এই সংকলনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জিবনের তিনটি কাহিনী বির্নিত করা হয়েছে ।
কোহিনুর - এই হীরার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন রাজবংশের উত্তরাধিকারের সম্পর্ক, জড়িয়ে আছে মৃত্যু ও ধ্বংসের ইতিহাস, জড়িয়ে আছে সৌন্দর্য। এই রত্নটি যে কেবল প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকে আছে তাই নয়। এটা চুরি হয়েছে, এটা নিয়ে লড়াই হয়েছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে মৃত্যু এবং বঞ্চনার ইতিহাসের কারণে এই হীরাকে 'অভিশপ্ত' বলেন অনেকে।
একশো পাঁচ ক্যারেটের ডিম্বাকৃতির এই কোহিনুর পৃথিবীর সবচেয়ে বিতর্কিত ও আলোচিত হীরা।
এই মূল্যবান হীরাটি অনেকবার হাত বদল হয়েছে। ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই হীরাটা চলে যায় ব্রিটিশদের দখলে। এটি মুঘল শাহজাদা, ইরানী যোদ্ধা, আফগান শাসক এবং পাঞ্জাবি মহারাজাদের হাত ঘুরে স্থান পেয়েছে টাওয়ার অব লন্ডনে।
ক্রাউন জুয়েলসে থাকা ২৮০০টি মূল্যবান রত্নগুলোর মধ্যে একটি হলো কোহিনুর।
কিন্তু এটা সবসময় এই জায়গায় ছিল না।
কালের বিবর্তনে কোহিনুর নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক গল্প। অনেক ইতিহাসের সঙ্গে অনেক পুরাণ কথার সাক্ষীও জড়িত এই হীরার সঙ্গে।
হীরাটি ছিল রানী ভিক্টোরিয়ার বিশেষ সম্পত্তি, তিনি মূলত একটি ব্রোচ হিসেবে পরতেন এটি।
এবং শেষ পর্যন্ত এটি ক্রাউন জুয়েলসের অংশ হয়ে ওঠে।
এটি সর্বপ্রথম জনসমক্ষে দেখা যায় ২০০২ সালে, কুইন মাদারের মৃত্যুর পর তার কফিনের ওপরে।
বহু ভারতীয় বিশ্বাস করেন এই হীরা ব্রিটিশরা তাদের দেশ থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে।
২০২২ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পরেই টুইটারে কোহিনুর শব্দটি ট্রেন্ড করা শুরু করে।
বহু ভারতীয় হীরাটি ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
উইলিয়াম ডালরিম্পল ও অনীতা আনন্দ তাদের রচিত “কোহিনুর: দ্য স্টোরি অব্য দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ইনফেমাস ডায়মন্ড” নামের বইটিতে এই হীরা নিয়ে যেসব মিথ প্রচলিত আছে সেগুলো নিয়ে লিখেছেন।
১৮৪৯ সালে কোহিনূর যখন তৎকালীন ভারতের গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসির হাতে আসে, তখন তিনি সেটি রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে পাঠানোর প্রস্তুতি নেন।
হীরাটি যে ঠিক কত মূল্যবান, তাও রানীর সামনে তুলে ধরার কথা ভাবলেন লর্ড ডালহৌসি। তাই তিনি ঠিক করলেন, হীরাটির সাথে এর একটি আনুষ্ঠানিক ইতিহাসও পাঠাবেন তিনি।
সেই অনুযায়ী তিনি নিয়োগ দেন দিল্লির একজন জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট, থিও মেটক্যাফকে। মেটক্যাফের কাজ ছিল কোহিনুরের ইতিহাসের উপর গবেষণা করা, এবং সেই গবেষণার উপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা।
কিন্তু তিনি খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। ইতিমধ্যেই কোহিনুর সম্পর্কে যেসব গল্পকথা প্রচলিত ছিল, সেগুলোই তিনি তার প্রতিবেদনে আবার উল্লেখ করেন। অথচ তার সেই প্রতিবেদনটিকেই রেফারেন্স হিসেবে ধরে এরপর থেকে হাজার হাজার নতুন আর্টিকেল ও বই প্রকাশিত হয়েছে, নির্মিত হয়েছে বহু তথ্যচিত্রও।
ডালরিম্পল ও আনন্দের লক্ষ্য ছিল, অতিরঞ্জন গল্পগুলো বাদ দিয়ে বাস্তব কিছু বের করে নিয়ে আসা। এবং অনেক সমালোচক বলেন সেই কাজটি তারা বেশ ভালোভাবেই করতে পেরেছেন। বর্তমানে কোহিনূরের প্রকৃত ইতিহাস জানতে অনেকেই নির্ভর করছেন এই বইটির উপরই।
এই বইয়ে কোহিনুর নিয়ে প্রচলিত কিছু মিথ সম্পর্কে লেখা হয়েছে, তার কিছু এখানে তুলে ধরা হলো।
অনেকে কোহিনুরকে ভারতের অন্যতম মূল্যবান হীরা মনে করলেও ইতিহাস ঘেঁটে গবেষকেরা দেখেছেন ১৯০.৩ ক্যারেটের কোহিনুর যখন ব্রিটেনে আনা হয় তার সাথে সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অন্তত আরো দুটি হীরার খোঁজ পাওয়া যায়।
একটি হলো দরিয়া-ই-নূর যার অর্থ আলোর সাগর(১৭৫-১৯৫ ক্যারেট), এবং অপরটি হলো “গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড” হিসেবে পরিচিত অরলভ হীরা(১৮৯.৯ ক্যারেট)।
১৭৩৯ সালে ইরানী শাসক নাদির শাহ যে ধনসম্পদ লুট করেছিলেন সে সময় এই তিনটি হীরাই ভারতবর্ষ ত্যাগ করেছিল।
কেবল উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে যখন কোহিনুর হাতবদল হয়ে আবার পাঞ্জাবে ফিরেছিল, তখন থেকেই এটি সর্বশ্রেষ্ঠ হীরার তকমা পেতে শুরু করে, এবং এটা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আরও বেশি আগ্রহ তৈরি হয়।
অনেকেই মনে করেন, প্রকৃত কোহিনুর হয়তো একদম নিখুঁত ছিল। কিন্তু কোহিনুরের ওপর অনেকগুলো হলুদ রঙের দাগ ছিল। কয়েকটি দাগ এত বড় ছিল যে, সেগুলোর কারণে হীরাটি ঠিকভাবে আলো প্রতিফলনের ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছিল।
সে কারণেই রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী, প্রিন্স অ্যালবার্ট এত বেশি আগ্রহী ছিলেন হীরাটিকে নতুন করে কাটানোর জন্য।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোহিনুর বিশ্বের সবচেয়ে বড় হীরা তো নয়ই, এটার অবস্থান বিশ্বের বৃহত্তম হীরার ধারেকাছেও নেই। এর অবস্থান ৯০তম। ফলে, টাওয়ার অব লন্ডনে ঘুরতে যাওয়া অনেক পর্যটককে এর আকৃতি দেখে অবাক হতে দেখা যায়।
কারণ কোহিনুর হীরার ঠিক পাশেই রাখা দুটি কালিনান হীরার সাথে তুলনা করলে কোহিনুরকে অনেক ক্ষুদ্রাকৃতির বলেই মনে হয়।
অনেকেই দাবি করে থাকেন, কোহিনুর হীরাটি ত্রয়োদশ শতকে ভারতের কোল্লুর খনিতে পাওয়া যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কবে, কোথায় এটা উত্তোলন করা হয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। এবং এই অনিশ্চয়তাই একে বেশি রহস্যময় করে তুলেছে।
অনেকেই আবার বিশ্বাস করেন, কোহিনুর কৃষ্ণকে নিয়ে রচিত ভগবদ পুরাণের সেই সিমন্তক মণি। এবং মজার ব্যাপার হলও থিও মেটক্যাফের প্রতিবেদনেও এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘কৃষ্ণের জীবদ্দশাতেই উত্তোলিত হয়েছিল কোহিনুর হীরা’।
কিন্তু ডালরিম্পল ও আনন্দের বইটিতে জোর দিয়ে দাবি করা হয়েছে, কোহিনুর কোনো খনি থেকে উত্তোলন করা হয়নি, এটা সম্ভবত দক্ষিণ ভারতের কোনো শুষ্ক নদীপৃষ্ঠ থেকে তোলা হয়েছে।
হীরা যে এক মহামূল্যবান রত্ন এ কথা কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। বিশেষত হিন্দু ও শিখদের কাছে এটি অমূল্য রত্ন। কিন্তু মুঘল ও ইরানীদের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন। তারা হীরার থেকেও বেশি পছন্দ করত বৃহৎ, নিখুঁত, উজ্জ্বল রঙের পাথর। আর সেজন্যই কোহিনুর হীরাকে মুঘলদের সবচেয়ে মূল্যবান ধন বলে যে দাবি করা হয়, তা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেন না অনেক গবেষক।
মুঘলদের রাজকোষে ছিল বহু ধরনের মূল্যবান ধন-সম্পদ। কোহিনুর হীরা সেগুলোরই একটি। কিন্তু মুঘলরা সবচেয়ে বেশি অধিগ্রহণ করেছিল যেটি, তা হীরা নয়। বরং তাদের বেশি ঝোঁক ছিল বাদাখশানের লোহিতক ও বার্মার পদ্মরাগমণির ওপর।
কোহিনুর বা হীরার প্রতি মুঘলদের যে উদাসীনতা ছিল তা প্রমাণিত হয় আরেকটি ঘটনা থেকেও। কথিত আছে, নির্বাসিত থাকাকালে মুঘল সম্রাট পারস্যের শাহ তাহমাসপকে উপহারস্বরূপ ‘বাবরের হীরে’ বলে যে হীরাটি দিয়েছিলেন, সেটি নাকি আসলে কোহিনুরই ছিল।
বাবরের হীরা পরে আবার দক্ষিণে ফিরে এসেছিল, কিন্তু ঠিক কবে বা কীভাবে আবার মুঘল রাজদরবারে এর প্রত্যাবর্তন ঘটে, তা আজও স্পষ্ট জানা যায়নি।
এ গল্পটা বহুল জনপ্রিয় যে , মোহাম্মদ শাহ রঙ্গিলা নাকি তার পাগড়ির ভিতর কোহিনুর লুকিয়ে রাখতেন। এ কথা জেনে যান নাদির শাহ এবং তিনি এক কৌশল বের করেন। তিনি মোহাম্মদ শাহকে একটি প্রাচীন রীতির কথা মনে করিয়ে দেন যে দুই বাদশাহ পরস্পর দেখা হলে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে পাগড়ি বিনিময় করবেন।মোহাম্মদ শাহের বুঝতে বাকি ছিল না, নাদির শাহ আসলে হীরাটি ছিনিয়ে নিতে চাইছেন।
অথচ তৎকালীন পরিস্থিতিতে পাগড়ি বিনিময়ে অস্বীকৃতির মাধ্যমে নাদির শাহের বন্ধুত্বের আহ্বান ফিরিয়ে দেয়াও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তিনি বাধ্য হন পাগড়ি বিনিময় করতে। এভাবে পাগড়ি ও কোহিনুরের মালিক বনে যান নাদির শাহ।
কিন্তু পারস্যের ইতিহাসবিদ মারভি বলছেন, বাস্তবে মোহাম্মদ শাহের পক্ষে হীরাটি তার পাগড়িতে লুকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। সেই সময়ে কোহিননুর ছিল সর্বকালের সবচেয়ে সুন্দর ও মূল্যবান হীরা, শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসনের মাঝে হীরাটি দ্যুতি ছড়াচ্ছিল।
অনেক গবেষকের মতে, এর দ্যুতি এতটাই মুগ্ধকর ছিল যে এটি মুঘল শাসক শাহজাহানের রুবি, পান্না ও মুক্তাখচিত ময়ূর সিংহাসনেও যুক্ত করা হয়েছিল এবং এই হীরাটি বহু বছর শাহজাহানের সিংহাসনে দীপ্তি ছড়িয়েছে।
সিংহাসন তৈরির পর মুঘলরা এক শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষে ক্ষমতায় ছিল।
কিন্তু দেশটির ব্যাপক সম্পদ বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠে এবং পারস্যের শাসক নাদির শাহ ভারতবর্ষে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
১৭৩৯ সালে তিনি দিল্লিতে প্রবেশ করেন এবং লুট করেন দিল্লির ধন-সম্পদ। যেগুলো নিজ দেশে নিয়ে যাবার জন্য তিনি ব্যবহার করেছিলেন ৭০০টি হাতি, ৪ হাজার উট এবং ১২ হাজার ঘোড়া।
লুণ্ঠিত সম্পদের মধ্যে ছিল সিংহাসনটি, এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ভারতবর্ষ ছাড়ে কোহিনুর।
সিংহাসন থেকে কোহিনুর হীরাটি সরিয়ে একটি আর্মব্যান্ডে সেটি স্থাপন করেন শাহ, যা তিনি সবসময় তার হাতে পরতেন।
এরপর হাত বদল হয়ে হীরাটি যায় আফগানিস্তানে, শাসকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পার করে সেখানে ৭০ বছর ছিল হীরাটি।
১৮১৩ সাল নাগাদ, এটি ভারতে ফিরে আসে এবং শিখ শাসক রঞ্জিত সিংয়ের দখলে চলে যায়।
এরপর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোহিনুর হীরা নামে একটি অমূল্য সম্পদের গুজব শুনতে পায় এবং এটি সংগ্রহ করার জন্য তারা চেষ্টা শুরু করে।
ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির কাছে হীরা ছিল ক্ষমতার চূড়ান্ত প্রতীক। তিনি চেয়েছিলেন ভারতের রত্নের মালিক হোক ব্রিটেন।
ফরাসি রত্ন ব্যবসায়ী ও পর্যটক জন-ব্যাপ্টিস্ট ট্যাভারনিয়ার তথ্য অনুযায়ী, তিনি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত রত্নালঙ্কারের সংগ্রহশালা পরিদর্শনের অনুমতি পেয়েছিলেন। ফরাসি এই রত্ন ব্যবসায়ীর ভাষ্যমতে, সম্রাটের ভাস্কর হোর্তেনসিও বোর্গিও খুব বড় আকারের একটি হীরাকে ভুলবশত কেটে ফেলেছিলেন। এর ফলে হীরাটির আকৃতি নষ্ট হয়ে যায় ও তা ছোট হয়ে যায়।
কিন্তু তিনি ওই হীরাটিকে চিহ্নিত করেছিলেন ‘গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড’ হিসেবে, যেটা শাহজাহান হীরা ব্যবসায়ী মীর জুমলার কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন ।
একটা সময় পর্যন্ত অনেকেই বিশ্বাস করত, ‘গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড’ই হয়তো কোহিনুর। কিন্তু বর্তমান সময়ের অনেক গবেষক একমতে পৌঁছেছেন যে, সেটা ছিল আসলে অরলভ হীরা। যা বর্তমানে মস্কোর ক্রেমলিন জাদুঘরের অংশ হয়ে উঠেছে ও সেখানে দীপ্তি ছড়াচ্ছে।
কোহিনুরের দীর্ঘ ইতিহাসে এটি অসংখ্যবার চুরি হয়েছে এবং স্থানান্তরিত হয়েছে। এর হাতবদলের ইতিহাস বড়ই বিচিত্র।
তাই এই প্রশ্ন এখনও থেকেই যায় পরবর্তীতে এই হীরাটি কোথায় যেতে পারে?
ভারত ছাড়াও পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানও এই মূল্যবান হীরার ওপর নিজেদের দাবি জানিয়ে আসছে।
বিশ্লেষকেরা বলে থাকেন এই হীরাটি হলো ‘বিজয়ী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্যের প্রতীক’।
তবে এই হীরাকে ঘিরে যেই ইতিহাস ও বিতর্ক রয়েছে তা চলতে থাকবে। বিতর্কের কথা ভেবে রাজা চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানেও ব্যবহার হচ্ছে না কোহিনুর হীরা।
আর তাই এ কথা বলাই যায় - বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সবচেয়ে বিতর্কিত হীরার ইতিহাস লেখা চলতে থাকবে যুগের পর যুগ।
অজাতশত্রু হর্য্যঙ্ক রাজবংশের রাজা বিম্বিসার ও কোশল রাজকন্যা চেলেনার পুত্র ছিলেন। ৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গৌতম বুদ্ধের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ বৌদ্ধ ভিক্ষু দেবদত্তের প্ররোচনায় অজাতশত্রু বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক বিম্বিসারকে হত্যার চেষ্টা করেন। বুদ্ধের মতাদর্শে বিশ্বাসী বিম্বিসার এই ঘটনায় তাঁর পুত্রকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু পুনরায় দেবদত্তের প্ররোচনায় অজাতশত্রু বিম্বিসার ও তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীকে গৃহবন্দী করে নিজেকে মগধের শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ৪৯১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গৃহবন্দী অবস্থায় বিম্বিসারের মৃত্যু ঘটে। এই সময় দেবদত্তের প্ররোচনায় তিনি গৌতম বুদ্ধকে হত্যার চেষ্টা করেন। পিতার মৃত্যুর পর অনুশোচনায় দগ্ধ অজাতশত্রু শান্তিলাভের আশায় বিভিন্ন ধর্ম উপদেষ্টা ও দার্শনিকের শরণাপন্ন হন। কিন্তু তাঁদের উপদেশে শান্তিলাভে ব্যর্থ হয়ে রাজবৈদ্য জীবকের উপদেশে গৌতম বুদ্ধের শরণাপন্ন হলে বুদ্ধ তাঁকে সামঞ্ঞফলসুত্ত ব্যাখ্যা করেন।
বিম্বিসারের বন্দীত্ব ও মৃত্যুর ঘটনায় ক্রুদ্ধ কোশল রাজ প্রসেনজিৎ একদা উপহার হিসেবে প্রদত্ত কাশী রাজ্য পুনরায় নিজের অধীনে নিয়ে নিলে অজাতশত্রু কোশল রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। প্রথম যুদ্ধে তিনি বিজয়ী হলেও পরের যুদ্ধে পরাজিত হন। কিন্তু গৌতম বুদ্ধের মতাদর্শে বিশ্বাসী প্রসেনজিৎ তাঁকে মুক্ত করে তাঁর কন্যা বজিরাকে তাঁর সাথে বিবাহ দিয়ে যৌতুক হিসেবে কাশী রাজ্য ফিরিয়ে দেন।
বুদ্ধঘোষের বর্ণনা অনুযায়ী, গঙ্গা নদীর তীরবর্তী একটি বন্দর এলাকার অর্ধেক অংশ অজাতশত্রুর অধিকারে এবং অর্ধেক অংশ বৃজি মহজনপদের অধিকারে ছিল। এই বন্দরের নিকটবর্তী একটি পাহাড়ে প্রাপ্ত গন্ধভাণ্ড নামক এক ধরনের সুগন্ধী দ্রব্যের অধিকার নিয়ে মগধ ও বৃজি মহজনপদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। বেশ কয়েক বার অজাতশত্রুর পূর্বেই লিচ্ছবিরা সম্পূর্ণ গন্ধভাণ্ড অধিকার করে নিজের দেশে চলে গেলে অজাতশত্রু প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ করেন। দীঘনিকায়ের মহাপরিনিব্বানসুত্ত অনুসারে, তিনি তাঁর মন্ত্রী বস্সকারকে গৌতম বুদ্ধের নিকট প্রেরণ করে লিচ্ছবিদের পরাজিত করার উপায়ের সন্ধান করতে বলেন। গৌতম বুদ্ধ মত দেন যে, যতদিন লিচ্ছবিরা যতদিন সম্মিলিত ভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করে একত্রিত ভাবে মতগ্রহণ করবেন, নিজের দেশের আইন ও জৈষ্ঠ্যদের উপদেশ মেনে চলবেন, নারীদের বিরুদ্ধে কোন হিংসামূলক অপরাধে জড়িত থাকবেন না, ধর্মস্থান ও অর্হতদের সম্মান করবেন,। ততদিন কোন বৈদেশিক শক্তি তাঁদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এই উপদেশের ফলে অজাতশত্রু এরপর সামরিক শক্তির বদলে লিচ্ছবিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে সফল হন এবং মগধের সেনা বৃজি মহজনপদ অধিকার করতে সক্ষম হয়।
বুদ্ধের মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম হয়েছিল ।
বুদ্ধত্ব লাভ এবং মানুষের রোগ, জরা ও মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বধিসত্ব বারবার জন্মলাভ করেছিলেন ।
বিভিন্ন জন্মে বধিসত্ব কখনো মানুষ ,কখনো বাঁদর,কখনো হরিণ কখনো হাতি আবার বা কখনো সিংহ রূপে জম্মগ্রহন করেছিলেন ।বধিসত্ব তাঁর বিভিন্ন আয়ুষ্কালে জ্ঞান,ক্ষমা, মৈত্রি ও সুবিচারের বানী প্রচার করে গেছেন ।
জাতকের ভিবিন্ন কাহানীর মধ্যে জ্ঞান,ক্ষমা, মৈত্রি ও সুবিচারের বানী ছড়িয়ে আছে ।
অমরচিত্র কথা ৩৪২ –বুদ্ধির লড়াই ও ৩৬২ অমূল্য রতন বই'তে যথাক্রমে ঔষধকুমারের বাল্যবস্থার ও মিথিলার রাজসভার প্রথম দিকের কাহিনী গুলি বলা হয়েছিল । অমরচিত্র কথার এই সংখ্যায়, ঔষধকুমার যখন মিথিলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ,সেই সময়কার গল্পগুলির পরিবেশন করা হয়েছে ।
আজ শেষ হয়ে গেল মহাভারত............
বাংলা অমরচিত্র কথায় মহাভারত এই ৩০তম খণ্ডে অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল , হিন্দি ইংরাজি তে ৪২ খণ্ডে শেষ হয়েছিল , প্রথমে যদিও বলাহয়েছিল যে ৬০ খণ্ডে সমাপ্ত হবে ।
বিরাট রাজা উত্তর ও শ্বেতার পুত্র শল্য ও ভীষ্মের হাতে নিহত হন। ভীষ্ম পাণ্ডবদের বহু সৈন্যকে হত্যা করেছিলেন।
ভীষ্ম; অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণকে বেশ কয়েকবার আহত করেছিলেন। ভীম হাজার হাজার কলিঙ্গ ও নিষাদকে হত্যা করেছিলেন।
ভীম এবং তার পুত্র ঘটোৎকচ একসঙ্গে দুর্যোধনের সেনাবাহিনীকে তাড়িয়ে দেন। কৃষ্ণ অর্জুনকে ভীষ্মের মুখোমুখি হওয়ার জন্য বলেন, কিন্তু তিনি তা করতে অক্ষম হন।
কৌরবরা তাদের তীর দিয়ে অর্জুনকে আবৃত করেছিল, কিন্তু সে পরাস্ত হয়েছিল। ভীম কৌরব সৈন্যবাহিনীতে ক্ষোভের সৃষ্টি করেন এবং ১৪ জন কৌরব নিহত হন।
শ্রীকৃষ্ণের প্রচারের পর যুদ্ধ শুরু হয়। ভীষ্ম; পাণ্ডব সেনাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন এবং সাত্যকিকে যুদ্ধ থেকে দূরে সরিয়ে দেন।
পাণ্ডবরা মকরব্যুহ চালু করেছিল এবং কৌরবরা ক্রোঞ্চভ্যুহের আকারের একটি সেনাবাহিনী চালু করেছিল। এদিকে কৌরবদের পরাজয় দেখে দুর্যোধন ক্রুদ্ধ হতে থাকেন। ভীষ্ম আবারও, পাণ্ডবদের সৈন্যের ক্ষতি করেন।
অর্জুন কৌরব বাহিনীকে আক্রমণ করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধে দুর্যোধনকে পরাজিত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভীষ্ম; পাণ্ডব বাহিনীর উপর আধিপত্য বিস্তার করেন।
ঘটোৎকচ তার মায়ায় দুর্যোধনের ওপর অত্যাচার করে। দিনের শেষে, ভীমের হাতে আরও নয়টি কৌরব নিহত হয়।
ভীষ্ম; অর্জুনকে আহত করেন। কৃষ্ণকে তার ব্রত ভঙ্গ করে অস্ত্র ধরতে হয়। ভীষ্ম পাণ্ডবদের সৈন্যবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেন।
ভীষ্মের ভয়াবহ গণহত্যা দেখে শ্রীকৃষ্ণ পান্ডবদের কাছে তার মৃত্যুর প্রতিকার চাইতে বলেন। এরপর অর্জুন তাকে তীরের বিছানায় শুইয়ে দেন। তবে ভীষ্ম তার জীবন ত্যাগ করেন না।
দ্রোণকে কৌরব বাহিনীর নতুন সেনাপতি করা হয়। অর্জুন কৌরবদের থেকে, যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করার পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়।
শকুনি এবং দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু অর্জুন শেষ মুহূর্তে ব্যর্থ হন।
এই দিনে কৌরবরা চক্রব্যূহ তৈরি করেন, যা ভাঙতে যুধিষ্ঠির অভিমন্যু সহ ভীমকে পাঠান। তবে শুধুমাত্র অভিমন্যুই এই ব্যূহতে প্রবেশ করতে পারে। তিনি একাই কৌরবদের প্রভুদের সাথে যুদ্ধ করেন এবং বীরগতি লাভ করেন। এর পরের দিনই অর্জুন জয়দ্রথকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেন।
জয়দ্রথকে বাঁচানোর জন্য, দ্রোণ তাকে সেনাবাহিনীর পিছনে লুকিয়ে রাখেন কিন্তু শ্রী কৃষ্ণের সূর্যাস্তের কারণে, তিনি বেরিয়ে আসেন এবং অর্জুনের হাতে নিহত হন। এই দিনে দ্রোণের হাতে দ্রুপদ ও বিরাট নিহত হন।
এই দিনে, পাণ্ডবরা দ্রোণাচার্যকে বিশ্বাস করায় যে অশ্বত্থামার মৃত্যু হবে। এই অশ্বত্থামা ছিল একটি হাতি, যাকে ভীম হত্যা করেন। এতে নিরাশ হয়ে দ্রোণ সমাধি নেন। এই অবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের শিরচ্ছেদ করেন।
দুর্যোধনের নির্দেশে, কর্ণকে অদম্য শক্তি দিয়ে ঘটোৎকচকে হত্যা করতে হয়। এই তীর তিনি অর্জুনের জন্য রেখেছিলেন।
কুন্তীর কাছে দিনের প্রতিশ্রুতির কারণে সে নকুল ও সহদেবকে পরাজিত করেও হত্যা করে না। এই দিনে দুশাসনও ভীমের হাতে নিহত হয় এবং সে তার বুক চিরে তার রক্ত পান করে।
কর্ণ; ভীম ও যুধিষ্ঠিরের মুখোমুখি হন কিন্তু কুন্তীর কাছে প্রতিশ্রুতির কারণে তাদের হত্যা করেন না। এরপর কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যে যুদ্ধ হয়। কর্ণের রথের চাকা ভেঙে পড়লে শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে অর্জুনের হাতে অসহায় অবস্থায় কর্ণ নিহত হন। এই দিনে ২২ কৌরবকেও হত্যা করা হয়।
ভীম, অবশিষ্ট কৌরব এবং সহদেব, শকুনিকে হত্যা করেন। তার পরাজয় বিশ্বাস করে, দুর্যোধন একটি পুকুরে লুকিয়ে থাকে, কিন্তু যখন তাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়, তখন সে গদা নিয়ে ভীমের সাথে যুদ্ধ করে।
তারপর ভীম ছলনা করে দুর্যোধনের উরুতে আঘাত করেন, যার ফলে দুর্যোধনের মৃত্যু হয়। এইভাবে পাণ্ডবরা বিজয়ী হয়।
অশ্বত্থামা দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং শিখণ্ডী প্রভৃতি সমস্ত পঞ্চালকে হত্যা করেন। যখন অশ্বত্থামা ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করেন কৃষ্ণ অশ্বত্থামাকে কলিযুগের শেষ অবধি কুষ্ঠরোগী হিসেবে বেঁচে থাকার অভিশাপ দেন।
মহাভারতের যুদ্ধের পরে, কৌরবদের দিক থেকে ৩ জন যোদ্ধা অবশিষ্ট ছিল – কৃতবর্মা, কৃপাচার্য এবং অশ্বত্থামা।
যেখানে পাণ্ডবদের পক্ষে যুযুৎসু, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, ভীম, নকুল, সহদেব, কৃষ্ণ, সাত্যকি প্রমুখ ব্যাক্তি অবশিষ্ট ছিলেন। যুধিষ্ঠির উভয় পক্ষের সৈন্যদের শ্মশান ও তর্পণ করেন। এরপর রাজপ্রাসাদ থেকে অনাগ্রহের কারণে সমস্ত পাণ্ডব হিমালয়ে চলে যান, এবং সেখানেই তাদের জীবন পূর্ণ হয়।
রীকৃষ্ণ
ছিলেন প্রখর কূটবুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষ এবং মহাভারতের যুদ্ধ ও তার পরিণতিতে
তাঁর প্রগাঢ় প্রভাব ছিল। তিনি পাণ্ডব এবং কৌরবদের মধ্যে শান্তি স্থাপন
করতে যথাসম্ভব উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু যখন তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ
হয়ে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন তিনি ক্রূর কূটনীতিকের ভূমিকা গ্রহণ
করেন। যুদ্ধকালে পিতৃ-পিতামহের বিরুদ্ধে সঠিক মনোবল নিয়ে যুদ্ধ না করার
জন্য তিনি অর্জুনের উপর ক্রুদ্ধ হন। একবার তাঁকে আঘাত করার অপরাধে কৃষ্ণ
একটি রথের চাকাকে চক্রে পরিণত করে ভীষ্মকে আক্রমণ করতে উদ্যত হন। তখন ভীষ্ম
সমস্ত অস্ত্র পরিত্যাগ করে কৃষ্ণকে বলেন তাঁকে হত্যা করতে। কিন্তু এরপর
অর্জুন কৃষ্ণের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন এবং পূর্ণ উদ্যম নিয়ে যুদ্ধ করার
প্রতিজ্ঞা করেন। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠির এবং অর্জুনকে নির্দেশ দেন যাতে তারা
ভীষ্মের দেওয়া যুদ্ধজয়ের বর ফিরিয়ে দেয়, কারণ ভীষ্ম স্বয়ং সেই যুদ্ধে
পাণ্ডবদের প্রতিপক্ষ হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ভীষ্মকে এ কথা জানানো হলে
তিনি এ কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পেরে কীভাবে তিনি অস্ত্র পরিত্যাগ
করবেন সে উপায় পাণ্ডবদের বলে দেন। তিনি বলেন যে, যদি কোন নারী
যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করে তবেই তিনি অস্ত্রত্যাগ করবেন। পরের দিন কৃষ্ণের
নির্দেশে শিখণ্ডী, অর্থাৎ যিনি পূর্বজন্মে অম্বা ছিলেন তিনি অর্জুনের সাথে
যুদ্ধে যোগদান করেন এবং ভীষ্ম তাঁর অস্ত্রসকল নামিয়ে রাখেন। এছাড়াও কৃষ্ণ
ধৃতরাষ্ট্রের জামাতা জয়দ্রথকে বধ করতে অর্জুনকে সহায়তা করেন। জয়দ্রথের
কারণেই অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু দ্রোণাচার্যের চক্রব্যূহে প্রবেশ করেও
বেরিয়ে আসার উপায় অজ্ঞাত থাকায় কৌরবদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। কৃষ্ণ
কৌরবদের সেনাপতি দ্রোণাচার্যের পতনও সম্পন্ন করেছিলেন। তিনি ভীমকে নির্দেশ
দিয়েছিলেন অশ্বত্থামা নামক একটি হাতিকে বধ করতে এবং তাৎপর্যপূর্ণভাবে
দ্রোণাচার্যের পুত্রের নামও অশ্বত্থামা। এরপর কৃষ্ণের নির্দেশে যুধিষ্ঠির
দ্রোণাচার্যকে গিয়ে বলেন যে অশ্বত্থামা নিহত হয়েছেন এবং তারপর খুব
মৃদুস্বরে বলেন যে সেটি একটি হাতি। কিন্তু যেহেতু যুধিষ্ঠির কখনও মিথ্যাচার
করতেন না তাই দ্রোণাচার্য তাঁর প্রথম কথাটি শুনেই মানসিক ভাবে অত্যন্ত আহত
হন ও অস্ত্র পরিত্যাগ করেন। এরপর কৃষ্ণের নির্দেশে ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের
শিরশ্ছেদ করেন।
কর্ণের সাথে অর্জুনের যুদ্ধের সময় কর্ণের রথের চাকা
মাটিতে বসে যায়। তখন কর্ণ যুদ্ধে বিরত থেকে সেই চাকা মাটি থেকে ওঠানোর
চেষ্টা করলে কৃষ্ণ অর্জুনকে স্মরণ করিয়ে দেন যে কৌরবেরা অভিমন্যুকে
অন্যায়ভাবে হত্যা করে যুদ্ধের সমস্ত নিয়ম ভঙ্গ করেছে। তাই তিনি নিরস্ত্র
কর্ণকে বধ করে অর্জুনকে সেই হত্যার প্রতিশোধ নিতে আদেশ করেন। এরপর যুদ্ধের
অন্তিম পর্বে কৌরবপ্রধান দুর্যোধন মাতা গান্ধারীর আশীর্বাদ গ্রহণ করতে যান
যাতে তার শরীরের যে অঙ্গসমূহের উপর গান্ধারীর দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হবে তাই
ইস্পাতকঠিন হয়ে উঠবে। তখন কৃষ্ণ ছলপূর্বক তার ঊরুদ্বয় কলাপাতা দিয়ে
আচ্ছাদিত করে দেন। এর ফলে গান্ধারীর দৃষ্টি দুর্যোধনের সমস্ত অঙ্গের উপর
পড়লেও ঊরুদ্বয় আবৃত থেকে যায়। এরপর যখন দুর্যোধনের সাথে ভীম গদাযুদ্ধে
লিপ্ত হন তখন ভীমের আঘাত দুর্যোধনকে কোনভাবে আহত করতে ব্যর্থ হয়। তখন
কৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীম ন্যায় গদাযুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন করে দুর্যোধনের ঊরুতে
আঘাত করেন ও তাকে বধ করেন। এইভাবে কৃষ্ণের অতুলনীয় ও অপ্রতিরোধ্য কৌশলের
সাহায্যে পাণ্ডবেরা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জয় করে। এছাড়াও কৃষ্ণ অর্জুনের
পৌত্র পরীক্ষিতের প্রাণরক্ষা করেন, যাকে অশ্বত্থামা মাতৃগর্ভেই
ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে আঘাত করেছিলেন। পরবর্তীকালে পরীক্ষিতই পাণ্ডবদের
উত্তরাধিকারী হন।
যুধিষ্ঠির যুদ্ধ এড়াবার জন্য তাঁর পাঁচ ভাইয়ের জন্য পাঁচটি গ্রাম প্রার্থনা করলে দুর্যোধন তাও প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। যুদ্ধের পূর্বে দুর্যোধন উলুকের দ্বারা পাণ্ডবদের প্রতি কটুবাক্য বর্ষণ করান। অন্যায় যুদ্ধে অর্জুনপুত্র অভিমন্যুকে হত্যা করার সময় সপ্তরথীদের মধ্যে দুর্যোধন ছিল। কর্ণবধের পর কৃপাচার্য সন্ধির পরামর্শ দিলে দুর্যোধন তা প্রত্যাখ্যান করেন। যুদ্ধের ১৮ দিনে দুর্যোধনের সকল সৈন্য নিহত হলে- ইনি পালিয়ে দ্বৈপায়ন হ্রদে যান। মায়া দ্বারা জলের স্তম্ভ তৈরি করে সেখানে লুকিয়ে থাকেন। এই সময় দুর্যোধনের পক্ষের তিন সেনাপ্রধান অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা যুদ্ধের পরামর্শ করতে এলে- তিনি পরদিনের জন্য এই আলোচনা স্থগিত রাখতে বলেন। এই আলোচনা কয়েকজন শিকারী শুনে পাণ্ডবদের কাছে এসে দুর্যোধনের অবস্থানের কথা জানান। পাণ্ডবরা সেখানে এলে, ভীমের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। উল্লেখ্য ইনি ভীমকে হত্যা করার জন্য তের বত্সর এক লৌহ মূর্তির উপর গদা প্রহারের অভ্যাস করেছিলেন। সরস্বতী নদীর দক্ষিণ প্রান্তে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। গদা যুদ্ধে ভীম অত্যন্ত বলশালী হলেও দুর্যোধন অত্যন্ত কৌশলী ছিলেন। কৃষ্ণের ইক্তি ভীম অন্যায়ভাবে দুর্যোধনের উরুতে আঘাত করে তা ভেঙে দেন। উল্লেখ্য গদা যুদ্ধে কটি দেশের নিম্নে আঘাত করা অন্যায় বলে বিবেচিত হত। উরু ভঙ্গের পর ভীম তাঁর বাম পা দিয়ে দুর্যোধনের মাথা নিষ্পেষণ করেন। এই অন্যায় যুদ্ধ দেখে উপস্থিত বলরাম ভীমকে হত্যা করতে অগ্রসর হলে কৃষ্ণ তাঁকে নিবারণ করেন। দুর্যোধন এই অন্যায় যুদ্ধের জন্য কৃষ্ণকে তিরস্কার করেন।
পাণ্ডবেরা মৃতপ্রায় দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করে চলে গেলে, সেখানে কৃপাচার্য, কৃতবর্মা ও অশ্বত্থামা আসেন। এরপর দুর্যোধন অশ্বত্থামাকে সেনাপতি হিসাবে নিয়োগ করেন এবং ভীমের ছিন্নমুণ্ডু আনার নির্দেশ দেন। এই তিনজনই রাত্রিকালে পাণ্ডব শিবিরে প্রবেশ করে ঘুমন্ত সকলকেই হত্যা করেন। এই সময় পঞ্চপাণ্ডব কৃষ্ণ ও সাত্যকি অনত্র্য থাকায় তাঁরা রক্ষা পান। অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে এই সংবাদ প্রেরণ করলে আনন্দ চিত্তে প্রাণত্যাগ করেন। অস্ত্রাঘাতে মৃত্যুর জন্য ইনি স্বর্গলাভ করেন।
সঞ্জয়
ছিলেন মহাভারতে বর্ণিত রাজা ধৃতরাষ্ট্র-এর রথের সারথি এবং ব্যাসদেব-এর
শিষ্য।সারথি হলেও তিনি ছিলেন একজন সৎ ও ন্যায়পরায়ন মানুষ।হস্তিনাপুরের
তৎকালীন মহারাজ ধৃতারাষ্ট্রের প্রিয় সারথি ছিলেন তিনি।সঞ্জয় ছিলেন সূত-
(সারথি) বংশজাত।শ্রীমদ্ভাগবত গীতার (০১/১৩/৩২) এখানে সঞ্জয়কে গাবল্গন বলা
হয়েছে অর্থাৎ সূত গাবল্গন হচ্ছেন সঞ্জয়ের পিতা।অর্থাৎ তিনি গবলগনের পুত্র
ছিলেন।এই বিদ্বান ও স্পষ্টবক্তা সঞ্জয় আবার ছিলেন জন্মান্ধ রাজা
ধৃতরাষ্ট্রের অন্যতম মন্ত্রীও। ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি সব সময়েই সৎ পরামর্শ
দিয়েছেন। ব্যাসদেবের প্রসাদে সঞ্জয় দিব্য দৃষ্টি লাভ করে ধৃতরাষ্ট্রকে
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বিবরণী শুনিয়েছেন।কারন তিনি তাঁর গুরু ব্যাসদেবের
কৃপায় যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত না-থেকেও দিব্য চোখে সব দর্শন করতে পারতেন।
এই সময় ধৃতরাষ্ট্র নিজের বা কৌরবদের পক্ষ নিয়ে কোনও অসত্য উক্তি করলে, তিনি
কঠোর ভাবে তার সমালোচনা করেছেন। মহাযুদ্ধের শেষদিনে সাত্যকির হাতে সঞ্জয়
বন্দী হন, কিন্তু ব্যাসদেবের হস্তক্ষেপে তিনি মুক্তি পান।এরপর ধর্মপুত্র
মহারাজ যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে বসলে তিনি সঞ্জয়কে বহুবিধ
গুরুত্বপূর্ণ কর্মের দায়িত্ব দেন।যুধিষ্টিরের রাজ্য শাসনের পনেরো বৎসর পরে
যখন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র নিজ পত্নী রানী গান্ধারীকে নিয়ে বানপ্রস্থে চলে
যাচ্ছেন।তখন মহামতী বিদুর ও পান্ডবজননী রানী কুন্তির সঙ্গে সঞ্জয়ও তাঁদের
সাথী হন।তারপর কঠোর তপস্যায় বিদুরের আত্মত্যাগের পর যখন মহারাজ
ধৃতরাষ্ট্র,রানী গান্ধারী ও রানী কুন্তি তপস্যারত অবস্থায় অরণ্যের দাবনলের
অগ্নিতে নিজেদের আহুতি দেন, তখন ধৃতরাষ্ট্রের নির্দেশে সঞ্জয় তাঁদের ছেড়ে
হিমালয়ে পর্বতের দিকে।তারপর তিনি হিমালয়ে গমন করেন এবং সেখানেই তাঁর
জীবনাবসান ঘঠে।