Friday, March 3, 2023

Post # 1118 Bengali Amarchitra Katha 325

                                                                             ডাউনলোড করুন

 

  ১ - ১০০ মধ্যে সমস্ত বই নতুন পি ডি এফ হয়ে যাবার পর ইন্দ্রজাল কমিক্স ১০২-১৫০ লেবেলের ( ১০২ ও ১০৩ প্রকাশিত হয়নি কর্মী বিক্ষোবের জন্য ) বই গুলি এখন পি ডি এফ করার কাজ চলছে ,১০ টি বই হয়েও গেছে , আপনারা রোজ একবার এই লেবেল টি ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন ।   

 

 

জগদীশচন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ভগবানচন্দ্র বসু ইংরেজ সরকারের একজন ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। বসু পরিবারের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার অন্তর্গত বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল নামক গ্রামে।

জগদীশচন্দ্রের প্রাথমিক শিক্ষার সূত্রপাত হয় ফরিদপুর জেলার একটি গ্রাম্য বিদ্যালয়ে। এ সময় বাংলার লোক অভিনয়, যাত্রা-পালাগান এবং রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী এবং চরিত্রগুলি সম্পর্কে তাঁর গভীর আগ্রহ জাগে। তাঁর এগার বৎসর বয়সে বসু পরিবার কলকাতায় চলে যায়। সেখানে তিনি প্রথমে হেয়ার স্কুলে, পরে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে অধ্যয়ন করেন। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে ১৮৭৫ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। ১৮৭৯ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময়েই তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত রচিত হয়। রেভারেন্ড ফাদার লাফোন্ট (Rev Father Lafont)-এর উৎসাহে তিনি পদার্থ বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। লাফোন্টের উদ্যোগে তাঁকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ইংল্যান্ডে পাঠানো হয় এবং পরবর্তী বছরগুলিতে তিনি পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। তবে প্রথমে তিনি এক বৎসর চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে ট্রাইপজ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সাফল্যের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। প্রায় একই সময়ে ১৮৮৪ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এসসি ডিগ্রি লাভ করেন।

ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর জগদীশচন্দ্র বসু কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। এখানেই তাঁর শিক্ষক এবং যথার্থ অনুসন্ধানী গবেষকের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত জীবনের সূত্রপাত ঘটে। জগদীশচন্দ্র ১৮৯৪ সালের দিকে ব্যাপকভাবে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। বিদ্যুৎতরঙ্গের আলোকধর্মী প্রবণতার মধ্যে প্রতিফলন, প্রতিসরণ, সর্বমোট প্রতিফলন, সমবর্তী বিচ্ছুরণ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি গবেষণা পরিচালনা করেন। আকাশ-তরঙ্গ ও বৈদ্যুতিক চুম্বক তরঙ্গের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে জগদীশচন্দ্র বেতার বার্তার সূত্র আবিষ্কার করেন। বিনাতারে শব্দ প্রেরণের ‘ক্রিস্ট্যাল রিসিভার’ নামক যে বেতার যন্ত্রটি তিনি আবিষ্কার করেন তার সাহায্যে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রায় এক মাইল দূরে অবস্থিত তাঁর বাসভবনে সাংকেতিক শব্দ প্রেরণ করতে সক্ষম হন।এ ছাড়া তিনি নিজের উদ্ভাবিত যন্ত্রের সাহায্যে প্রমাণ করেন যে অদৃশ্য-আলোকেও দৃশ্য-আলোকের সকল ধর্ম বর্তমান।

তাঁর গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল বিশ্বের প্রধান বিজ্ঞান সাময়িকীগুলিতে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে দি ইলেক্ট্রিশিয়ান, প্রসিডিংস অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি, জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল এবং দ্য ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন এর মতো বিখ্যাত সাময়িকী ও জার্নালগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সকল গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করেই ১৮৯৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.এসসি ডিগ্রি প্রদান করে। ক্ষুদ্র শব্দতরঙ্গ সৃষ্টি সম্পর্কিত তাঁর গবেষণা থেকে আধুনিক তরঙ্গপথের ধারণার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাঁর পরিচালিত গবেষণা ও আবিষ্কৃত যন্ত্রসমূহের সঙ্গে রাডার প্রযুক্তি উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ের যন্ত্রসমূহের ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য রয়েছে।

১৮৯৯ থেকে ১৯০৭ পর্যন্ত সময়ব্যাপী জগদীশ বসু জীব ও জড়ের উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে গভীর অধ্যয়ন ও গবেষণায় ব্যাপৃত থাকেন। বৈদ্যুতিক তরঙ্গ গ্রহণকারী বা ‘কোহেরারস’ (coherers)-এর কার্যকারিতা কমে যাওয়া আবার কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর কার্যকর হওয়া সম্পর্কিত পূর্ববর্তী গবেষণাগুলির গভীর পর্যবেক্ষণ তাঁকে নতুন করে এ ক্ষেত্রটি সম্পর্কে খুবই উৎসাহী করে তুলেছিল। ওয়ালার-এর তত্ত্বের প্রতিবিধান অনুসারে বৈদ্যুতিক উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়ার সামর্থ্যকে প্রাণশক্তি উন্মেষের বিশ্বজনীন চিহ্ন হিসেবে পরিগণিত করা যেতে পারে। বসু পরীক্ষার মাধ্যমে প্রদর্শন করেন যে, জীব ও জড় বস্ত্তর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহ তাদের আণবিক গঠনে একই রূপ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এ ধরনের কিছু ধারাবাহিক গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে প্রাণীদেহ এবং শাকসবজির কোষকলাসমূহ বৈদ্যুতিক ক্রিয়া দ্বারা উদ্দীপ্ত হয় ও সাড়া দেয়। এ ছাড়া তাপ, ঔষধ, রাসায়নিক দ্রব্য এবং যান্ত্রিক চাপেও একইভাবে এরা উদ্দীপ্ত হয়। তিনি আরও দেখিয়েছেন, একইভাবে নির্দিষ্ট কিছু অজৈব পদার্থেও সমরূপ উদ্দীপনা ঘটানো যেতে পারে। তাঁর এ গবেষণাকর্ম বিখ্যাত বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। প্রসিডিংস অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি সাময়িকীটিতে ‘জীব ও জড়ের সাড়া দেয়ার শক্তি’ (Response in the Living and Non-Living) শিরোনামে তাঁর এ সংক্রান্ত সকল লেখা সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হয়।

উদ্ভিদ জগতের সংবেদনশীলতা বিষয়ক গবেষণার পর জগদীশচন্দ্র আত্মনিয়োগ করেন প্রাণ-পদার্থবিদ্যা এবং উদ্ভিদ-শরীরতত্ত্ব বিষয়ক গবেষণায়। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর পদার্থবিদসুলভ গভীর দৃষ্টি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও দক্ষতার কার্যকরী প্রয়োগ ঘটান। তিনি কিছুসংখ্যক অজৈব পদার্থের মডেল তৈরি করেন যা প্রাণী ও উদ্ভিদের কোষকলাসমূহের মতো নির্দিষ্ট উদ্দীপকের প্রতি সমরূপ সাড়া প্রদান করে। এধরনের একটি মডেল তৈরি করা হয় নরম লৌহদন্ডের উপর তার পেঁচিয়ে, একটি বিদ্যুৎপ্রবাহ উৎস এবং একটি গ্যালভানোমিটার সংযুক্ত করে। প্রাণীর স্নায়ুতে পরিচালনের ফলে সৃষ্ট আন্দোলন গ্যালভানোমিটার দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। জগদীশ বসু উদ্ভাবিত বিভিন্ন যন্ত্রের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যন্ত্রটির নাম ক্রেসকোগ্রাফ। এটি সামান্য নড়াচড়াকে ১ কোটি গুণ বিবর্ধিত করতে পারে। পরিবাহিতা পরিমাপক, ট্রান্সপিরোগ্রাফ, ফটোসিনথেটিক গ্রাহক এবং চৌম্বক রেডিওমিটার তাঁর উদ্ভাবিত অন্যান্য যন্ত্র। জগদীশচন্দ্রের বিস্ময়কর কর্মউন্মাদনা এবং একাগ্রচিত্ত বিজ্ঞান সাধনার ফলেই এসব গবেষণা কর্ম সম্পাদন করা সম্ভব হয়েছিল। ১৯০৮ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অসংখ্য গবেষণা প্রতিবেদন ও প্রবন্ধ রচনা করেন।

জগদীশচন্দ্র বসু ১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি এমিরিটাস প্রফেসর পদ লাভ করেন। ১৯১৭ সালে উদ্ভিদ-শরীরতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি কলকাতায় ‘‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে এখানে উদ্ভিদ ও কৃষি রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞান এবং নৃতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণার জন্য উল্লিখিত বিষয়সমূহের বিভাগ খোলা হয়। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র আমৃত্যু এখানে গবেষণাকার্য পরিচালনা করেন।

জগদীশচন্দ্র ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং সেখানকার বিদগ্ধ বিজ্ঞানীদের নিকট তিনি তাঁর গবেষণালব্ধ ফলাফল তুলে ধরেন। এসময়ে কিছুকাল (১৯০০-১৯০২) তিনি লন্ডনের বিখ্যাত রয়্যাল ইনস্টিটিউটে কর্মরত ছিলেন। ১৯১৬ সালে জগদীশচন্দ্র বসু ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯২০ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের ফেলো নির্বাচিত হন এবং ১৯২৮ সালে ভিয়েনা একাডেমী অব সায়েন্সের করেসপন্ডিং সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন বিজ্ঞান সমিতির সম্মানিত সদস্য ছিলেন। স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের ১৯২৭ কার্যবর্ষে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ঐ সময়ে লীগ অব নেশন্স-এর বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেস-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, যার বর্তমান নাম ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমী। তিনি কিছুকাল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধাবলী অব্যক্ত নামক গ্রন্থে সংকলিত। তাঁর ইংরেজি রচনাবলি হচ্ছে: Responses in the Living and Non-living (1902), Plant Responses as a Means of Physiological Investigations (1906), Comparative Electrophysiology (1907), Physiology of the Asent of Sap (1923), Physiology of Photosynthesis (1924), Nervous Mechanism of Plants (1925), Collected Physical Papers (1927), Motor Mechanism of Plants (1928), Growth and Tropic Movement in Plants (1929)। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ বিজ্ঞানী তাঁর সুদীর্ঘ কর্মময় জীবন শেষে ১৯৩৭ সালে গিরিডিতে মৃত্যুবরণ করেন।

আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু কে বলা হয় বিশ্বের অন্যতম বিজ্ঞান পথিকৃৎ। বলা হয়ে থাকে তিনি নাকি সময়ের আগেই পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। তার যথার্থ বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন এখনো করা সম্ভব হয়নি।







 

Thursday, March 2, 2023

Post # 1117 Bengali Amarchitra Katha 324

                                                                             ডাউনলোড করুন

 নহুশ ছিলেন  বিখ্যাত রাজা , যযাতির পিতা – পাণ্ডব ও কৌরবদের পিতৃপুরুষ। নহুষ ধার্মিক ও যশস্বী ছিলেন। ইন্দ্র যখন ত্রিশিরা ও বৃত্র বধের পর ব্রহ্মহত্যা ও মিথ্যাচার করেছেন বলে অবেচতনপ্রায় হয়ে জলের মধ্যে আত্মগোপন করেছিলেন, তখন দেবতা ও ঋষিরা নহুষকে ইন্দ্রত্ব নিতে বলেন। ধর্মানুসারে সর্বলোক শাসন করেতে শুরু করলেও নহুষ পরে বিলাসী ও কামপরায়ণ হয়ে পড়লেন। তিনি চাইলেন যে, ইন্দ্রপত্নী শচী এখন থেকে তাঁর সেবা করবেন। শচী ভীতা হয়ে দেবগুরু বৃহষ্পতির কাছে আশ্রয় নিলেন। দেবতা আর ঋষিরা ওঁকে পরস্ত্রী-কামনা করা থেকে নিবৃত হতে বললে, নহুষ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন যে, তাঁরা যখন এতদিন ইন্দ্রের কামাচরণে কোনও দোষ দেন নি, তখন ওঁর আচরণেও দোষ দিতে পারবেন না। দেবতারা তখন সংকটে পরে বৃহষ্পতিকে বললেন, শচীকে নহুষের হাতে সমর্পণ করতে। ক্রন্দনরতা শচীকে বৃহষ্পতি অভয় দিয়ে বললেন যে, শচী নহুষের কাছে গিয়ে কিছু সময় প্রার্থনা করুন। নহুষকে বলুন যে, এই সময়ের মধ্যে যদি ইন্দ্রের কোনও খবর না পাওয়া যায়,তাহলে শচী নিশ্চয় নহুষের সেবায় ব্রতী হবেন। শচী নহুষকে এই কথা বলাতে তিনি তাতে সন্মত হলেন। দেবতারা তখন বিষ্ণুকে জিজ্ঞেস করলেন, ইন্দ্র কি করে তাঁর ইন্দ্রত্ব ফিরে পেতে পারেন। বিষ্ণু বললেন যে,অশ্বমেধ যজ্ঞে বিষ্ণুর পূজা করলেই ইন্দ্র পাপমুক্ত হয়ে আবার তাঁর রাজত্ব ফিরে পাবেন। দেবগণ তখন বৃহষ্পতির সাহায্য নিয়ে সেইমত যজ্ঞ করলেন। যজ্ঞ শেষ হলে বিপন্ন শচী উপশ্রুতি নাম্নী রাত্রীদেবীর উপাসনা করে তাঁর সাহায্য নিয়ে ইন্দ্রের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ইন্দ্রকে বললেন যে, তিনি যদি এখন স্বমূর্তি না ধারণ করেন, তাহলে শচীকে নহুষের অধীন হতে হবে। ইন্দ্র শচীকে আশ্বস্ত করে বললেন নহুষকে গিয়ে বলতে যে, নহুষ যদি ঋষিবাহিত শিবিকায় শচীর কাছে আসেন, তাহলে শচী সানন্দে ওঁর বশগামিনী হবেন। শচীর কথা শুনে নহুষ উৎফুল্ল হয়ে দেবর্ষি আর মহর্ষিদের নিযুক্ত করলেন ওঁর শিবিকা বহন করার জন্য। ওঁরা যখন শিবিকা বাহন করছেন তখন ধর্ম-প্রসঙ্গে নহুষের সঙ্গে ঋষিদের তর্ক শুরু হল। নহুষ বিবাদ করতে করতে পা দিয়ে অগস্ত্য মুনির মস্তক স্পর্শ করতেই অগস্ত্য তাঁকে অভিশাপ দিলেন যে, নহুষ ব্রহ্মার তুল্য ঋষিগণকে বাহন করেছেন, চরণ দিয়ে ওঁর মস্তক স্পর্শ করেছেন,এবং ধর্ম সম্পর্কে অন্যায় উক্তি করেছেন – এই তিন কারণে ওঁকে স্বর্গচ্যূত হয়ে মহীতলে পতিত হতে হবে। সেখানে সর্প রূপে দুই সহস্র বছর থাকার পর ওঁর বংশজাত যুধিষ্ঠিরকে দেখলে আবার স্বর্গে ফিরে আসতে পারবেন। এই ঘটনার দুই সহস্র বছর পরে বিশাখযূপ নামক বনে ভীমকে এক অজগর বেষ্টন করে ধরেন। মহাবলশালী হয়েও ভীম নিজেকে মুক্ত করতে পারলেন না। এই সময়ে যুধিষ্ঠির সেখানে এলে সর্পরূপধারী নহুষ শাপমুক্ত হন।






 

Wednesday, March 1, 2023

Post # 1116 Bengali Amarchitra Katha 323

                                                                            ডাউনলোড করুন

 

 

সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত সম্ভাব্য ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন এবং ৩৮০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে তাঁর মৃত্যু হয়। প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সম্রাটের ইতিহাস পুনর্গঠনের বেশ কিছু উপাদান রয়েছে। এগুলাের মধ্যে রাজকবি হরিষেণ রচিত ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’, এরন, নালন্দা ও গয়ালিপি, পাঁচ ধরনের মুদ্রা, চৈনিক বিবরণ, পুরাণ, স্মৃতিশাস্ত্র, ‘কৌমুদী মহােৎসব’ নামক একটি নাটিকা, কালিদাসের ‘রঘুবংশম’ ইত্যাদি বিখ্যাত। এ সকল উপাদানের মধ্যে ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে ঐতিহাসিক মহলে সমাদৃত। এলাহাবাদের দুর্গে রক্ষিত এই প্রশস্তিখানি সম্ভবত সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পরই উত্তীর্ণ করা হয়েছিল। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, সমুদ্রগুপ্তের দক্ষিণ ভারত বিজয়ের পর এটি রচিত হয়। প্রশঙুিটি আংশিক পদ্যে, আংশিক গদ্যে রচিত। হরিষেণ যেহেতু সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি সেহেতু তাঁর বর্ণিত দিগ্বিজয় কাহিনীতে কিছু অতিশয়ােক্তি থাকতে পারে। অলংকৃত সংস্কৃতে রচিত এই লিপিটির ছত্রে ছত্রে সমুদ্রগুপ্তের ‘সাম্রাজ্যবাদী দম্ভ’ ছড়িয়ে আছে বলে ড. কোশাম্বী মত ব্যক্ত করেন। তবে এই রাজপ্রশস্তিটি সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের শিক্ষা, বিদ্যোৎসাহিতা, রাজ্য জয় ও রাজ্যশাসন এবং ব্যক্তিগত প্রতিভা সম্পর্কে বিশদ তথ্য প্রদান করে।

সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য বিস্তার

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে রাজ্য বিজেতারূপে যে সকল সম্রাট খ্যাতি লাভ করেছেন, সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে স্থান পেয়েছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত গাঙ্গেয় উপত্যকার স্থানীয় একটি রাজ্যকে তিনি সর্বভারতীয় এক সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। প্রাচীন ভারতের তৃতীয় সাম্রাজ্যবাদী পুরুষ হিসাবে সমুদ্রগুপ্ত বিখ্যাত। বস্তুত চন্দ্রগুপ্ত মউরজ এবং কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের পর এতাে বড় বিজয়ী বীর ভারতের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি দেখা যায় না।

 

সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয় সম্পর্কে হরিষেণ রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তিতে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। প্রশস্তি অনুসারে সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত উত্তর ভারতের নয় জন রাজাকে পরাজিত করেন। এঁরা হলেন অচ্যুত, নাগসেন, রুদ্রদেব, মতিল, নাগদত্ত, চন্দ্রবর্মণ, গণপতিনাগ, নন্দী ও বলবর্মণ। এঁদের মধ্যে গণপতিনাগ (মথুরার নাগবংশের রাজা), নাগসেন (পদ্মাবতী বা গােয়ালিয়র অঞ্চলের রাজা), অচ্যুত (অহিচ্ছত্র বা উত্তর প্রদেশের রামনগর ও রায়বেরিলি’র রাজা) এবং চন্দ্রবর্মণের (পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়া অঞ্চলের রাজা) পরিচয় জানা যায়। বাকি পাঁচ জনের সঠিক সনাক্তকরণ এখনও সম্ভব হয়নি। যাহােক, উত্তর ভারত বা আর্যাবর্ত জয়ের ক্ষেত্রে সমুদ্রগুপ্ত কৌটিল্য ও ম্যাকিয়াভেলীর নীতি পূর্ণমাত্রায় অনুসরণ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, যিনি অধিকতর ক্ষমতাশালী তিনি যুদ্ধ করবেন। যার প্রয়ােজনীয় অস্ত্র-শস্ত্র ও অর্থ থাকবে তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করবেন। আর্যাবর্তের রাজাগণের প্রতি তাঁর যুদ্ধনীতি ছিল সম্পূর্ণ উচ্ছেদের। উল্লিখিত ৯ জন রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত তাদের রাজ্য নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত কেবল আর্যাবর্তের রাজগণের উচ্ছেদ সাধন করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি মধ্যভারতের আটবিক রাজ্য অর্থাৎ অরণ্য রাজ্যগুলােও পদানত করেছিলেন। এ সকল অরণ্য রাজ্য বা আটবিক রাজ্য গাজীপুর, জব্বলপুর প্রভৃতি অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। এরণ লিপিতে এ সংক্রান্ত তথ্য লিপিবদ্ধ আছে।

 

আটবিক রাজ্যজয়ের পর সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারত জয় করেন। এ সংক্রান্ত তথ্য এলাহাবাদ প্রশস্তিতে উৎকীর্ণ করা হয়েছে। সমুদ্রগুপ্ত দাক্ষিণাত্যে রাজ্য জয় করলেও রাজ্যগুলােকে অধিগ্রহণ করে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেননি। রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি এবং প্রশাসনিক সুবিধা-অসুবিধার বিচারে সমুদ্রগুপ্ত দাক্ষিণাত্যে অনেকটা ধর্ম বিজয়ী’র ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি পরাজিত রাজাদের আনুগত্য আদায় করে রাজ্যগুলাে ফিরিয়ে দেন অথবা করদ রাজ্যে পরিণত করেন। সভাকবি হরিষেণ বলেন, সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত ‘গ্রহণ-পরিমােক্ষ নীতি’ নেন। এ নীতির অর্থ হলাে- প্রথমে গ্রহণ অর্থাৎ শত্রুকে শক্তির জোরে বন্দি করা এবং তাঁর বশ্যতা আদায়ের পর মােক্ষ দান বা মুক্তি দেয়া। পরাজিত রাজা রাজ্য ফিরে পেতেন কিন্তু সার্বভৌমত্ব পেতেন না। যাহােক, সমুদ্রগুপ্তের অভিযান সাধারণত: মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণ ও পূর্বভাগ, উড়িষ্যা এবং দাক্ষিণাত্যের পূর্ব উপকূলের কাঞ্চী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। এই ভূ-ভাগের বারাে জন রাজা ও রাজ্যের নাম এলাহাবাদ প্রশস্তি সূত্রে জানা যায় যাদের ওপর ‘গ্রহণ পরিমােক্ষ নীতি’ প্রয়ােগ করা হয়েছিল। এঁরা হলেন কোশলের (দক্ষিণ কোশল বা বিলাস ও মধ্যপ্রদেশের রায়পুর জেলা এবং উড়িষ্যার সম্বলপুর জেলা) মহেন্দ্র, মহাকান্তারের (মধ্য ভারতের বনাঞ্চল) ব্যাঘ্ররাজ, কৌরলের (মধ্যপ্রদেশের শােনপুর জেলা) মন্তরাজ, কোতুরের (গঞ্জাম জেলার কোটুর) স্বামীদত্ত, পিষ্ঠপুরমের (অন্ধ্রের গােদাবরী জেলা) মহেন্দ্রগিরি, ইরন্দপল্লের (ভিজাগাপট্টম জেলা) দামন, কাঞ্চির (তামিলনাড়ুর কাঞ্চিভরম জেলা) বিষ্ণুগােপ, বেঙ্গীর (কৃষ্ণা গােদাবরী জেলার ইলাের) হস্তিবর্মণ, অবমুক্তার (কাঞ্চির নিকটবর্তী স্থান) বা আরামকুটের নীলরাজ, পল্লাকের (নেল্লোর জেলা) উগ্রসেন, দেবরাষ্ট্রের (সম্ভবত: ভিজাগাপট্টম) কুবের এবং কুস্থলপুরের (উত্তর আর্কট জেলা) ধনঞ্জয়।

সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের দ্বিমুখী নীতির (সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের অন্তর্ভুক্ত করা কিংবা সামন্তরাজ্য হিসাবে চলতে দেয়া) ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সীমান্তের বেশ কয়েকজন রাজা বা গােষ্ঠীপতি সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এদের মধ্যে সমতট (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা), ডবাক (আসামের নওগাঁ জেলা বা বাংলারর ঢাকা জেলা), কামরূপ (উত্তর আসাম), নেপাল ও কর্তৃপুরের (সনাক্তকরণ বিতর্কিত) নাম উল্লেখযােগ্য। অন্যদিকে উত্তরপশ্চিম ভারতে পশ্চিম ভারতের শক রাজগণ, পশ্চিম পাঞ্জাব ও আফগানিস্থানের কুষাণ রাজগণও সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের প্রাধান্য স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এছাড়া পূর্ব রাজপুতানা ও মান্দাসর এলাকার ‘মালব’, রাজস্থানের জয়পুর ও আলােয়ারের ‘অর্জুনায়ন’, পাকিস্তানের ভাওয়ালপুর রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত শতদ্রু নদীর উভয় তীরের বাসিন্দা ‘যৌধেয়’, মধ্যপ্রদেশের সাঁচী এলাকার আবীর’, ‘খরপরীক’, ভিলসার ‘কাক’ জাতি সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের প্রভুত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হয়।

প্রশস্তি অনুযায়ী সমুদ্রগুপ্ত কনৌজ বা পুপুর হতে সমস্ত অভিযান পরিচালনা করেন। আর্যাবর্তের সকল রাজাকে পরাজিত করে তিনি ‘সর্বরাজোচ্ছেত্তা’ উপাধি গ্রহণ করেন। হরিষেণের মতে, পরাজিত রাজন্যবর্গ ‘কর প্রদান করে, আদেশ পালন করে ও বশ্যতা জ্ঞাপন করে সমুদ্রগুপ্তের সম্রাটোচিত নির্দেশ পালন করেছিল।’ সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য ছিল প্রভুত্ব ও স্বায়ত্তশাসনের এক অপূর্ব সমন্বয়। দিগ্বিজয় সম্পন্ন করে তিনি ‘অশ্বমেধযজ্ঞ’ অনুষ্ঠান করেন এবং এই যজ্ঞের স্মৃতিরক্ষায় স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করেন।

সাম্রাজ্যসীমা

সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যবিস্তার নীতি ও যুদ্ধ বিগ্রহের আলােচনা থেকে তাঁর সাম্রাজ্যসীমা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। উত্তর প্রদেশ, বিহার, বাংলা ও মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশ নিয়ে তিনি প্রত্যক্ষ শাসন স্থাপন করেন। তার বাইরে সামন্তরাজ্যের পরিমন্ডল তিনি স্থাপন করেন। পূর্ব ভারতে সমতট, ডবাক, নেপাল ; পশ্চিমে মালব, উত্তর-পশ্চিমে খরপরিকগণ এই পরিমন্ডল রচনা করে। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার প্রত্যক্ষ ও করদ রাজ্য মিলিয়ে সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যসীমা ধরেছেন- কাশ্মির, পশ্চিম পাঞ্জাব, পশ্চিম রাজপুতানা, সিন্ধু, গুজরাট ব্যতিত সমগ্র উত্তর ভারত; দক্ষিণে উড়িষ্যার ছত্তিসগড় হয়ে পূর্ব উপকূল ধরে তামিলনাড়ুর চিঙ্গেলকোট জেলা পর্যন্ত। এছাড়া সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যসীমার বাইরে প্রতিবেশীরাও তাঁর পরাক্রম অনুভব করে দ্রুত তাঁর সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। অর্থাৎ সাম্রাজ্যের বাইরেও তাঁর ‘প্রভাব বলয়’ বিস্তৃত ছিল।

রাজ্য জয়ের প্রকৃতি

সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত এই নীতি নিয়ে কখনােই ইতড়ত করেননি, রাজ্য অধিগ্রহণ করাই হলাে রাজার প্রধান কর্তব্য কাজ। তিনি ছিলেন প্রচন্ড সাম্রাজ্যবাদী। ড. স্মিথ সম্ভবত এ কারণেই সমুদ্রগুপ্তকে “ভারতীয় নেপােলিয়ন” আখ্যা দিয়েছেন। ভারতের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত ভারতভূমিকে এক শাসনে আবদ্ধ করাই ছিল সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের লক্ষ। অনেকে সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয়ের মধ্যে ব্রাহ্মণ্যধর্মের সাম্রাজ্যবাদ লক্ষ করেছেন। অধ্যাপক রােমিলা থাপারের মতে, সমুদ্রগুপ্ত সারা ভারতে ব্রাহ্মণ্যসভ্যতার ধ্বজা উড়িয়ে দেন। অনেকে আবার সমুদ্রগুপ্তকে ‘ধর্মবিজয়ী’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। গ্রহণ-পরিমােক্ষ’ নীতির ভিত্তিতে তাঁরা বলেন, সমুদ্রগুপ্তকে সাম্রাজ্যবাদী বা আগ্রাসী বলা যুক্তিযুক্ত নয়। ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন অর্থাৎ অখন্ড ভারত সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল সমুদ্রগুপ্তের প্রধান চালিকাশক্তি। অবশ্য অনেকে সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যবাদী নীতির পেছনে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য লক্ষ করেছেন। দক্ষিণের অপরিমিত সম্পদ সংগ্রহ, গঙ্গাযমুনা উপত্যকার কৃষি সম্পদ হস্তগত করা ইত্যাদি কারণেই সমুদ্রগুপ্ত যুদ্ধ বিগ্রহ করেছেন। যাহােক, একথা বলা প্রয়ােজন যে, গুপ্ত সাম্রাজ্য একটি বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে উদ্ভূত হয়েছিল। কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের রাজনীতিতে যে শক্তিশূন্যতা দেখা দেয় গুপ্ত সাম্রাজ্য তা দূর করে।

সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব

এলাহাবাদের শিলালিপি অনুযায়ী সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি গান গাইতে ও বীণা বাজাতে পারতেন। কতিপয় স্বর্ণমুদ্রায় তাঁকে বীণাবাদক রূপে পালঙ্কে উপবিষ্ট দেখা যায়। কবিতা রচনাতেও তার যথেষ্ট পারদর্শিতা ছিল। কবিরাজ’ উপাধি দেখে মনে হয় সম্ভবত তিনি প্রথম শ্রেণীর অজস্র কবিতা লিখেছিলেন। কিন্তু কালের কবলে পড়ে তা বিলীন হয়ে গেছে। অশােকের ন্যায় সমুদ্রগুপ্ত পরাক্রমের সাহায্যে দিগ্বিজয়ের পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু উভয়ের পরাক্রম ও দিগ্বিজয়ের মধ্যে ছিল আকাশ-পাতাল তফাৎ। একজনের অস্ত্র হলাে ন্যায়, ধর্ম ও পরােপকারিতা এবং অপরজনের অস্ত্র, সামরিক শক্তি ও বুদ্ধি । অশােক আধ্যাত্মিক শক্তিতে শক্তিমান; আর সমুদ্রগুপ্ত বাহুবলে বলীয়ান। অশােকের ব্যক্তিত্বকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। আবার সমুদ্রগুপ্তের প্রাধান্য স্বীকার না করার উপায় নেই। সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত কেবল দিগ্বিজয়ী যােদ্ধাই ছিলেন না, ছিলেন একজন সুদক্ষ শাসকও। দক্ষিণ ভারতে তাঁর মিত্ৰতামূলক নীতি তাঁর। কূটনৈতিক জ্ঞানেরই পরিচয় দেয়। সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত তাঁর সামরিক প্রতিভা এবং কূটনৈতিক শক্তিতে ভারতব্যাপী রাজনীতিক একতার সূত্রপাত ঘটান। অশােকের ধর্ম-বিজয় অপেক্ষা তা কম গৌরবের নয়। অশােকের ধর্মনীতি, কর্মনীতি ও বাস্তব বুদ্ধির ন্যায় সমুদ্রগুপ্তের উদারতা, বিদ্যোৎসাহিতা, পরমত সহিষ্ণুতা ও রাজনীতিক দূরদর্শিতা প্রশংসনীয়। কথিত আছে, বিখ্যাত বৌদ্ধ পন্ডিত বসুবন্ধু তাঁর মন্ত্রী এবং হরিষেণ তাঁর সভাকবি ছিলেন। তিনি নিজে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপােষক হয়েও বৌদ্ধ, জৈন বা অন্য কোন ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ছিলেন না। হরিষেণের প্রশস্তিতে, সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত সম্পর্কে অত্যুক্তি থাকলেও তাঁর কৃতিত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না। সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন সাধুব্যক্তিদের আশাস্বরূপ, আর অসাধুদের জন্য প্রলয়। হরিষেণ সমুদ্রগুপ্তকে মানুষের আকৃতিতে দেবতা তুল্য ‘অচিন্ত্যপুরুষ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

প্রাচীন ভারতের সাম্রাজ্যকেন্দ্রিক ইতিহাসের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত হচ্ছেন প্রধান ব্যক্তিত্ব। তার দিগ্বিজয়ের কাহিনী প্রাচীন ইতিহাসের অন্যতম আলােচ্য বিষয়। সভাকবি হরিষেণের প্রশস্তি থেকে এই দিগ্বিজয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। তবে এ বিবরণে কিছুটা অতিশয়ােক্তি থাকতে পারে। তা সত্তেও অন্যান্য উপকরণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় আর্যাবর্তের বিশাল এক অঞ্চলে সমুদ্রগুপ্তের প্রত্যক্ষ শাসন এবং এর সংলগ্ন এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল পরােক্ষ শাসনাধীন ছিল। তিনি বিজয়সূচক ‘সর্বরাজোচ্ছেত্তা’ উপাধি ধারণ করেন। তাঁর সামরিক কৃতিত্বের সূত্র ধরেই তাকে ‘ভারতীয় নেপােলিয়ন বলা হয়েছে। লিচ্ছবি দৌহিত্র সম্রাট সমুদ্রগুপ্তকে ‘অচিন্ত্যপুরুষ’ও বলা হয়। কেবল দিগ্বিজয়ী যােদ্ধাই নয় তিনি একাধারে সুদক্ষ শাসক এবং কবিতা ও সঙ্গীত রসিক ব্যক্তিত্ব হিসাবেও পরিচিত। বহুমুখী প্রতিভাবান এই সম্রাটই কার্যকরভাবে ভারতকে এক সুতাের মালায় গাঁথবার চেষ্টা করে কিছুটা সাফল্য অর্জন করেন।