- স্বর্গ, নরক, অসুর, প্রেতলোক, ইত্যাদির অবস্থান কোথায় এবং এগুলোকে কে সৃষ্টি করেছে?

- বৌদ্ধ ধর্ম অনুযায়ী খুনি, ধর্ষক, যুদ্ধাপরাধী, সন্ত্রাসী, ও অন্যান্য বড় বড় অপরাধী যারা ইতিমধ্যে মারা গেছে তাদের বিচার ও তদনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা কে ও কীভাবে করবে? তাদের হাতে যারা বলি বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদেরই বা কী হবে? তারা কি কখনোই ন্যায়বিচার পাবে না? কে ও কীভাবে তাদের ন্যায়বিচার করবে?

- জীব হত্যা মহা পাপ – ভাল কথা। কিন্তু কেউ এই মহা পাপ করে ফেললে বৌদ্ধ ধর্ম অনুযায়ী তার কোনো বিচার বা শাস্তির ব্যবস্থা আছে কি-না?







Sunday, July 19, 2020

Post # 975 Bengali Amarchitra Katha 021

                                                                     ডাউনলোড করুন                                                                   
                         


ইতিহাসে যে কজন প্রাচীন পণ্ডিত অমর হয়ে আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন চাণক্য। এই উপমহাদেশ তো বটেই সারা বিশ্বে তাকে অন্যতম প্রাচীন এবং বাস্তববাদী পণ্ডিত মনে করা হয়। মহাকবি কালিদাস যুগেরও অনেক আগে আবির্ভূত এই পণ্ডিত তার সময়ে থেকেই ভবিষ্যৎ দেখতে পেরেছিলেন। লিখে গেছেন অমর সব তত্ত্বগাথা।

যিনি চাণক্য তিনিই কৌটিল্য চাণক্য [খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০ থেকে ২৮৩ অব্দ] ছিলেন প্রাচীন ভারতের পণ্ডিত, দার্শনিক ও রাজ উপদেষ্টা। প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রাচীন তক্ষশীলা বিহারের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যক্ষ ছিলেন। মৌর্য রাজবংশের প্রথম রাজা চন্দ্রগুপ্তের রাজক্ষমতা অর্জন ও মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পেছনে তার অবদান অনস্বীকার্য। দার্শনিক প্রজ্ঞা আর কূটনৈতিক পরিকল্পনায় সিদ্ধহস্ত এই অসাধারণ প্রতিভাধর মানুষটির জন্ম বর্তমান পাকিস্তানের তক্ষশীলায়, যেখানে উপমহাদেশে উচ্চতর জ্ঞান আহরণের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপীঠ অবস্থিত ছিল। রাজনৈতিক দর্শনের বাস্তব চর্চা ও রাষ্ট্রীয় কৌশলের প্রয়োগপদ্ধতির নির্দেশনা দানে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাসে তার অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। মহাজ্ঞানী চাণক্যের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল বিষ্ণুগুপ্ত। এ ছাড়া তার বিখ্যাত ছদ্মনাম ‘কৌটিল্য’। আবার কারও কাছে তার নামই বিষ্ণুগুপ্ত। কৌটিল্য নামেই তিনি সংস্কৃত ভাষার অমরগ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’ লিখে গেছেন। রাষ্ট্রশাসন ও কূটনৈতিক কৌশলের ক্ষেত্রে এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা শাস্ত্র মানা হয়। যেহেতু তিনি ‘কুটিলা গোত্র’ থেকে উদ্ভূত ছিলেন তাই সেটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি ‘কৌটিল্য’ ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। অন্যদিকে তার সবচেয়ে পরিচিত ও প্রিয় নাম ‘চাণক্য’ এর উদ্ভব ‘চানকা’ থেকে। চানকা হচ্ছে তার গ্রামের নাম। এই গ্রামেই তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মতান্তরে তার পিতার নাম ‘চানক’ থেকে ‘চাণক্য পণ্ডিত’ হিসেবে সর্বত্র পরিচিত হয়ে ওঠেন চাণক্য। তাকে বিষ্ণুগুপ্ত নামেও ডাকা হয়।

চূড়ান্ত পাণ্ডিত্য
চাণক্য কী পরিমাণ জ্ঞানী ও পণ্ডিত ছিলেন তার শাস্ত্র পড়লেই সে সম্পর্কে একটি ধারণা করা যায়। তিনি একাধারে একজন শিক্ষক, লেখক, দার্শনিক, শাসক এবং কূটনীতিবিদ ছিলেন। তার সমাজ ও জীবন সম্পর্কিত বক্তব্যগুলো আজকের আধুনিক জীবনেও সমানভাবে প্রযোজ্য। তিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম প্রবক্তা। তার ‘অর্থশাস্ত্র’ (Arthashastra) গ্রন্থে তিনি চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন একটি রাষ্ট্র কীভাবে গড়ে ওঠে এবং পরিণতি লাভ করে। তিনি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন কীভাবে একজন শাসককে নিজস্ব ভূখণ্ডের সীমানা পেরিয়ে আরও ভূখণ্ড ও মূল্যবান সম্পদ নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করতে হয়। একইভাবে সম্পদ ও সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে তার প্রজাদের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও জীবনমান উন্নত করার জন্য কী কী কাজ করা যেতে পারে, সেসব বিষয়ও পুঙ্খানুপুঙ্খ লিপিবদ্ধ করেন চাণক্য। তার অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি নামে অর্থশাস্ত্র হলেও এটি মূলত শাসকের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রশাসন ও কূটনীতিবিষয়ক কৌশলের পরামর্শ। আর তৎকালীন সময়ের রাজা-মহারাজারা তাদের রাজদরবারে এরকম একজন দুজন পণ্ডিতকে সব সময়ই প্রাধান্য দিতেন। কাজেই জ্ঞানের ক্ষেত্রে এবং গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারণী ক্ষেত্রে এসব পণ্ডিতের দারুণ ভূমিকা ছিল। সেই অর্থে বলা যেতেই পারে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র পরবর্তীকালের রাজাদের রাষ্ট্র পরিচালনা ও জনকল্যাণমূলক রাজ্য গড়ে তোলার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা দিতে সমর্থ হয়েছিল। এর প্রমাণ পরবর্তী সময়ের প্রজাবৎসল শাসকদের রাজ্যশাসন ও রাজ্য পরিচালনা নীতি। স্পষ্টতই তাদের সেই সময়ের শাসনে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের বড় একটি ছাপ পড়েছে। চাণক্য-সহায়তায় মৌর্যশাসন প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ২৪ বছর শাসনকাল যেমন বর্ণিল ছিল, তেমনি দ্বিতীয় প্রজন্ম বিন্দুসারার সমৃদ্ধিময় জনপ্রিয়তার পেছনেও ছিল চাণক্যের অবদান।

চাণক্যের ভালো থাকার ৪ সূত্র
সার্বিক প্রয়োজনে অনেক বিষয় নিয়েই লিখেছেন চাণক্য। কিন্তু মানুষ মাত্রই ভালো থাকতে চায়। ভালো থাকার জন্য চাণক্য কিছু উপায় বাতলে দিয়েছেন।
১) টাকা-পয়সার নিদারুণ সংকট থাকলে কাউকে কখনো বলতে নেই। কারণ এ সময় কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না, আবার কপট সাহায্যের আশ্বাস দেয়। কারণ তার মতে দরিদ্ররা সমাজে তেমন মর্যাদা পায় না। তাই তাদের নিজের সম্পদ নিজের কাছেই রাখা উচিত।
২) মহামতি চাণক্যর মতে ব্যক্তিগত সমস্যা কখনো কাউকে বলতে নেই। যারা বলে তারা অন্যের কাছে নীচু ও বিরক্তিকর হিসেবে গৃহীত হয়, আড়ালে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। নিজের স্ত্রী সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতে নেই। এসব বললে মানুষ মনে করে কিছু একটা অভিপ্রায় নিয়ে তা বলা হচ্ছে। যা পরবর্তীতে ভয়ঙ্কর ফল নিয়ে আসতে পারে। জ্ঞানী ব্যক্তির মতো মৃত্যু পর্যন্ত তা নিজের কাছে রেখে দেওয়া উচিত।
৩) যদি কখনো নীচপদস্থ ব্যক্তি দ্বারা অপমানের স্বীকার হওয়া যায়, তাহলে তা অন্যদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করাটাই ভালো। তাহলে মানুষ বক্তার সামনেই তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতে পারে। ফলে তা মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানতে পারে।
৪) আদর দেওয়ার অনেক দোষ, শাসন করার অনেক গুণ। তাই পুত্র ও শিষ্যকে শাসন করাই দরকার, আদর দেওয়া নয়। পাঁচ বছর বয়স অবধি পুত্রদের লালন করবে, ১০ বছর অবধি তাদের চালনা করবে, ১৬ বছরে পড়লে তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করবে। পুত্রকে যারা পড়ান না, সেই পিতা-মাতা তার শত্রু। একটি চন্দ্রই অন্ধকার দূর করে, সব তারা মিলেও তা পারে না। তেমনি একটি গুণী পুত্র একশত মূর্খ পুত্রের চেয়ে ভালো।

নীতির দর্পণ সারাংশ
চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী হওয়ার পর প্রাসাদের জীবন ছেড়ে কুঁড়েঘরের সন্ন্যাসী জীবন বেছে নিয়েছিলেন চাণক্য। সেখানে শিষ্যদের নানা বিষয়ে  নৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। এসব বিষয়ের কিছু কিছু তার অন্যান্য বিবরণীতে সংগৃহীত হয়েছে। এ ধরনের একটি সংকলন- ‘চাণক্য নীতি দর্পণ’। চলুন দেখে নেওয়া যাক চাণক্যের নীতির  দর্পণ সারাংশ।
১) যে রাজা শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন না এবং শুধু অভিযোগ করেন যে তার পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তাকে সিংহাসনচ্যুত করা উচিত।
২) সব উদ্যোগ নির্ভর করে অর্থের ওপর। সে জন্য সবচেয়ে  বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত খাজাঞ্চিখানার দিকে। তহবিল তছরুপ বা অর্থ আত্মসাতের ৪০টি পদ্ধতি আছে। জিহবার ডগায় বিষ রেখে যেমন মধুর আস্বাদন করা সম্ভব নয়, তেমনি কোনো রাজকর্মচারীর পক্ষে রাজার রাজস্বের সামান্য পরিমাণ না খেয়ে ফেলার ঘটনা অসম্ভব ব্যাপার। জলের নিচে মাছের গতিবিধি যেমন জল পান করে বা পান না করেও বোঝা সম্ভব নয়, অনুরূপ রাজকর্মচারীর তহবিল তছরুপও দেখা অসম্ভব। আকাশের অতি উঁচুতেও পাখির উড্ডয়ন দেখা সম্ভব, কিন্তু রাজকর্মচারীর গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সমভাবে অসম্ভব।
৩) বিষ থেকে সুধা, নোংরা স্থান থেকে সোনা, নীচ কারও থেকে জ্ঞান এবং নিচু পরিবার থেকে শুভলক্ষণা স্ত্রী এসব গ্রহণ করা সংগত।
৪) মনের বাসনাকে দূরীভূত করা উচিত নয়। এই বাসনাগুলোকে গানের গুঞ্জনের মতো কাজে লাগানো উচিত।
৫) যারা পরিশ্রমী, তাদের জন্য কোনো কিছুই জয় করা অসাধ্য কিছু নয়। শিক্ষিত কোনো ব্যক্তির জন্য কোনো দেশই বিদেশ নয়। মিষ্টভাষীদের কোনো শত্রু নেই।
৬) বিরাট পশুপালের মাঝেও শাবক তার মাকে খুঁজে পায়। অনুরূপ যে কাজ করে অর্থ সব সময় তাকেই অনুসরণ করে।
৭) মন খাঁটি হলে পবিত্র স্থানে গমন অর্থহীন।

মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা
চাণক্যের উত্থান কিংবদন্তি গল্প হলেও ঐতিহাসিক সত্যতা আছে বলেই মানেন অধিকাংশ ঐতিহাসিক। সে সময় মগধ রাজ্যের পরাক্রমশালী নন্দ বংশের শেষ রাজা ছিলেন ধনানন্দ। তিনি ন্যায়বিচারক ছিলেন না। তার অন্যায় শাসনের জন্য প্রজাদের কাছে দারুণ অপ্রিয় ছিলেন। এই ধনানন্দ একবার চাণক্যকে অপমান করেন। ধনানন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার জন্য একজন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন পড়লে ধনানন্দের মন্ত্রী শকটা ব্রাহ্মণ খোঁজার দায়িত্ব নেন। তিনি চাণক্যকে ধনানন্দের পিতৃশ্রাদ্ধের পুরোহিত হওয়ার অনুরোধ জানান। সে অনুযায়ী চাণক্য যথাসময়ে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে পুরোহিতের আসন গ্রহণ করেন। চাণক্যের চেহারা তেমন ভালো ছিল না। পুরোহিতের আসনে কদাকার ব্রাহ্মণ চাণক্যকে দেখে মহারাজ ধনানন্দ গেলেন রেগে। অযথাই চাণক্যকে তিরস্কার করে বের হয়ে যেতে বলেন। চাণক্য প্রথমে মহারাজাকে হিতবাক্যে বুঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু রাজা ধনানন্দ কিছু না শুনে উল্টো অন্যদের দিয়েও চাণক্যকে অপমান করেন। এবার ক্রুদ্ধ হলেন চাণক্য। সেখান থেকে চলে আসেন এবং এই অপমানের প্রতিশোধ  নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। অন্যদিকে রাজা ধনানন্দের সত্ভাই (পিতা মহাপদ্মের ঔরসে দাসী ‘মুরা’র গর্ভজাত) পদস্থ ও উচ্চাভিলাষী তরুণ সামরিক কর্মকর্তা চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসন দখলের পরিকল্পনা করছিলেন। কারণ পিতা মহাপদ্মের মৃত্যুর পর রাজা ধনানন্দ দাসীমাতা মুরা ও সত্ভাই চন্দ্রগুপ্তকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অপমানিত চন্দ্রগুপ্ত তাই  ধনানন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসন দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে প্রাণ বাঁচাতে তাকে বিন্ধালের জঙ্গলে পলাতক ও নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে হয়। তখনই  ঘটনাচক্রে চাণক্যের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের সাক্ষাৎ ঘটে। এই সাক্ষাৎ যে ইতিহাসের বাঁক বদলে দেবে কে জানত?
চাণক্য চন্দ্রগুপ্তের প্রতিশোধপরায়ণতা আর সিংহাসনের বাসনাকে কাজে লাগাতে চাইলেন। অন্যদিকে চন্দ্রগুপ্তও চাণক্যের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হলেন। ফলে চন্দ্রগুপ্ত তার জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য চাণক্যকে গুরু, উপদেষ্টা ও মন্ত্রণাদাতা হিসেবে স্বীকার করেন। এরপর চাণক্যের সক্রিয় সহযোগিতায় চন্দ্রগুপ্ত একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে পরিকল্পনাকে আরও বেশি নিখুঁত করে তোলেন চাণক্য। চাণক্যের পাণ্ডিত্য আর চন্দ্রগুপ্তের বীরত্বে শেষ পর্যন্ত সিংহাসনচ্যুত হলেন নন্দরাজা। মগধের সিংহাসনে আরোহণ করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠা  করেন। এই বংশই পরবর্তীতে ভারতীয় ইতিহাসে শক্তিশালী মৌর্য সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হয়। আর এই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যেরই দ্বিতীয় পুরুষ হচ্ছেন বিন্দুসারা এবং তৃতীয় প্রজন্ম আরেক প্রতাপশালী শাসক সম্রাট অশোক। তিনিও ভারতবর্ষের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন।

বৈচিত্র্যময় জীবন
চন্দ্রগুপ্ত মগধের সিংহাসনে আরোহণ করার পর পাটালিপুত্রকে তার রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত করেন। এই পাটালিপুত্র বিহারের আধুনিক শহর পাটনার কাছেই অবস্থিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৯৮ সাল পর্যন্ত চন্দ্রগুপ্ত রাজ্য শাসন করেন। তার সময়কালে রাজ্যজুড়ে শান্তি বিরাজমান ছিল, প্রজাদের প্রতি তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ এবং রাজ্য বিকশিত হয়েছিল সমৃদ্ধিতে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করে গেছেন চন্দ্রগুপ্তের দরবারে গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস তার ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে। চাণক্য তার জীবদ্দশায়, এমনকি মৃত্যুর পরও ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও পণ্ডিত হিসেবে সর্বজনশ্রদ্ধেয় একটি অবস্থান ধরে রেখেছেন। টিকে আছেন তার কর্মবহুল জীবনের কর্ম ও সৃষ্টির মাধ্যমে। কর্মজীবনের শুরুতেই  তিনি পাঞ্জাবকে বিদেশি শাসনমুক্ত করতে রাজাকে সাহায্য করেন। এরপর অযোগ্য শাসক নন্দ রাজাকে উত্খাত করে চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের সঙ্গে আরও রাজ্য যুক্ত করেন এবং সাম্রাজ্যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তার ভূমিকা পালন করেন। কেবল চন্দ্রগুপ্তের আমলই নয়, পরবর্তীকালের ভারতীয় সম্রাটদের শাসন কৌশলে দারুণভাবে প্রভাব পড়ে চাণক্য নীতির। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে মৌর্য বংশের তৃতীয় শাসক সম্রাট অশোকের শাসন। এই সময়টি এতটাই পরিশীলিত ছিল যে বর্তমান ভারতের রাষ্ট্রীয় মনোগ্রামেও প্রাচীন ও গভীর ঐতিহ্যবাহী অশোক-স্তম্ভের উপস্থিতি রয়ে গেছে।
এমনকি এরও পরে বিক্রমাদিত্যের শাসনকালের কিংবদন্তীয় উপকথাগুলোর জনপ্রিয় লোকভাষ্য থেকেও তা ধারণা করা যায় হয়তো। এই বিজ্ঞ ও বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন দার্শনিক ধর্ম, নীতিশাস্ত্র, সামাজিক আচরণ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করেছেন। চাণক্যের কথাগুলো আধুনিক যুগের পরিশীলিত কথাবার্তা থেকে ভিন্ন হলেও আজকের দিনেও ঠিক একই তাৎপর্য বহন করে।
এরকম জ্ঞানী একটা মানুষ কিন্তু শারীরিকভাবে খুব একটা সবল ছিলেন না। দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। তবে সব ছাপিয়ে এই বিজ্ঞ ও বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন পণ্ডিতের সমাজ, সংসার, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি সম্পর্কিত নীতি কথাগুলো হাজার বছর পরেও গুরুত্ব হারায়নি।

প্রাসাদ ছেড়ে শ্মশানের জীবন
মগধের সিংহাসনে চন্দ্রগুপ্ত আরোহণের পর যথারীতি চাণক্যের সম্মান-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেল অনেকগুণ। গুরু এবং নির্ভরযোগ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে  জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদে বিলাসবহুল জীবনযাপনের অবারিত সুযোগ পেলেন চাণক্য। কিন্তু ওসবে কী আর পণ্ডিতের মন ভরে? কথিত আছে, এমন বিলাসী জীবনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চাণক্য শ্মশানবর্তী খুব সাধারণ একটি কুঁড়েঘরে নির্মোহ সন্ন্যাস জীবনযাপন করতেন। ওখানে থেকেই বিশ্বস্ততার সঙ্গে রাজপ্রদত্ত দায়িত্বপালন করতেন। পাশাপাশি সেখানেই নিজের শিষ্যদের রাজ্য পরিচালনা ও নৈতিকতার শিক্ষা দিতেন। চাণক্যের সেই নীতি আর দর্শন হাজার বছর পরও আধুনিক। এর বাইরে অসাধারণ দক্ষ পরিকল্পনাবিদ হিসেবে চাণক্যের খ্যাতি অসাধারণ। সিদ্ধান্তে অটলস্বভাবী চাণক্যের কাছে আবেগের কোনো মূল্য ছিল না। নিজস্ব পরিকল্পনা উদ্ভাবন ও তা বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন কঠোর।

চাণক্য শ্লোক
বাস্তববাদী চাণক্যের অর্থনীতি, রাজনীতি, জীবনযাপন ইত্যাদি নিয়ে বলা কথাগুলো ‘চাণক্য শ্লোক’ নামে পরিচিত। সূদীর্ঘ আড়াই বছর পরেও কথাগুলোর গুরুত্ব হারিয়ে যায়নি। কথিত হয় যে, এখনো ভারতের রাজনীতি অনেকাংশে চাণক্যনীতি অনুযায়ী চলমান। চাণক্যের নীতি পৃথিবীর বহুভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রশংসিত হয়েছে বহু দেশে। হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও তার নীতি এখনো সমানভাবে কার্যকর। সেখান থেকেই কয়েকটি শ্লোক দেখে নেওয়া যাক।

♦ দুর্বলের বল রাজা, শিশুর বল কান্না, মূর্খের বল নীরবতা, চোরের মিথ্যাই বল।
♦ দুষ্ট স্ত্রী, প্রবঞ্চক বন্ধু, দুর্মুখ ভৃত্য এবং সসর্প-গৃহে বাস মৃত্যুর দ্বার, এ বিষয়ে সংশয় নেই।
♦ পাপীরা বিক্ষোভের ভয় করে না।
♦ আকাশে উড়ন্ত পাখির গতিও জানা যায়, কিন্তু প্রচ্ছন্ন প্রকৃতি-কর্মীর গতিবিধি জানা সম্ভব নয়।
♦ অতি পরিচয়ে দোষ আর ঢাকা থাকে না।
♦ অধমেরা ধন চায়, মধ্যমেরা ধন ও মান চায়। উত্তমেরা শুধু মান চায়। মানই মহতের ধন।
♦ অনেকে চারটি বেদ এবং ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করলেও আত্মাকে জানে না, হাতা যেমন রন্ধন-রস জানে না।
♦ অন্তঃসার শূন্যদের উপদেশ দিয়ে কিছু ফল হয় না, মলয়-পর্বতের সংসর্গে বাঁশ চন্দনে পরিণত হয় না।
♦ আপদের নিশ্চিত পথ হলো ইন্দ্রিয়গুলোর অসংযম, তাদের জয় করা হলো সম্পদের পথ, যার যেটি ঈঙ্গিত সে সে পথেই যায়।
♦ আড়ালে কাজের বিঘ্ন ঘটায়, কিন্তু সামনে ভালো কথা, যার উপরে মধু কিন্তু অন্তরে বিষ, তাকে পরিত্যাগ করা উচিত।
♦ গুরু শিষ্যকে যদি একটি অক্ষরও শিক্ষা দেন, তবে পৃথিবীতে এমন কোনো জিনিস নেই, যা দিয়ে সেই শিষ্য গুরুর ঋণ শোধ করতে পারে।
♦ অবহেলায় কর্মনাশ হয়, যথেচ্ছ ভোজনে কুলনাশ হয়, যাঞ্চায় সম্মান নাশ হয়, দারিদ্র্য বুদ্ধিনাশ হয়।
♦ অভ্যাসহীন বিদ্যা, অজীর্নে ভোজন, দরিদ্রের সভায় বা মজলিশে কালক্ষেপণ এবং বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা বিষতুল্য।
♦ ধর্মের চেয়ে ব্যবহারই বড়।
♦ বিনয়ই সবার ভূষণ।
♦ বষ থেকেও অমৃত আহরণ করা চলে, মলাদি থেকেও স্বর্ণ আহরণ করা যায়, নীচজাতি থেকেও বিদ্যা আহরণ করা যায়, নীচকুল থেকেও স্ত্রীরত্ন গ্রহণ করা যায়।
♦ ভাগবাসনায় বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়।
♦ মিত ভোজনেই স্বাস্থ্যলাভ হয়।
♦ ইন্দ্রিয়ের যে অধীন তার চতুরঙ্গ সেনা থাকলেও সে বিনষ্ট হয়।
♦ উপায়জ্ঞ মানুষের কাছে দুঃসাধ্য কাজও সহজসাধ্য।
♦ ঋণ, অগ্নি ও ব্যাধির শেষ রাখতে নেই, কারণ তারা আবার বেড়ে যেতে পারে।
♦ একটি মাত্র পুষ্পিত সুগন্ধ বৃক্ষে যেমন সমস্ত বন সুবাসিত হয়, তেমনি একটি সুপুত্রের দ্বারা সমস্ত কুলধন্য হয়।
♦ একশত মূর্খ পুত্রের চেয়ে একটি গুণীপুত্র বরং ভালো। একটি চন্দ্রই অন্ধকার দূর করে, সব তারা মিলেও তা পারে না।
♦ একটি দোষ বহু গুণকেও গ্রাস করে।
♦ একটি কুবৃক্ষের কোটরের আগুন থেকে যেমন সমস্ত বন ভস্মীভূত হয়, তেমনি একটি কুপুত্রের দ্বারাও বংশ দগ্ধ হয়।
♦ উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামকালে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে সঙ্গে থাকে, সে-ই প্রকৃত বন্ধু।
♦ কর্কশ কথা অগ্নিদাহের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
♦ খেয়ে যার হজম হয়, ব্যাধি তার দূরে রয়।
♦ গুণবানকে আশ্রয় দিলে নির্গুণও গুণী হয়।
♦ গুণহীন মানুষ যদি উচ্চ বংশেও জন্মায় তাতে কিছু আসে যায় না। নীচকুলে জন্মেও যদি কেউ শাস্ত্রজ্ঞ হয়, তবে দেবতারাও তাঁকে সম্মান করেন।
♦ অহংকারের মতো শত্রু নেই।
♦ তিনটি বিষয়ে সন্তোষ বিধেয় : নিজের পত্নীতে, ভোজনে এবং ধনে। কিন্তু অধ্যয়ন, জপ, আর দান এই তিন বিষয়ে যেন কোনো সন্তোষ না থাকে।
♦ দারিদ্র্য, রোগ, দুঃখ, বন্ধন এবং বিপদ-সব কিছুই মানুষের নিজেরই অপরাধরূপ বৃক্ষের ফল।
♦ দুর্জনের সংসর্গ ত্যাগ করে সজ্জনের সঙ্গ করবে। অহোরাত্র পুণ্য করবে, সর্বদা নশ্বরতার কথা মনে রাখবে।