Thursday, January 7, 2021

Post # 1014 Bengali Amarchitra Katha 127

                                                                        ডাউনলোড করুন


মার্কিন পণ্ডিত বলেছেন, গীতা একই সঙ্গে দুই বই। একটি যুদ্ধের গীতা, অন্যটি দার্শনিক গীতা। এই বহুস্বরটি মনে রেখেই গীতা পড়তে হবে। 

 

ওয়ারেন হেস্টিংস বেঁচে থাকলে খুশি হতেন! অজস্র পৃষ্ঠা থেকে ঝাড়াইবাছাই করে তাঁর সম্পাদনায় জন্মানো বইটিই ভারতের জাতীয় গ্রন্থ!

অষ্টাদশ শতক, কোম্পানির শাসন। কলকাতা ও বারাণসীর ঘিঞ্জি মহল্লায় তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানি চার্লস উইলকিন্স অনুবাদ করছেন মহাভারত। তিনি গভর্নর জেনারেল হেস্টিংসকে খসড়া পাণ্ডুলিপিটি পড়তে দেন। কৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথনটি আলাদা করে নেন হেস্টিংস। তার পরই ১৮৭৪ সালের ৪ অক্টোবর কোম্পানির চেয়ারম্যান ন্যাথানিয়েল স্মিথকে তাঁর চিঠি: ‘এই পত্র যাকে নিয়ে, সে এর বিন্দুবিসর্গ জানে না।’ আরও জানান, কোম্পানির অর্থ-দাক্ষিণ্যে এই বই মুদ্রিত হওয়া উচিত। পরের বছরই কোম্পানির খরচে লন্ডনে উইলকিন্সের ‘Dialogues of Kreeshna and Arjoon in Eighteen Lectures with Notes’ বইয়ের প্রকাশ। সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে অনূদিত প্রথম বই। তার চেয়েও বড় কথা, পুঁথির আমলে আলাদা গীতা ছিলই না। সে ছিল মহাভারতে, শাস্ত্রীদের ভাষ্য ও টীকায়। বিদেশি শাসকের উদারতা ও খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে হুবহু মিলে যাওয়ার কারণে যে বইয়ের জন্ম, বিদেশমন্ত্রী তাকেই জাতীয় গ্রন্থ বলেন!

সুষমা স্বরাজের অকাট্য যুক্তি: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান বারাক ওবামাকে গীতা উপহার দিয়েছেন, জাতীয় গ্রন্থ বটে! ঠাকুর, কে তোমাকে চেনাত, না চেনালে অচিন্ত্য! প্রথম পরমাণু বিস্ফোরণের পর বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার গীতার শ্লোক আউড়েছিলেন। সুষমা ইচ্ছে করলে সংসদের লাইব্রেরিতে উনিশ শতকের দুই মার্কিন কবি এমারসন এবং থুরো-র বই ঘেঁটে নিতে পারেন। এমারসন বলছেন ‘গীতাই আদিগ্রন্থ’, থুরোর মতে ‘গীতার বিশাল বিশ্বদর্শনের পাশে শেক্সপিয়ারকেও কাঁচা লাগে।’ থুরো, এমার্সন দু’জনেই প্রথম উইলকিন্সের অনুবাদে গীতার সঙ্গে পরিচিত হন। বাংলায় রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে মহারাষ্ট্রে কে টি তেলঙ্গ, জার্মানিতে স্লেগেল, ম্যাক্স মুলার, সকলে গীতার অনুবাদ ও ভাষ্য লিখেছেন উইলকিন্স পড়ে।

ওয়ারেন হেস্টিংস বা উইলকিন্সকে শুধু সুষমা নয়, সকলের গড় করা উচিত। জনসমাজে আজ যে গীতা মানেই ভগবদ্গীতা, শ্রাদ্ধকাজে পড়তে হয়, এক কপি ব্রাহ্মণকে দান করতে হয়, সে নিয়মটি অবশ্যই ছাপা বইয়ের যুগে তৈরি। ক’টা লোক আর হাতে পুঁথি লিখতে পারত? ছাপা হওয়ার পরই গীতা সকলের হাতে হাতে পৌঁছয়, সে হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অন্যতম অস্ত্র।

মধ্যযুগে শঙ্কর, রামানুজ দু’জনেই গীতাকে স্মৃতিশাস্ত্রের বর্গে ফেলেছেন। স্মৃতি মানে পুরাণের চেয়ে ওপরে, কিন্তু শ্রুতির (বেদ) নীচে। গীতা নয়, বেদই শীর্ষে। বেঁচে থাকলে শঙ্কর, রামানুজ কেউই গীতাকে ‘জাতীয় গ্রন্থ’ বলতেন না। গীতার গুরুত্ব অন্যত্র। স্মৃতি, কিন্তু শ্রুতিতুল্য। অদ্বৈতবাদী শঙ্কর থেকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদী নিম্বার্ক বা দ্বৈতবাদী মধ্ব, সকলে এই স্মৃতি থেকেই বেছে নেন নিজস্ব দার্শনিক প্রস্থান। গীতার জন্য নয়, ব্যাসদেব বা বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়েই তাঁরা গীতাভাষ্য রচনা করছেন। এবং এক-একটি শব্দই আলাদা করে দেয় তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১২ নম্বর শ্লোকে ‘জনাধিপাঃ’ শব্দ আছে। রামানুজের ব্যাখ্যা, বহু আত্মার ভেদ বোঝাতেই এই বহুবচন। শাঙ্করভাষ্যে আনন্দগিরির টীকা অন্য: এই বহুবচন দেহের নানাত্ব স্বীকার করিয়া, আত্মার নানাত্ব অভিপ্রায়ে নয়। জাতীয় ভাষ্য কোনটি হবে? শঙ্কর, না রামানুজ?

একটি কথা অবশ্য পরিষ্কার। বৈদান্তিক শঙ্কর মনে করতেন, যাগযজ্ঞকে অজ্ঞরাই প্রাধান্য দেয়। তাঁকে মানলে লালকেল্লায় গীতার পাঁচ হাজার বছরের জন্মোৎসব, পাঁচ হাজার লোককে নিয়ে যজ্ঞ, ইত্যাদি কর্মকাণ্ড ঘটত না।

কর্মকাণ্ডে গুরুত্ব ছাপা যুগের অবদান। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে বালগঙ্গাধর টিলক, সকলের গীতাভাষ্যে তখন জাতীয়তাবাদী অনুরণন। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪৭ নম্বর শ্লোক ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’ই যেন বইয়ের নির্যাস। ফলের আশা না রেখে নিষ্কাম কর্ম! শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এক সাম্প্রতিক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, শঙ্কর, রামানুজ থেকে মধ্ব, নিম্বার্ক, কেউই ওই শ্লোকটিতে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। শঙ্করের ভাষ্য: পার্থ, তোমার জ্ঞাননিষ্ঠার অধিকার নেই, কিন্তু কর্মে অধিকার আছে। কর্ম করতে করতে কর্মফলে তৃষ্ণা না হোক। যখনই কর্মফলে তৃষ্ণা হবে, তুমি কর্মফল প্রাপ্তির হেতু হবে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতি সেই ভাষ্যের সঙ্গে আমাদের ছেদ ঘটিয়ে দেয়। কর্মফলের বদলে কর্মই তখন গুরুত্ব পেতে থাকে।

একটা ছোট্ট ঘটনা। বিপ্লবী অরবিন্দ প্রথম দিকে মেনে নিয়েছিলেন বঙ্কিমের গীতা-অনুবাদ। পরে ‘এসেজ অন গীতা’ বইয়ে তাঁর বক্তব্য, বঙ্কিম থেকে টিলক, ‘মা ফলেষু কদাচন’তে গুরুত্ব দিয়ে সবাই ভুল করেছেন। গীতার সার: সর্বধর্ম পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। বাংলায় জাতীয় গ্রন্থের কোন ভাষ্য পড়ব? বঙ্কিম না অরবিন্দ?

বছর কয়েক আগে জুয়ান মাস্কারো লিখেছিলেন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ মাথায় না রেখে গীতা পড়তে হবে। সম্প্রতি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড ডেভিস আবার তাঁর ‘দ্য ভগবগদ্গীতা: আ বায়োগ্রাফি’তে দেখিয়েছেন, গীতা একই সঙ্গে দুই বইয়ের দ্যোতনা। একটি যুদ্ধের গীতা, অন্যটি দার্শনিক গীতা। এই বহুত্বকে মনে রেখেই পড়তে হবে। শঙ্কর-রামানুজ থেকে হাল আমলেও যে বই নিয়ে তাত্ত্বিকরা একমত হতে পারছেন না, সেটিই জাতীয় গ্রন্থ?

জাতীয় গ্রন্থের এই সওয়াল উঠল কোথায়? লালকেল্লা প্রাঙ্গণে গীতার ৫১৫১তম জন্মতিথির উৎসবে। অত দিন আগেই নাকি শ্রীকৃষ্ণ যুযুধান দুই সেনার মাঝে রথ স্থাপন করে অর্জুনকে ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি’ শুনিয়েছিলেন। পাঁচ হাজারের হিসেব কোত্থেকে এল? খুঁজতে খুঁজতে দেখা গেল, ১৯৩৫ সালে মরাঠি শ্রীপুরোহিত স্বামীর ‘দ্য গীতা: দ্য গসপেল অব শ্রীকৃষ্ণ’ বইটি বড়োদরার মহারাজার অর্থানুকূল্যে ছাপা হয়। লেখক বইটি কবি ইয়েটসকে পাঠিয়ে দেন। সঙ্গে চিঠি: ‘গ্রহণ করো এই গীতা। ভারতীয় ঐতিহ্যমতে এর উন্মোচন হয়েছিল আজ থেকে ৫০৩৬ বছর আগে।’ ইতিহাস এখন নিঃসংশয়, ঋগ্বেদই মেরেকেটে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। উপনিষদ ও বৌদ্ধধর্মের প্রবল অভিঘাতে ব্রাহ্মণ্যধর্ম অ্যাডজাস্ট করতে বাধ্য হয়। তখনই গীতার জন্ম। বোঝা গেল, সুষমারা গুজরাত, মহারাষ্ট্রের আশি বছরের পুরনো ভুলেই আমোদিত।

আর একটি প্রশ্ন।  ৫১৫১ বছর আগে শ্রীকৃষ্ণ যদি অর্জুনকে গীতা শুনিয়ে থাকেন, সেটি ভুলে গেলেন কবে? মহাভারতের শেষ দিকে আছে অনুগীতা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ, অশ্বমেধ যজ্ঞও সমাপ্ত, পাণ্ডবরা সুখে রাজত্ব করছেন, শ্রীকৃষ্ণ ফিরে যাবেন দ্বারকায়। অর্জুন তাঁকে বললেন, কুরুক্ষেত্রে তুমি কত ভাল কথা বলেছিলে, বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলে! কিন্তু কিছু মনে নেই। শ্রীকৃষ্ণ রেগে গেলেন, ‘তোমার মতো নির্বোধকে ও সব বলাই ভুল হয়েছিল।’ অর্জুন অনুনয় করতে থাকলে শ্রীকৃষ্ণ বলেন, ‘দুচ্ছাই, সে সব নিজেও ভুলে গিয়েছি। তখন যোগবশে বলেছিলাম। অন্য কথা বলি, শোনো।’ তার পরই সিদ্ধ ও তাঁর শিষ্য কাশ্যপ, পরশুরাম, ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী, নানাবিধ গল্প। সেটিই অনুগীতা। যুদ্ধের সময় যা বলা যায়, শান্তির সময়ে ভুলে যেতে হয়! গীতা সতিই জাতীয় গ্রন্থ। ভোটের সময় নেতারা যা-ই বলুন, পরে ভুলে যান।

 



শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা-ভূমিকা

(স্বামী জগদীশ্বরানন্দ)

ভূমিকা-সূচী

1) প্রস্তাবনা
2) গীতার মহিমা
3) গীতার প্রাচীনত্ব

3.1) গীতা ও বৌদ্ধধর্ম
3.2) গীতা ও মহাভারত

3.2.1) কালনির্ণয়ে জ্যোতিষশাস্ত্র

3.3) গীতা ও পতঞ্জলির যোগসূত্র
3.4) গীতা ও ব্রহ্মসূত্র
3.5) গীতা ও উপনিষদ্‌
3.6) গীতা ও শতপথ-ব্রাহ্মণ

4) গীতার ভাষা
5) গীতাসাহিত্য

6) গীতার ঐতিহাসিক সমালোচনা

6.1) গীতা মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত ?
6.2) গীতা মহাভারতের প্রকৃত অংশ

7) গীতার শ্লোকসংখ্যা

7.1) ব্যাসদেবের মত
7.2) শ্রীচৈতন্যদেবের মত
7.3) প্রাচীন হস্তলিখিত পুঁথি
7.4) কাশ্মীরী গীতা
7.5) শঙ্করাচার্যের মত
7.6) শুদ্ধ ধর্মমণ্ডল গীতা
7.7) আলবেরুনির মত
7.8) ফারসী ও আরবী অনুবাদ

8) গীতার বিবিধ ভারতীয় ব্যাখ্যা

8.1) অদ্বৈতবাদ
8.2) বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ
8.3) দ্বৈতবাদ
8.4) দ্বৈতাদ্বৈতবাদ
8.5) অন্যান্য ব্যাখ্যা
8.6) ত্যাগই গীতার বাণী

9) গীতার বৈদেশিক ব্যাখ্যা
10) গীতার প্রচার

10.1) ইংরেজী অনুবাদ
10.2) অন্যান্য বিদেশী ভাষায় অনুবাদ
10.3) বাংলায় অনুবাদ
10.4) গীতার অন্যান্য প্রচার

11) গীতা ও উপনিষদাবলী

11.1) উপনিষদ্‌ এবং গীতার শ্লোকে সাদৃশ্য
11.2) গীতা এবং ব্রহ্মতত্ত্ব
11.3) যুদ্ধক্ষেত্রে গীতা কিরূপে উপদিষ্ট হইল ?

12) গীতা ও ভাগবত
13) গীতার উদারতা
14) গীতায় আত্মার অমরত্ব
15) গীতায় অবতারবাদ
16) গীতোক্ত কর্মযোগ
17) বৌদ্ধধর্ম ও গীতা

17.1) যোগক্ষেম শব্দের ব্যবহার

18) গীতায় যোগচতুষ্টয়ের সমন্বয়

18.1) নিষ্কাম কর্মযোগ দ্বারা মুক্তি
18.2) জ্ঞানযোগ দ্বারা মুক্তি
18.3) ভক্তিযোগ দ্বারা মুক্তি
18.4) রাজযোগ দ্বারা মুক্তি

19) গীতাকবচ
20) গীতামাহাত্ম্য


1) প্রস্তাবনা

গীতা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ । গীতা যে শুধু হিন্দুধর্মের সকল সম্প্রদায় কর্তৃক সমাদৃত তাহা নহে, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অসংখ্য নরনারী শ্রদ্ধাভরে ইহা পাঠ করেন । জার্মান মনীষী উইলিয়াম ভন হামবোল্‌ট বলিয়াছেন, “গীতার মতো সুললিত, সত্য এবং সুগভীর তত্ত্বপূর্ণ পদ্যগ্রন্থ সম্ভবতঃ পৃথিবীর আর কোন ভাষায় নাই ।” পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছত্রিশটি ভাষায় আজ পর্যন্ত ইহার পঁচিশ শতাধিক সংস্করণ হইয়াছে । জার্মান, ফরাসী, ইংরেজী প্রভৃতি ইওরোপের প্রধান ভাষাসমূহে গীতার অনুবাদ বিদ্যমান । ১৭৮৫ খ্রীষ্টাব্দে গীতার প্রথম ইংরেজী অনুবাদ লণ্ডনে মুদ্রিত হয় । অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে রুশ ভাষায় গীতার অনুবাদ হইয়াছিল । প্রসিদ্ধ ইংরেজ মনীষী কার্লাইল বিখ্যাত মার্কিন মনীষী এমার্সনের সহিত সাক্ষাৎকালে তাঁহাকে একখানি গীতা উপহার দিয়াছিলেন । গীতার প্রভাব এমার্সনের সারগর্ভ রচনাবলীতে সুস্পষ্ট দেখা যায় । তিলক বলেন, “গীতার মতো অপূর্ব গ্রন্থ সংস্কৃত সাহিত্যে কেন, জগতের সাহিত্যে দুর্লভ ।”

2) গীতার মহিমা

স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, “উপনিষদ্‌ হইতে আধ্যাত্মিক তত্ত্বের কুসুমরাজি চয়ন করিয়া গীতারূপ এই সুদৃশ্য মাল্য গ্রথিত হইয়াছে ।”

মহাত্মা গান্ধী বলেন, “গীতা মানবের পারমার্থিক জননী । আমার গর্ভধারিণীর স্বর্গগমনের পর গীতা তাঁহার স্থান অধিকার করিয়াছে ।”

সমগ্র মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ সূরিতাঁহার গীতাব্যাখ্যার প্রারম্ভে লিখিয়াছেন – ‘মহাভারতে সকল বেদের সারার্থ সংগৃহিত । আর সমগ্র মহাভারতের সারতত্ত্ব গীতায় বর্তমান । সেইজন্য গীতা সর্বশাস্ত্রময়ী । সকল শাস্ত্রের সার গীতায় নিহিত ।’

কেশব কাশ্মীরী সত্যই বলিয়াছেন – “শ্রীভগবান্‌ করুণাপূর্বক ভবসাগর পার হইবার জন্য গীতারূপ নৌকা সৃষ্টি করিয়াছেন । উহার সাহায্যে ভগবদ্ভক্তগণ অনায়াসে সংসার-সমুদ্র অতিক্রম করিতে পারিবেন ।”

বাংলার ভূতপূর্ব গবর্ণর লর্ড রোনাল্ডসের মতে গীতাতত্ত্বই ভারতীয় চিন্তার পূর্ণ পরিণতি ও সূক্ষ নির্যাস ।

মোগল সম্রাট্‌ শাজাহানের পুত্র দারাশিকোলিখিয়াছেন, “গীতা স্বর্গীয় আনন্দের অফুরন্ত উৎস । সর্বোচ্চ সত্যলাভের সুগম পথ গীতায় প্রদর্শিত । গীতায় পরমপুরুষের কথা বিবৃত ও ব্রহ্মবিদ্যা ব্যাখ্যাত । গীতা ইহলোক ও পরলোকের সুগভীর ও শ্রেষ্ঠ রহস্যের দ্বারোদ্ঘাটন করেন ।”

ইংরেজ মনীষী ডক্টর এল.ডি.বার্নেট বলেন, “লক্ষ লক্ষ লোক গীতা পড়িয়াছেন বা শুনিয়াছেন । সকলেই উহার পাঠে বা শ্রবণে বুঝিতে পারেন যে, ঈশ্বরলাভের দুর্গম পথে উহা শ্রেষ্ঠ সম্পদ ও সহচর । জীবনের প্রত্যেক কর্মকে অনাসক্তির অনলে শুদ্ধ করিয়া উপাসনায় পরিণত করার যে অপূর্ব কৌশল গীতা শিক্ষা দেয়, তাহা মানবের কর্মজীবনের অনন্য অবলম্বন ।”

শোনা যায়, জনৈক ফরাসী তত্ত্বপিপাসু দ্বাদশ বৎসর গীতার স্বাধ্যায় করিয়া বলিয়াছেন, “গীতাকে ধর্মজীবনের চিরসঙ্গী করিলে অন্য কোন ধর্মগ্রন্থপাঠের আবশ্যকতা থাকে না ।”

এক শত ষাট বৎসর পূর্বে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম গবর্ণরজেনারেল ওয়ারেন্‌ হেস্টিংস, চার্লস উইলকিন্স-কৃত গীতার ইংরেজী অনুবাদের ভূমিকায় লিখিয়াছেন – “গীতার প্রাচীনত্ব এবং যে পূজা উহা বহু শতাব্দী যাবৎ মনুষ্যজাতির এক বৃহদংশের নিকট হইতে পাইয়া আসিতেছে তাহার দ্বারা গীতা সাহিত্য-জগতে এক অভূতপূর্ব বিস্ময় উৎপাদন করিয়াছে । উহার সাহিত্যিক গুণাবলী জগতে অননুকরণীয় । গীতাপাঠে শুধু ইংরেজগণ কেন, সমগ্র বিশ্ববাসী উপকৃত হইবেন । গীতাধর্মের অনুশীলনে মাননজীবন শান্তিধামে পরিণত হইবে ।

গীতা হিন্দুদের নৈতিক উন্নতি, সাহিত্য-সৃষ্টি ও পৌরাণিক রহস্যভেদের আশ্চর্যজনক প্রামাণিক গ্রন্থের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন । যদিও ইওরোপের সভ্যতা, ধরমাচরণ ও নৈতিক ব্যবহার গীতোক্ত শিক্ষা হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, তথাপি উহা আমাদের ধর্মসাধনে ও নৈতিক কর্তব্যপালনে বিশেষ সহায়ক হইবে । যে সাধনতত্ত্বের বিষয়ে ইওরোপের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতকুল এবং সাধকগণ অজ্ঞ, ভারতের সেই সনাতন সাধনার কথা গীতা বলিয়াছেন । গীতার মৌলিকত্ব, ভাবের গভীরতা ও অভিনবত্ব, দার্শনিক তত্ত্বের উচ্চতা, বলিষ্ঠ যুক্তিতর্ক ও ব্যাখ্যা-কৌশল অপূর্ব ও অসাধারণ । গীতার উপদেশ খ্রীষ্টান ধর্মের মূলসূত্রগুলির প্রকৃত ও সরল ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ।”

3) গীতার প্রাচীনত্ব

3.1) গীতা ও বৌদ্ধধর্ম :-

গীতা যে কত প্রাচীন সেই সম্বন্ধে পণ্ডিতগণের মধ্যে বিশেষ মতভেদ আছে । অনেকের মত – গীতা ভগবান্‌ বুদ্ধের পরবর্তী । ডাঃ লরিনসারের মতে গীতা বুদ্ধদেবের জন্মের অনেক পরে; এমন কি যীশুখ্রীষ্টের আবির্ভাবের কয়েক শতাব্দী পরে রচিত । মারাঠী পণ্ডিতটেলাং তাঁহার গীতার উপক্রমণিকায় লিখিয়াছেন যে, উহা খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীরও কিছু পূর্বে লিখিত এবং ডাঃ লরিনসারের অযৌক্তিক উক্তির তীব্র সমালোচনা করিয়াছেন ।

স্যার আর.জি.ভাণ্ডারকর তাঁহার “Vaisnavism and Saivism” (p.13) গ্রন্থে বলেন – “গীতাতে ব্যূহের কোন উল্লেখ নাই । সুতরাং ইহার জন্মতারিখ, শিলালিপি ও নির্দেশ পতঞ্জলির বহু পূর্বে অর্থাৎ গীতার উৎপত্তি খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর প্রারম্ভের পরে কিছুতেই নহে; তবে চতুর্থ শতাব্দীর কত পূর্বে ইহার জন্ম তাহা নিশ্চয় করা সুকঠিন । গীতা যখন রচিত হয়, তখন বাসুদেব ও নারায়ণ অভেদ-জ্ঞানে পূজিত বা বাসুদেব বিষ্ণুর অবতাররূপে গৃহীত হন নাই । গীতাতে [১০|২১] বিষ্ণুকে প্রধান আদিত্য বলা হইয়াছে, পরমপুরুষ বলা হয় নাই এবং দশম অধ্যায়ে বাসুদেবকে সীমান্বিতভাবে বিষ্ণু বলা হইয়াছে; প্রত্যেক শ্রেণী বা জাতির মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ তিনিই তাঁহার দিব্য বিভূতি, ‘তেজোহংশসম্ভবম্‌’ । সুতরাং মারাঠী পণ্ডিত ভাণ্ডারকরের মতে গীতার জন্ম অন্ততঃ খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর পূর্বে ।

জার্মান পণ্ডিত গার্বের মতে মূল গীতা খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে এবং গীতার আধুনিক কলেবর খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে উৎপন্ন ।

নবম শতাব্দীতে শঙ্করাচার্য গীতাভাষ্য রচনা করেন । পঞ্চম শতাব্দীতে আবির্ভূত মহাকবিকালিদাস গীতার বিষয় অবগত ছিলেন । কালিদাসের ‘রঘুবংশে’ [১০|৩১] একটি বাক্য আছে, যাহার সহিত গীতার একটি শ্লোকের [৩|২২] নিকট-সাদৃশ্য আছে । সপ্তম শতাব্দীতেবাণভট্ট তাঁহার গ্রন্থে গীতার উল্লেখ করিয়াছেন । খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে বহু পুরাণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অনুকরণে অন্যান্য গীতা সৃষ্টি করিয়াছেন । ভাসের ‘কর্ণভার’ নাটকে‘হতোহপি লভতে স্বর্গং জিত্বা তু লভতে যশঃ’ – এই বাক্যটি গীতার একটি শ্লোকের [২|৩৭]প্রথমার্ধের প্রতিধ্বনি মনে হয় । ভাসের আবির্ভাবকাল কখনও খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে, কখনও বা খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে নির্দিষ্ট হয় । বোধায়নের (সম্ভবতঃ পঞ্চম শতাব্দীর) গৃহসূত্র ও পিতৃমেধসূত্রে গীতার শ্লোক উদ্ধৃত এবং বাসুদেবের উপাসনা বিবৃত আছে ।

ডাঃ সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণন্‌ বলেন, গীতা খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত । ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মতে গীতা বুদ্ধের পূর্ববর্তী কালে উৎপন্ন এবং উহা ভাগবত-ধর্মের প্রাচীনতম গ্রন্থ । ভাগবত-ধর্মের প্রাচীনত্ব তিলক, সেনার্টবুহ্‌লার কর্তৃক স্বীকৃত । বুহ্‌লার সাহেব বলেন যে, খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে জৈনধর্মের আবির্ভাবের বহু পূর্বে ভাগবত-ধর্মের উৎপত্তি । ডাঃ দাশগুপ্ত আরও বলেন, “গীতাতে বৌদ্ধ মতের কোন প্রকার উল্লেখ নাই এবং উহার ভাষাও পাণিনীয় নহে । সুতরাং গীতা নিশ্চিতই বুদ্ধের পূর্বে রচিত, কিছুতেই বুদ্ধের পরবর্তী যুগের নহে ।”

কেহ কেহ গীতায় নির্বাণ-শব্দটি কয়েকবার উল্লিখিত দেখিয়া মত প্রকাশ করেন যে, গীতা বৌদ্ধযুগে সৃষ্ট; কিন্তু এই প্রকার যুক্তি নিতান্ত অগভীর ও অর্বাচীন । কারণ, নির্বাণ-শব্দটি বৌদ্ধদের নিজস্ব নহে, উহা গীতাতে পাঁচবার ব্যবহৃত হইয়াছে [২|৭২, ৫|২৪,২৫,২৬, ৬|১৫] । কিন্তু এই পাঁচটি শ্লোকে নির্বাণ-শব্দটি ব্রহ্ম-শব্দের সহিত সদা সংযুক্ত দৃষ্ট হয় । গীতায় ব্রহ্মনির্বাণের অর্থ ব্রাহ্মী স্থিতি, বৌদ্ধ নির্বাণের মতো ‘শূন্য’ নহে । সুতরাং বৌদ্ধগণই যে গীতা হইতে নির্বাণ-শব্দটি গ্রহণ করিয়াছেন – এই মতই অধিকতর সমীচীন মনে হয় । অতএব স্পষ্টই প্রতীত এবং প্রমাণিত হয় যে, গীতা ভগবান্‌ বুদ্ধের পূর্বে রচিত ।

3.2) গীতা ও মহাভারত :-

গীতাকে  মহাভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে ধরিলে উহার আরও প্রাচীনত্ব প্রমাণিত হয় ।রমেশচন্দ্র দত্ত এবং প্র্যাট্‌ সাহেবের মতে মহাভারত খ্রীঃপূঃ ১২শ শতাব্দীতে রচিত । মহাভারতে অগ্নি, ইন্দ্রাদি বৈদিক দেবতার উপাসনা আছে । বৌদ্ধযুগে উক্ত মহাকাব্য প্রসিদ্ধ ছিল । উহাতে বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে কোন প্রকার উল্লেখ না থাকায় ম্যাক্‌ডোনেল বলেম, “মহাভারতের আদিম আকৃতি অন্ততঃ খ্রীঃপূঃ ৫ম শতাব্দীতে উৎপন্ন ।” আশ্বলায়নসূত্রে মহাভারতের উল্লেখ আছে ।গুপ্তরাজগণের শিলালিপিতে মহাভারতের নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত । কবি ভাস তাঁহার বহু রচনার ঘটনা মহাভারত হইতে গ্রহণ করিয়াছেন । অশ্বঘোষ তাঁহার ‘বুদ্ধচরিত’ ও ‘সৌন্দরনন্দ’ কাব্যে মহাভারতের উল্লেখ করিয়াছেন । বুহ্‌লার ও কির্‌স্টে (Buhler & Kirste) তাঁহাদের ‘Contributions to the Study of the Mahabharat’ নামক গ্রন্থে বলেন যে, মহাভারতের যে আকার বর্তমানে দৃষ্ট হয়, তাহা খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতকে বিজ্ঞাত এবং ৫ম শতকে প্রায় একই প্রকার ছিল । উহার কিয়দংশ পুরাণের যুগে রচিত । ডাঃ রাধাকৃষ্ণনের মতে মহাভারত অন্ততঃ খ্রীঃপূঃ ৫ম শতাব্দীতে উহার বর্তমান আকার লাভ করিয়াছিল । সম্ভবতঃ উহার মৌলিক আকৃতি খ্রীঃপূঃ ১১শ শতকে উৎপন্ন ।

3.2.1) মহাভারত ও গীতার কালনির্ণয়ে জ্যোতিষশাস্ত্র :-

মহাভারত যত প্রাচীন, গীতাও তত প্রাচীন । ১৯৪৪ খ্রীঃ এপ্রিল মাসে কাশীতে যে নিখিল ভারত প্রাচ্য সম্মেলন হইয়াছিল তাহাতে তিনজন জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত গীতার কালনির্ণয়বিষয়ক তিনটি প্রবন্ধ পাঠ করেন ।মিঃ কারান্তিকর বলেন খ্রীঃপূঃ ১৯৩১ অব্দে গীতোক্ত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হইয়াছিল । ডাঃ দফ্‌তরীর মতে খ্রীঃপূঃ ১১৬২ এবং অধ্যাপক সেনগুপ্তের মতে খ্রীঃপূঃ ২৫৬৬ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কাল ।

লোকমান্য তিলক ‘মাসানাং মার্গশীর্ষোহহম্‌’[১০|৩৫] – গীতার এই শ্লোকাংশ জ্যোতিষশাস্ত্রের দিক হইতে আলোচনা করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে, খ্রীষ্টজন্মের ১৪০০ বৎসর পূর্বে গীতা রচিত হইয়াছিল ।

3.3) গীতা ও পতঞ্জলির যোগসূত্র :-

‘যোগ’ শব্দটি  উভয় গ্রন্থে ব্যবহৃত হইলেও পতঞ্জলির যোগশব্দ অপেক্ষা গীতার যোগশব্দ অধিকতর ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত । যোগসূত্রের ৭০টি সূত্রের মধ্যে ১২টি সূত্রের শব্দপ্রয়োগে এবং গীতার শব্দপ্রয়োগে সমতা পরিলক্ষিত হয় । ইহাতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, গীতা পতঞ্জলিসূত্র অপেক্ষা প্রাচীনতর । পতঞ্জলি পাণিনীয় সূত্রের ভাষ্যকার, সুতরাং পাণিনির পরবর্তী । পতঞ্জলি পাণিনির ১০০ বা ১৫০ বৎসর পরবর্তী । পাণিনির সময় খ্রীঃপূঃ  ৮০০ হইতে খ্রীঃপূঃ ৫০০ বৎসরের মধ্যে ।

3.4) গীতা ও ব্রহ্মসূত্র :-

গীতায় ‘ব্রহ্মসূত্র’ শব্দটির প্রয়োগ দেখিয়া কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন, গীতা ব্রহ্মসূত্রের পরবর্তী । কিন্তু ব্রহ্মসূত্রের মধ্যে বৌদ্ধমতের উল্লেখ থাকায় ব্রহ্মসূত্রের সময়  খ্রীঃপূঃ ২৫০ অব্দ বলা যাইতে পারে । সুতরাং পূর্বোক্ত যুক্তির কোন সারবত্তা নাই ।

3.5) গীতা ও উপনিষদ্‌ :-

মিঃ টেলাঙ্গ এবং অন্যান্য পণ্ডিত গীতা এবং মুণ্ডক ও শ্বেতাশ্বতরাদি উপনিষদের ভাবসাদৃশ্য এবং অনেক স্থলে ভাষাসাদৃশ্য লক্ষ্য করিয়া অনুমান করেন যে, গীতা এবং মুণ্ডক ও শ্বেতাশ্বতরাদি উপনিষদ্‌ সমসাময়িক । মুণ্ডক উপনিষদে ‘অষ্টাদশোক্তমবরং যেষু কর্ম’ [১|২|৭]মন্ত্রাংশে সম্ভবতঃ অষ্টাদশ অধ্যায়াত্মক কোন গ্রন্থকে লক্ষ্য করিয়াছে । গীতা এবং মুণ্ডক উপনিষদে ‘অবরং কর্ম’ শব্দের প্রয়োগ আছে । ইহা হইতে মনে হয়, গীতা ও মুণ্ডক উপনিষদ্‌ সমসাময়িক । শ্রুতির ও স্মৃতির মধ্যবর্তী যুগে উপনিষৎসমূহ রচিত । ‘গীতাসূপনিষৎসু’বাক্যেও গীতা উপনিষদ্‌রূপে অভিহিত ।

3.6) গীতা ও শতপথ-ব্রাহ্মণ :-

পণ্ডিতগণের মতে শতপথ-ব্রাহ্মণ শ্রুতির সময়ের শেষভাগে রচিত । ‘কৃত্তিকাঃ প্রাচৈঃ দিশৈঃ ন চ্যবন্তে’ এই বাক্য হইতে মিঃ বৈদ্যপ্রমাণ করিয়াছেন যে, শতপথ-ব্রাহ্মণ খ্রীষ্টজন্মের অন্ততঃ তিন হাজার বর্ষ পূর্বে রচিত । এইরূপে মিঃ বৈদ্য এবং অধ্যাপক ভি.বি.আঠাওয়ালে বহু অকাট্য যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করিয়াছেন, গীতা খ্রীঃপূঃ তিন হাজার বর্ষ পূর্বে রচিত ।

4) গীতার ভাষা

গীতার ভাষা প্রাঞ্জল, সহজবোধ্য ও সুখপাঠ্য । গীতার সংস্কৃত সরল ও সাবলীল । তাহাতে অতি প্রাচীন শব্দের প্রয়োগে ব্যাকরণের সূত্র লঙ্ঘিত হইলেও মনে হয়, গীতার সময় সংস্কৃত প্রচলিত ভাষা ছিল, কেবলমাত্র পণ্ডিতগণের ভাষা ছিল না । কবিত্ব ও দার্শনিকতার এমন অপূর্ব সম্মিলন কুত্রাপি দেখা যায় না । সুমিষ্ট ও সরল সংস্কৃতে শ্লোকগুলি রচিত এবং কয়েকবার পাঠেই কণ্ঠস্থ হইয়া যায় । জীবন্ত ভাবটি ভাষার পাতলা আবরণ ভেদ করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে । ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মতে গীতার ভাষা বিস্তরশঃ অপাণিনীয় ও অপ্রচলিত (archaic)  এবং ভাষাভঙ্গীও অত্যন্ত প্রাচীন । গীতায় যে-সকল অপাণিনীয় বা আর্ষপ্রয়োগ আছে, তিনি তাঁহার নিম্নলিখিত তালিকা দিয়াছেন –

‘যুধ্য’ স্থলে ‘যুধ্যস্ব’ [৩|৩০]

‘নিবৎস্যসি’ স্থলে ‘নিবসিষ্যসি’ [১২|৮]

‘মা শোচীঃ’ স্থলে ‘মা শুচঃ’ [১৬|৫]

‘যমঃ সংযচ্ছতাম্‌’ স্থলে যমঃ সংযমতাম্‌’ [১০|২৯]

‘প্রিয়ায়া অহর্সি’ স্থলে প্রিয়ায়ার্হসি’ [১১|৪৪]

‘সেনান্যাম্‌’ স্থলে ‘সেনানীনাম্‌’ [১০|২৪]

আত্মনেপদী ধাতুর পরস্মৈপদী-রূপে ব্যবহারঃ-

যত্‌ [৬|৩৬, ৭|৩, ৯|১৪, ১৫|১১]রম্‌ [১০|৯]বিজ্‌ [৫|২০]

পরস্মৈপদী ধাতুর আত্মনেপদী-রূপে ব্যবহারঃ-

কাঙ্ক্ষ্‌ [১|৩১]ব্রজ্‌ [২|৫৪]বিশ্‌ [১৮|৫৫]ইঙ্গ্‌ [৬|১৯, ১৪|২৩]

আর্ষ সন্ধি – ‘হে সখেতি’ [৩|১০]

‘শক্লোষি’ স্থলে ‘শকস্যে’ [১১|৮, মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ]
‘ইমং মহিমানং’ স্থলে ‘ইদং মহিমানং [১১|৪১, মধুসূদন সরস্বতী]
‘নমস্কৃত্য’ স্থলে ‘নমস্কৃত্বা [১১|৩৫, মধুসূদন সরস্বতী]
‘ইমং ধর্মং’ স্থলে ‘ধর্মস্যাস্য [১১|৩৫, মধুসূদন সরস্বতী]

এইরূপ প্রায় ৩২টি আর্ষপ্রয়োগ গীতাতে আছে । ভাণ্ডারকর স্মৃতিগ্রন্থে (Commemoration Volume)প্রকাশিত শ্রী ভি.কে.রাজয়াডে উক্ত প্রকার অশুদ্ধির বহু দৃষ্টান্ত দিয়াছেন । এই প্রকার ভাষাগত অনিয়মের দ্বারা গীতার প্রাচীনত্বই প্রমাণিত হয় । পাণিনীয় ব্যাকরণের সূত্র“বাসুদেবার্জুনাভ্যাম্‌ বুঞ” [৪|৩৯৮] হইতে মনে হয়, পাণিনি মহাভারতীয় আখ্যায়িকার সহিত পরিচিত ছিলেন । সুতরাং গীতা যে পাণিনীয় ব্যাকরণের পূর্ববর্তী ইহা নিঃসন্দেহ এবং উহাতে অপাণিনীয় প্রয়োগ অবশ্যম্ভাবী ।

গীতার [৩|১৯,৩৬] শ্লোকদ্বয়ে পুরুষ শব্দে (দীর্ঘ) ঊকারের ব্যবহার দৃষ্ট হয় । গীতার বোধায়নভাষ্যের হস্তলিখিত পুঁথির মতে ‘ছন্দের অনুরোধে উক্ত (দীর্ঘ) ঊকার ব্যবহৃত’ । আবার ‘পুরুষ’ শব্দ যে অপাণিনীয় নহে, তাহা পাণিনিকৃত অষ্টাধ্যায়ীর সূত্র [৬|৩|১৩৭] হইতে জানা যায় ।

5) গীতাসাহিত্য

গীতার উপর বহু ভাষ্য ও টীকাদি (১৫-১৬টি) লিখিত হইয়াছে । গীতার শঙ্করভাষ্যইপ্রাচীনতম প্রাপ্ত ভাষ্য । শঙ্করের পূর্বেও যে গীতার ভাষ্যাদি রচিত হইয়াছিল, তাহার স্পষ্ট উল্লেখ দেখা যায় । গীতার শঙ্করভাষ্যের টীকায়[২|১০] আনন্দজ্ঞান গিরি বলেন, বেদান্তসূত্রের টীকাকার বোধায়ন গীতার উপর একটি বৃত্তি রচনা করিয়াছিলেন; কিন্তু উহা এখন পাওয়া যায় না । বোধায়নকে এইজন্য বৃত্তিকার বলা হয় ।

শঙ্করভাষ্য হিন্দী, মারাঠী, বাংলা, ইংরেজী, জার্মান প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হইয়াছে । শঙ্করভাষ্যের উপর আনন্দগিরি এবং রামানন্দ-কৃত যথাক্রমে ‘বিবরণ’ ও ‘ব্যাখ্যা’ নামক টীকাদ্বয় আছে । শঙ্করের পরে গীতার উপর ভাষ্যাদি রচনা কিছুকালের জন্য বন্ধ ছিল, মনে হয় ।

মধ্বাচার্য (আনন্দতীর্থ) ত্রয়োদশ শতাব্দীতে যে গীতাভাষ্য রচনা করিয়াছিলেন, তাহার উপর জয়তীর্থকৃত ‘প্রমেয়দীপিকা’ নামক টীকা আছে । মধ্বাচার্য-কৃত ‘ভগবদ্‌গীতা-তাৎপর্য-নির্ণয়’র উপর জয়তীর্থ ‘ন্যায়দীপিকা’ নামক টীকা লিখিয়াছেন ।

রামানুজাচার্য (ব্রহ্মসূত্রের ‘শ্রীভাষ্য’-রচয়িতা) একাদশ শতাব্দীতে বিশিষ্টাদ্বৈত-মতানুযায়ী যে গীতাভাষ্য রচনা করিয়াছিলেন, তাহার উপর বেঙ্কটনাথের (বেদান্তাচার্যের) ‘তাৎপর্য-চন্দ্রিকা’ নামক টীকা আছে ।

রামানুজ-গুরু যামুনাচার্য-কৃত ১০ম শতাব্দিতে রচিত ‘গীতার্থ-সংগ্রহে’র উপর নিগমান্ত মহাদেশিকের ‘গীতার্থ-সংগ্রহ-রক্ষণ’ এবং ১৪শ শতাব্দীর বরাবর মুনি-কৃত ‘গীতার্থ-সংগ্রহদীপিকা’ নামক টীকাদ্বয় বর্তমান । উল্লিখিত দ্বিতীয় টীকাটি কাঞ্জিভরম্‌ সুদর্শন প্রেস হইতে প্রকাশিত ।

যামুনাচার্য নামধারী দুই ব্যাক্তির গীতার উপর গদ্যে ও পদ্যে দুইটি টীকা পাওয়া যায় । গদ্য টীকাকার যামুনাচার্য বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী হইলেও রামানুজের গুরু নহেন । এই গদ্য টীকাটি কাঞ্জিভরম্‌ সুদর্শন প্রেস হইতে প্রকাশিত । উহাতে অন্বয়মুখে সরল পদার্থ দেওয়া আছে ।

বোম্বাই নির্ণয় সাগর প্রেস হইতে অষ্টভাষ্য-টীকা সম্বলিত যে গীতা প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে শঙ্করভাষ্যের ব্যাখ্যা ‘ভাষ্যোৎকর্ষদীপিকা’ এবং মধুসূদন সরস্বতীরটীকার ব্যাখ্যা ‘গূঢ়ার্থ-দীপিকা-তত্ত্বালোক’ (মৈথিলী পণ্ডিত শ্রীধর্মদত্ত শর্মা-কৃত) আছে ।

একমাত্র ভারতীয় ভাষা মারাঠীতে গীতার উপর দুইটি প্রসিদ্ধ টীকা আছে – (i) মহারাষ্ট্রের ধর্মগুরু জ্ঞানেশ্বর-রচিত, (ii)বালগঙ্গাধর তিলক-কৃত ‘গীতারহস্য’

তিলকের ‘গীতারহস্য’ এবং শ্রীঅরবিন্দের‘গীতানিবন্ধনিচয়’ বর্তমান যুগের দুইটি শ্রেষ্ঠ ভাষ্য । উভয় ভাষ্যই বাংলা ও হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হইয়াছে ।

বর্ণানুক্রমে টীকাকারগণ :-

অভিনব গুপ্ত ও নৃসিংহ ঠাকুরের ‘ভগবদ্‌গীতার্থ-সংগ্রহ’
আনন্দগিরি – ‘গীতা-ভাষ্য-বিবেচন’, ‘গীতাশয়’

কল্যাণভট্ট – ‘রসিক-রঞ্জিনী’
কেশবকাশ্মীরী‌ (নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের) – ‘গীতা-তত্ত্ব-প্রকাশিকা’
কৈবল্যানন্দ সরস্বতী – ‘ভগবদ্‌গীতা-সার’
কৃষ্ণ-ভট্ট বিদ্যাধিরাজ (মধ্বাচার্যের শিষ্য, চতুর্দশ শতাব্দী) – ‘গীতা টীকা’

গোকুলচন্দ্র – ‘ভগবদ্‌গীতার্থ-সার’
গৌরগোবিন্দ রায় (ব্রাহ্ম সমাজের) – ‘গীতা-প্রপূর্তি’

নরহরি – ‘ভগবদ্‌গীতা-সার-সংগ্রহ’
নীলকণ্ঠ (গোবিন্দ সূরির পুত্র) – ‘ভাবদীপিকা’

প্রত্যক্ষ দেবজটাচার্য – ”ভগবদ্‌গীতার্থ-সংগ্রহ-টীকা’

বলদেব বিদ্যাভূষণ – ‘গীতা-ভূষণ-ভাষ্য’
বল্লভাচার্য – ‘গীতার্থ-বিবরণ’; তৎপুত্র-কৃত ‘গীতাতাৎপর্য’
বাদিরাজ – ‘ভগবদ্‌গীতা-লক্ষাভরণ’
বিঠ্‌ঠল দীক্ষিত – ‘ভগবদ্‌গীতা-হেতু-নির্ণয়’
বিশ্বনাথ চক্রবর্তী – ‘সারার্থবর্ষিণী’

জগদ্ধর – ‘ভগবদ্‌গীতা-প্রদীপ’
জয়রাম – ‘গীতাসারার্থ-সংগ্রহ’

দত্তাত্রেয় – ‘প্রবোধ-চন্দ্রিকা’

মথুরানন্দ -‘ভগবদ্‌গীতাপ্রকাশ’
মধুসূদন সরস্বতী – ‘গূঢ়ার্থদীপিকা’ (শব্দের সরলার্থ সহ)
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী – গুজরাটীতে গান্ধীভাষ্য

রাঘবেন্দ্র স্বামী (সুধীন্দ্র যতির শিষ্য, সপ্তদশ শতাব্দী) – ‘গীতা-বিবৃতি’, ‘গীতা-সংগ্রহ’, ‘গীতার্থ-বিবরণ’
রাজানক (শৈবমতাবলম্বী) ও রামকণ্ঠ-কৃত ‘সর্বতোভদ্র’

শ্রীধরস্বামী – ‘সুবোধিনী’
শ্রীমৎ হনুমান্‌-কৃত গীতার ‘পৈশাচভাষ্য’
শ্রীপুরুষোত্তম – ‘অমৃত-তরঙ্গিণী’

সদানন্দ ব্যাস – ‘ভাব-প্রকাশ’
সূর্যপণ্ডিত -‘পরমার্থপ্রপা’

এতদ্ব্যতীত নিম্বার্ক, শঙ্করানন্দ, বিজ্ঞানভিক্ষু, কেশব ভট্ট, ব্রহ্মানন্দ গিরি, রামকৃষ্ণ, মুকুন্দদাস, রামনারায়ণ, অর্জুন মিশ্র, জনার্দন ভট্ট, দেববোধ, দেবস্বামী, নন্দকিশোর, নারায়ণ সর্বজ্ঞ, পরমানন্দ ভট্টাচার্য, যজ্ঞনারায়ণ, রত্নগর্ভ, লক্ষণ ভট্ট, শ্রীনিবাসাচার্য, বিমল বোধ, মধ্য মন্দির, বরদরাজ ব্যাসতীর্থ, সত্যাভিনব যতি, কৃষ্ণাচার্য, বিদ্যাধিরাজ, জয়রাম জয়তীর্থ, বৈশম্পায়ন, আজ্ঞেশ্বরপাল প্রমুখ অনেকেই গীতার উপর টীকাদি লিখিয়াছেন ।

6) গীতার ঐতিহাসিক সমালোচনা

6.1) গীতা মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত ?

আধুনিক পণ্ডিতগণ বাইবেলের ন্যায় গীতারও উচ্চতর বা ঐতিহাসিক সমালোচনা (higher or historical criticism) করিয়াছেন । জার্মান পণ্ডিত গার্বে সর্বপ্রথম গীতার ঐতিহাসিক সমালোচনা ও গবেষণা আরম্ভ করেন । ইনিই প্রথম জার্মান ভাষায় গীতার অনুবাদও প্রচার করিয়াছেন । উক্ত সমালোচনার স্থলে টালবয়েজ হুইলার, ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত প্রমুখ পণ্ডিতগণ বলেন যে, গীতা একখানি স্বতন্ত্র গ্রন্থ এবং মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত । গার্বের শিষ্য জার্মান সংস্কৃতজ্ঞ ডাঃ রুডল্‌ফ অটো গীতার উচ্চতর সমালোচনা করিয়া জার্মান ভাষায় যে বৃহৎ গ্রন্থ লিখিয়াছেন তাহার নাম ‘The Original Gita’; বইখানি ইংরেজী ভাষায়ও অনুদিত হইয়াছে । অটো সাহেবের মতে গীতায় কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধ-বিষয়ক আখ্যায়িকা-অংশটি মহাভারতের প্রকৃত অংশ । এই আখ্যায়িকা-অংশ ১২৮টি শ্লোকের অনধিক, কিন্তু তিনি বলেন – ভক্তি, যোগ, জ্ঞান, কর্ম প্রভৃতি-সম্বন্ধীয় গীতার উপদেশগুলির পৃথক পৃথক গ্রন্থ এবং শ্রীকৃষ্ণের বাণীরূপে প্রচলিত করিবার উদ্দেশ্যেই মহাভারতের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে । সুতরাং এইগুলি প্রক্ষিপ্ত ।

6.2) গীতা মহাভারতের প্রকৃত অংশ

কিন্তু বালগঙ্গাধর তিলক এবং ডাঃ সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণন এই বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন । তাঁহারা বলেন, সমগ্র গীতাই মহাভারতের প্রকৃত অংশ । কারণ, প্রথমতঃ গীতা ও মহাভারতের অন্যান্য অংশের মধ্যে ভাষার নিকট সাদৃশ্য আছে এবং দ্বিতীয়তঃ মহাভারতের অন্যান্য পর্বে গীতার উল্লেখ আছে । ভিষ্মপর্বের ২৫ হইতে ৪২ অধ্যায়ই ভগবদ্‌গীতা । কিন্তু শান্তি ও অশ্বমেধ পর্বে এবং অন্যান্য বহু স্থলে ব্যাসদেব ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণের মুখ-নিঃসৃত ভগবদ্‌গীতার সুস্পষ্ট উল্লেখ করিয়াছেন । ইহা হইতে নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হয় যে, গীতা মহাভারতের প্রকৃত অংশ, প্রক্ষিপ্ত নহে । অটো সাহেবের পক্ষে কোন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ এপর্যন্ত পাওয়া যায় নাই ।

7) গীতার শ্লোকসংখ্যা

গীতার শ্লোকসংখ্যা-সম্বন্ধে বিভিন্ন মত আছে । গীতার শ্লোকসংখ্যা সাত শত বলিয়াই এতকাল পাঠকসাধারণ অবগত আছেন ।শঙ্করাচার্য হইতে আরম্ভ করিয়া করিয়া অদ্যাবধি সকল ভাষ্যকার, টীকাকার ও ব্যাখ্যাকারই গীতার উক্ত শ্লোকসংখ্যা নির্বিবাদে গ্রহণ করিয়াছেন । কিন্তু বর্তমান যুগের আধুনিক গবেষণাসমূহের অভিনব আবিষ্কার এই যে, গীতার বর্তমান আকারটি অঙ্গহীন ও অসম্পূর্ণ এবং উহার শ্লোকসংখ্যা ৭৪৫, ৭০০ নহে । ব্যাসদেবের বাক্যই এই মতের প্রথম ও প্রধান সমর্থক :-

7.1) ব্যাসদেবের মত

শ্রীকৃষ্ণকথিত শ্লোক ৬২০ + অর্জুনকথিত শ্লোক ৫৭ + সঞ্জয়কথিত শ্লোক ৬৭ + ধৃতরাষ্ট্রকথিত শ্লোক ১ = ৭৪৫ শ্লোকসংযুক্ত ব্যাসদেব কথিত গীতা  [মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৪৩|৭]

षट्शतानि सविंशानि श्लोकानां प्राह केशवः । अर्जुनः सप्तपञ्चाशत्सप्तषष्टिं तु सञ्जयः ॥ धृतराष्ट्रः श्लोकमेकं गीताया मानमुच्यते । [Mahabharata, Bhisma Parva, 43|4]

ষট্শতানি সবিংশানি শ্লোকানাং প্রাহ কেশবঃ । অর্জুনঃ সপ্তপঞ্চাশৎসপ্তষষ্টিং তু সঞ্জয়ঃ ॥ ধৃতরাষ্ট্রঃ শ্লোকমেকং গীতায়া মানমুচ্যতে । [মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ৪৩|৪]

শ্রীকৃষ্ণকথিত শ্লোক ৫৭৫ + অর্জুনকথিত শ্লোক ৮৪ + সঞ্জয়কথিত শ্লোক ৪০ + ধৃতরাষ্ট্রকথিত শ্লোক ১ = ৭০০ শ্লোকসংযুক্ত প্রচলিত গীতা

7.2) শ্রীচৈতন্যদেবের মত

শ্রীচৈতন্যদেব তাঁহার প্রিয়শিষ্য গদাধরেরলিখিত গীতায় নিজহস্তে শ্লোকসংখ্যার মান লিখিবার সময় মহাভারতের উক্ত শ্লোকটি উদ্ধৃত করিয়াছিলেন । মহাপ্রভুর এই পুঁথি এখনও ভরতপুরে (মুর্শিদাবাদ) গদাধরের শ্রীপাটে রক্ষিত আছে এবং ইহা লইয়া আলোচনাও হইয়াছে ।

7.3) প্রাচীন হস্তলিখিত পুঁথি

কাথিয়াবাড়স্থ গণ্ডাল স্টেটের রাজবৈদ্যজীবরাম কালিদাস শাস্ত্রী সুরাট ও কাশী হইতে দুইটি প্রাচীন ভূর্জপত্রে হস্তলিখিত পুঁথি সংগ্রহ করিয়াছেন যাহা পুস্তকাকারে গণ্ডাল রসশালা ঔষধাশ্রম হইতে প্রকাশিত হইয়াছে । ১১৭৯ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত সুরাট থেকে সংগৃহীত গীতা অধিকাংশ স্থলে কাশ্মীরী গীতার অনুরূপ । ইহাতে প্রচলিত গীতা হইতে ২১টি নূতন ও অধিক শ্লোক এবং ২৫০টি পাঠান্তর পরিদৃষ্ট হয় । ১৬০৮ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত কাশী থেকে সংগৃহীত গীতায় ৭৪৫টি শ্লোক আছে । এই গীতাদ্বয়ের প্রকাশের পর দেশি, বিদেশি গীতাবিদ্‌গণের মধ্যে গীতার শ্লোকসংখ্যা-সম্বন্ধে গভীর জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হইয়াছে । ৭৪৫টি শ্লোকসংযুক্ত গীতা ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও প্রকাশিত হইয়াছে, যদিও পাঠকসাধারণের ইহা অবিদিত ।

7.4) কাশ্মীরী গীতা

শ্রীনগর হইতে অভিনবগুপ্তাচার্যের টীকা-সম্বলিত যে কাশ্মীরী গীতার সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে তাহাতে ৭৪৫টি শ্লোক আছে । পুণার আনন্দাশ্রম হইতে প্রকাশিত ও রাজনক রামকবি-কৃত গীতার ‘সর্বতোভদ্র’ নামক টীকা এবং পুণার ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল ইন্সটিটিউট হইতে প্রকাশিত গীতাও কাশ্মীরী গীতাকেই অনুসরণ করিয়াছে । কাশ্মীরী গীতা হস্তলখিত পুঁথির আকারে বহু শতাব্দী যাবৎ প্রচলিত ছিল; এমন কি, শঙ্করাচার্যের সময়েও ছিল ।

7.5) শঙ্করাচার্যের মত

কিন্তু দক্ষিণ ভারতে কাশ্মীরী গীতার প্রচার ছিল না বলিয়া সম্ভবতঃ উহা শঙ্করাচার্যের দৃষ্টিগোচর হয় নাই । সেই যুগে এখনকার মতো যাতায়াতের, মুদ্রাযন্ত্রের বা ডাকের কোন সুবিধা না থাকায় এক প্রদেশের হস্তলিখিত পুঁথি অন্য প্রদেশে তেমন যাতায়াত করিতে পারিত না । তাই শঙ্করাচার্য গীতার শ্লোকসংখ্যা সাত শত বলিয়াই গ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় । যাহার ফলে তাঁহার পরবর্তী ভাষ্যকার ও টীকারগণও এই শ্লোকসংখ্যার পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করিতে সাহসী হন নাই । কিন্তু তিনিও তাঁহার ভাষ্যে ১|১ শ্লোকের কোন উল্লেখ করেন নাই ও ১৩|১ শ্লোকও অব্যাখ্যাত রাখিয়াছেন । অর্থাৎ তিনিও উক্ত শ্লোকদ্বয় গ্রহণ করেন নাই ।

শঙ্করাচার্যের পূর্বেও ৭৪৫ শ্লোকযুক্ত গীতার উপর বহু টীকা ছিল । কিন্তু মধ্যযুগে ধর্মান্ধ মুসলমানদিগের হাতে সংস্কৃত সাহিত্যের যে দুর্গতি হইয়াছিল তাহার ফলে অধিকাংশ হস্তলখিত পুঁথি বিনষ্ট হইয়াছে ।

7.6) শুদ্ধ ধর্মমণ্ডল গীতা

মাদ্রাজের শুদ্ধ ধর্মমণ্ডল হইতে যে গীতা মুদ্রিত হইয়াছে তাহার শ্লোকসংখ্যাও ৭৪৫ । তবে উক্ত গীতাতে প্রচলিত গীতা হইতে ৩৭টি শ্লোক বাদ দিয়া মহাভারতের উদ্যোগ, অনুশাসন ও শান্তিপর্ব হইতে ৮২টি শ্লোক যথেচ্ছভাবে গ্রহণপূর্বক গীতার শ্লোকসংখ্যাও ৭৪৫ করা হইয়াছে । এতদ্ব্যতীত এই গীতায় ২৬টি অধ্যায় আছে । আদ্য ও অন্ত্য অধ্যায়ের বিশেষ নাম এবং অবশিষ্ট ২৪টি অধ্যায়ের প্রত্যেকটিতে ২৪টি শ্লোক আছে ।

7.7) আলবেরুনির মত

একাদশ শতকে বিখ্যাত মুসলমান ঐতিহাসিকআলবেরুনি তাঁহার আরবী গ্রন্থে গীতার শ্লোকসংখ্যা সাত শতের অধিক ধরিয়াছেন । তিনি নিজেও সংস্কৃতবিদ্‌ ছিলেন এবং তাঁহার গ্রন্থে যে সকল শ্লোক উদ্ধার করিয়াছিলেন তাহা প্রচলিত গীতায় নাই ।

7.8) ফারসী ও আরবী অনুবাদ

সম্রাট্‌ আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল এবং তাঁহার ভ্রাতা ফৈজী গীতার যে দুইটি ফারসী অনুবাদ করিয়াছিলেন তাহার একটিতে স্পষ্ট উল্লিখিত আছে – ‘সম্রাটের আদেশে গীতার ৭৪০ শ্লোকের ফারসী অনুবাদ সমাপ্ত হইল ।’ গীতার আবুল ফজল-কৃত ফারসী অনুবাদ লণ্ডনস্থিত ইণ্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে অদ্যাপি রক্ষিত আছে । ফৈজীকৃত ফারসী অনুবাদ লাহোর, এলাহাবাদ, জয়পুর ও জলন্ধর প্রভৃতি স্থান হইতে বহুবার মুদ্রিত হইয়াছে । শাহ আলি দাস্তগীর-কৃত গীতার ফারসী অনুবাদের হস্তলিখিত পুঁথি কাশী মহারাজার গ্রন্থাগারে আজও রক্ষিত আছে । মোগল সম্রাটগণের আমলে গীতার একটি আরবী তর্জমা হইয়াছিল । তদুনাযায়ীও গীতার শ্লোকসংখ্যা ৭৪৫ ।

8) গীতার বিবিধ ভারতীয় ব্যাখ্যা

প্রত্যেক ভাষ্যকার ও টীকাকার স্ব স্ব ধর্মমত অনুযায়ী গীতার ব্যাখ্যা করিয়াছেন । বৃত্তিকার বোধায়নের মতে জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয়ই গীতার প্রতিপাদ্য; পৃথগ্‌ভাবে কোনটাই মোক্ষদায়ক নহে ।

8.1) অদ্বৈতবাদ

শঙ্করাচার্য সমুচ্চয়বাদ খণ্ডনপূর্বক অদ্বৈতবেদান্তানুযায়ী গীতাভাষ্য লিখিয়াছেন । তিনি বলেন, ‘গীতার সিদ্ধান্ত এই যে, কেবলমাত্র তত্ত্বজ্ঞানেই মুক্তিলাভ হয়, জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয়ের ফলে নহে ।’ তাঁহার মতে ব্রহ্মাত্মৈক্যদর্শনরূপ জ্ঞান দ্বারা অজ্ঞান বিনাশপূর্বক নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি, ব্রাহ্মীস্থিতি বা ব্রহ্মনির্বাণলাভই গীতার উপদেশ । অজ্ঞানই দ্বৈতভাব-উৎপাদক । এই দ্বৈতভাব হইতেই সকল কর্ম হয় । দ্বৈতভাব-নাশান্তে নিষ্ক্রিয় আত্মায় প্রতিষ্ঠিত হইলেই সর্বকর্মসন্ন্যাস হয় । নিষ্কাম কর্মের দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হইলে মেঘমুক্ত সূর্যের ন্যায় আত্মজ্ঞান প্রকাশিত হয় । আত্মজ্ঞানলাভ হইলে নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি অর্থাৎ কর্মত্যাগ হয় । মধুসূদন সরস্বতী, আনন্দগিরি, শঙ্করানন্দ প্রভৃতি বহু টীকাকার শঙ্করের পদানুবর্তী ।

8.2) বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ

রামানুজাচার্য স্বীয় গুরু যামুনাচার্যের মতই তাঁহার গীতাভাষ্যে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছেন । তাঁহার মতে জীব (চিৎ), জগৎ (অচিৎ) ও ব্রহ্ম – এই তিনটি তত্ত্ব স্বতন্ত্র হইলেও ব্রহ্ম জগৎ ও জীববিশিষ্ট । তাঁহার মতে ব্রহ্মের সঙ্গে জীব ও জগতের স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদ না থাকিলেও স্বগতভেদ অবশ্য স্বীকার্য । তাঁহার দার্শনিক মত বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও তিনি ভক্তিধর্মের প্রচারক । তিনি বলেন, ‘বর্ণাশ্রমধর্ম অবশ্য পালনীয় ।’ কারণ সকল শাস্ত্র এই বিষয়ে একমত –‘একশাস্ত্রার্থতয়ানুষ্ঠেয়ম্‌’ । ফলাকাঙ্ক্ষা বিসর্জন করিয়া ঈশ্বরকে প্রসন্ন করিবার জন্য বর্ণাশ্রমধর্ম অনুষ্ঠিত হইলে ‘ভাবসংশুদ্ধি’ হয় এবং মানুষ জ্ঞানের অধিকারী হয় ।

8.3) দ্বৈতবাদ

দ্বৈতবাদী ও ভক্তিমার্গের আচার্য মধ্বাচার্যমায়াবাদ খণ্ডনপূর্বক পরব্রহ্মের সহিত জীবসমূহের নিত্য ভেদ প্রতিষ্ঠা করেন । বল্লভাচার্যের মতে ব্রহ্ম ও মুক্ত জীব মূলতঃ অভেদ হইলেও জীব ব্রহ্মের অংশ, মায়া ঈশ্বরের শক্তিমাত্র, জগৎপ্রপঞ্চ মিথ্যা নহে এবং ভগবৎকৃপাই তাঁহাকে লাভ করিবার একমাত্র পন্থা ।

8.4) দ্বৈতাদ্বৈতবাদ

দ্বৈতাদ্বৈতবাদী নিম্বার্কের মতে জীবসমূহ ও জগৎ সূক্ষরূপে ঈশ্বরের বিরাট শরীরে অবস্থিত ।

8.5) অন্যান্য ব্যাখ্যা

জ্ঞানেশ্বর পাতঞ্জল যোগকেই গীতার শিক্ষা বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন ।

অভিনবগুপ্তের মতে গীতা আধ্যাত্মিক অর্থে পরিপূর্ণ । তিনি বলেন, ধর্মক্ষেত্র শব্দের অর্থ নবদ্বারবিশিষ্ট দেহ, মামকাঃ শব্দের অর্থ প্রজ্ঞালব্দ চিন্তা; ধৃতরাষ্ট্র, কৌরবগণ ও পাণ্ডবগণ কাল্পনিক বস্তু, জড়দেহবান ব্যক্তি নহেন ।

মধুসূদন সরস্বতীর ‘গূঢ়ার্থদীপিকা’ নামক পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত গীতার টীকা পণ্ডিত ভূতনাথ সপ্ততীর্থ কর্তৃক বাংলায় অনূদিত হইয়াছে । তাঁহার মতে বেদের যেমন কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান – এই কাণ্ডত্রয় আছে, অষ্টাদশাধ্যায়ী গীতা তেমনি কাণ্ডত্রয়াত্মিকা । উহার ১ম ষট্‌কে জীবের স্বরূপ (ত্বং পদার্থ = জীবাত্মা), ২য় ষট্‌কে ব্রহ্মের স্বরূপ (তৎ পদার্থ = পরমাত্মা) ও ৩য় ষট্‌কে জীব(ত্বং) ও ব্রহ্মের(তৎ) অভেদতত্ত্ব (অসি = হও) প্রতিপন্ন হইয়াছে ।

তত্ত্বমসি = ত্বং + তৎ + অসি
(টীকাকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : মধুসূদন শঙ্করপন্থী অদ্বৈতবাদী ও চৈতন্যদেবের সমসাময়িক ছিলেন । ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়া গ্রামে তাঁহার জন্ম হয় । ইনি সন্ন্যাসগ্রহণপূর্বক কাশীধামস্থ গোপাল মঠে বাস করিতেন । ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’ নামক তাঁহার বেদান্তগ্রন্থ ভারত-বিখ্যাত ।)

ভাষ্যকার যামুনাচার্যের মতে গীতার প্রথম ছয় অধ্যায়ে ভক্তিলাভের উপায়স্বরূপ ভাগবত জ্ঞানের স্বরূপ নির্ণীত হইয়াছে; দ্বিতীয় ছয় অধ্যায়ে ভক্তি ও উপাসনা-সহায়ে লব্ধব্য ভাগবত স্বরূপ বর্ণিত এবং বাকি ছয় অধ্যায়ে পূর্বোক্ত বিষয়দ্বয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ।

রামানুজের গুরু যামুন তাঁহার গীতাগ্রন্থে বলেন যে, নারায়ণই পরব্রহ্ম; একমাত্র ভক্তি দ্বারাই সেই নারায়ণকে প্রাপ্ত হওয়া যায়; স্বধর্মানুষ্ঠান, সম্যক শাস্ত্রজ্ঞান এবং তীব্র বৈরাগ্য দ্বারা ঈশ্বরভক্তি লাভ হয় ।

নিগমান্ত মহাদেশিকের মতে নিষ্কাম কর্ম পরোক্ষভাবে জ্ঞানোৎপত্তি দ্বারা এবং সাক্ষাৎভাবে আত্মানুভূতি-প্রদানে সমর্থ ।

শ্রীঅরবিন্দ পুরুষোত্তমবাদী । তাঁহার গীতাব্যাখ্যার মূল রচনা প্রথমে ইংরেজীতে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় এবং পরে উহা বাংলা, হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হইয়াছে । গীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ে যে পুরুষোত্তমযোগ বর্ণিত, তিনি তাহাই অবলম্বনপূর্বক স্বীয় দর্শন ব্যাখ্যা করিয়াছেন । তাঁহার মতে এই জীব ও জগৎ ক্ষর পুরুষ, কূটস্থা প্রকৃতি অক্ষর পুরুষ এবং এই উভয় পুরুষের অতীত যে ঈশ্বর তিনি উত্তম পুরুষ বা পুরুষোত্তম । ‘পরমাত্মাই পুরুষোত্তমনামে শাস্ত্রে অভিহিত । সেই পরমাত্মা বিশ্বপ্রপঞ্চে প্রবিষ্ট ও পরিব্যাপ্ত ।’ -[গীতা ১৫|১৭]

বালগঙ্গাধর তিলক বলেন – ‘নিষ্কাম কর্মই গীতার ধর্ম; যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং পূর্ণ আত্মজ্ঞান সত্ত্বেও নিষ্কাম কর্ম অনুষ্ঠান ও প্রচার করিয়াছেন ।’

শ্রীধরস্বামী তাঁহার গীতার টীকায় জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি প্রচার করিলেও জ্ঞান অপেক্ষা ভক্তির প্রাধান্য স্বীকার করিয়াছেন । তাঁহার মতে জ্ঞান ও ভক্তি স্বরূপতঃ এক হইলেও ভক্তিই মুক্তিদাত্রী ।

শ্রীবিশ্বনাথ চক্রবর্তীর মতে গীতাশাস্ত্র সর্ববেদ-তাৎপর্য-পর্যবসিতার্থ রত্ন দ্বারা অলঙ্কৃত; ইহার অষ্টাদশ অধ্যায়ে অষ্টাদশ বিদ্যা-পরিপূরিত । গীতার প্রথম ছয় অধ্যায়ে নিষ্কাম কর্মযোগ, দ্বিতীয় ছয় অধ্যায়ে ভক্তিযোগ এবং শেষ ছয় অধ্যায়ে জ্ঞানযোগ প্রদর্শিত । ভক্তিযোগ অতিশয় গূঢ় এবং কর্ম ও জ্ঞানের মূল কারণস্বরূপ; অতএব অতিশয় শ্রেষ্ঠ ও সর্ব দুর্লভ বলিয়া মধ্যবর্তী ছয় অধ্যায়ে সন্নিবিষ্ট । ভক্তিরহিত কর্ম ও জ্ঞান উভয়ই বৃথা । এইজন্য সাধকগণ কর্ম ও জ্ঞান উভয়কেই ভক্তিমিশ্রিত করিয়া সাধন করিতে বিধি প্রদান করিয়াছেন ।
(টীকাকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : বিশ্বনাথ বৈষ্ণব ধর্মের আচার্য, চৈতন্যপন্থী এবং অচিন্ত্যভেদাভেদবাদী ছিলেন । তাঁহার মতে শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির ভেদ-অভেদও অচিন্ত্য । ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে উনি নদীয়া জেলার কোন ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেন । কোঙ্গলের শ্রীবর্ধন নামক স্থানে তৎপ্রতিষ্ঠিত মঠ অদ্যাপি বর্তমান । তিনি বহু সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন ।)

বলদেব বিদ্যাভূষণের মতে গীতোপনিষদে ঈশ্বর, জীব, প্রকৃতি, কাল ও কর্ম – এই পঞ্চ বিষয় বর্ণিত । তন্মধ্যে বিভুসংবিৎ ঈশ্বর, অণুসংবিৎ জীব, সত্ত্বাদিগুণত্রয়ের আশ্রয়রূপ দ্রব্য প্রকৃতি এবং ত্রিগুণশূন্য জড় দ্রব্য কাল । পুরুষত্বনিষ্পন্ন অদৃষ্টাদি শব্দবাচ্য কর্ম ইত্যাদি রূপে ঈশ্বরাদির লক্ষণ নিরূপিত হইয়াছে । তন্মধ্যে ঈশ্বরাদি চতুষ্টয় নিত্য বস্তু এবং জীবাদি চতুষ্টয় ঈশ্বর-বশীভূত । কর্ম প্রাগ্‌ভাবের ন্যায় অনাদি ও বিনাশী । সংবিৎস্বরূপ ঈশ্বর ও জীব উভয়েই সংবেত্তা (জ্ঞানাশ্রয়) ও অস্মদাদি-শব্দের প্রতিপাদ্য ।
(টীকাকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : ব্রহ্মসূত্রের গোবিন্দভাষ্যের রচয়িতা বলদেব বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর সুযোগ্য শিষ্য । ইনিও চৈতন্যপন্থী এবং অচিন্ত্যভেদাভেদবাদী ছিলেন ।)

8.6) ত্যাগই গীতার বাণী

আত্মজ্ঞানলাভের পর কর্মসন্ন্যাসের প্রকৃষ্ট প্রমাণ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অভূতপূর্ব জীবন । কর্মত্যাগ হইবার পর তিনি ‘গলিতহস্ত’ হইলেন, আর তর্পণাদি কর্ম করিতে পারিলেন না । পরাভক্তি লাভ হইবার পর তিনি আর বিধিপূর্বক জগন্মাতার পূজা ও উপবীত ধারণ করিতে সম্পূর্ণ অক্ষম হইলেন । শ্রীরামকৃষ্ণবলিতেন – “কয়েকবার ‘গীতা’ ‘গীতা’ উচ্চারণ করিলে যাহা হয় (অর্থাৎ ত্যাগী) তাহাই গীতার শিক্ষা ।” সকল কর্মের ফলাকাঙ্ক্ষা-ত্যাগই গীতার বাণী । ‘একমাত্র ত্যাগের দ্বারা অনেকে অমৃতত্ব লাভ করিয়াছিলেন’ – উপনিষদের এই মহতী বাণীই গীতায় বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যাত ।

জার্মান মনীষী গেটে বলিতেন, “তোমাকে সকল কর্ম এক সময় ত্যাগ করিতেই হইবে । এই সনাতন সঙ্গীত অনন্তকাল ধরিয়া আমাদের কর্ণে ধ্বনিত হইতেছে । সমগ্র জীবন প্রত্যেক ঘণ্টায় এই সঙ্গীত আমাদের কর্ণে প্রবেশ করিতেছে যদিও উহা আমরা শুনি না ।”

9) গীতার বৈদেশিক ব্যাখ্যা

গার্বে এবং হপ্‌কিন্‌স অনুমান করেন যে, অনেক লেখক বিভিন্ন শতাব্দীতে গীতায় স্ব স্ব রচনা সংযোজন করিয়াছেন । গার্বে বলেন, “গীতার মৌলিক আকারটি খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে সাংখ্যযোগের ভিত্তিতে রচিত, কিন্তু খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে পুনরায় উহা উপনিষদুক্ত অদ্বৈতবাদের গ্রন্থরূপে গৃহীত ও পরিবর্তিত হয় ।” গার্বে ‘Indian Antiquary’-তে (December 1918)  লিখিয়াছেন, ‘গীতায় সগুণ ও নির্গুণ উপাসনাকে সমান স্থান দেওয়া হইয়াছে । উভয় উপাসনার কোনটিকে উচ্চ বা নীচ বলা হয় নাই । স্থানে স্থানে উভয়ের প্রভেদও অস্বীকৃত হইয়াছে । দুইটি মতের এইরূপ অপূর্ব সমন্বয় বা সামঞ্জস্যই গীতার বৈশিষ্ট্য ।’ গার্বে আরও বলেন, “গীতোক্ত দার্শনিক তত্ত্বের সম্পূর্ণ ভিত্তি প্রায় সাংখ্যযোগের উপর প্রতিষ্ঠিত । সাংখ্যযোগই গীতায় প্রথম স্থান অধিকার করিয়াছে; দ্বিতীয় স্থান মাত্র বেদান্ত-কর্তৃক অধিকৃত । বেদান্ত শব্দটি ‘বেদান্তকৃৎ’-রূপে মাত্র একবার গীতায় উক্ত [১৫|১৫] । কিন্তু সাংখ্য ও যোগের প্রায়শঃই উল্লেখ দৃষ্ট হয় । আর উপর্যুক্ত বেদান্ত শব্দটিও উপনিষদের অর্থে ব্যবহৃত । প্রাচীন ও নবীন দর্শনের অসমঞ্জস সমাবেশ গীতাতে দেখা যায় । বেদান্তের ধারাটি গীতায় আধুনিক, মৌলিক নহে । দার্শনিক বা ধর্মীয় যে দৃষ্টিতেই গীতাকে বিচার করা যায়, উপর্যুক্ত সিদ্ধান্ত সমীচীন মনে হয় ।”

হপ্‌কিন্‌স বলেন, “পরবর্তী কালের কোন বিষ্ণু-উপাসনা-মূলক উপনিষদ্‌কে কৃষ্ণভাবোদ্দীপক গ্রন্থে পরিণত করিয়া গীতা উৎপন্ন হইয়াছে ।” হোল্‌জমানের মতে কোন বেদান্ত-গ্রন্থকে বিষ্ণুভক্তি-প্রচারের উদ্দেশ্যে পরিবর্তিত করিয়া গীতা সৃষ্ট হইয়াছে ।বেরিডেল কীথ বলেন, “শ্বেতাশ্বতরের ন্যায় গীতা পূর্বে একখানি উপনিষদ্‌ ছিল । পরে উহা কৃষ্ণোপাসনার গ্রন্থরূপে পরিবর্তিত ।” বার্নেটেরধারণা যে, গীতাকারের যত্নে বিভিন্ন ধর্মমত সুশৃঙ্খলভাবে সমঞ্জস হইয়াছিল । পল ডয়সনবলেন, “উপনিষদুক্ত অদ্বৈতবাদের অধঃপতনের যুগে গীতা এক বিকৃত সৃষ্টি । উক্ত যুগে আস্তিকতা ধীরে ধীরে নাস্তিকতায় পরিবর্তিত হইতেছিল ।” সেনেটের মতে স্বতঃসিদ্ধ বা স্বাভাবিক সমন্বয়সাধনই (spontaneous syncretism) গীতার মুখ্য উদ্দেশ্য । চার্লস জনস্টন বলেন, “ভগবদ্‌গীতা সেই বেদসরোবর, যাহার স্বচ্ছ ও শুদ্ধ সলিল ভারত-ভারতীর দারুণ সংঘর্ষের সঙ্গে যুগে যুগে ভারতেতিহাসরূপ অরণ্যের মধ্য দিয়া বেদরূপ হিমালয়ের অগম্য শৃঙ্গ হইতে প্রবাহিত ও সঞ্চিত ।”

10) গীতার প্রচার

ভারতে এবং ভারতেতর বহু দেশে গীতার খুব প্রচার হইয়াছে । বাংলা ভাষায় উহার অনেক অনুবাদ ও সংস্করণ হইয়াছে ও হইতেছে । এতদ্ব্যতীত মারাঠী, গুজরাটী, হিন্দী, উড়িয়া, আসামী, তেলেগু, তামিল, মালয়ালম্‌, কানাড়ী, মেবারী, মারোয়াড়ী, সিন্ধী, গুরুমুখী, উর্দু, খাসিয়া, ফারসী, গাড়োয়ালী, নেপালী প্রভৃতি ভারতের প্রায় সকল ভাষায় গীতার অসংখ্য অনুবাদ ও সংস্করণ হইয়াছে । গোরক্ষপুর গীতা প্রেস হইতে প্রকাশিত হিন্দী গীতার কয়েক লক্ষ খণ্ড বিক্রীত হইয়াছে ।

কলিকাতায় বাঁশতলা গলিস্থিত গীতা লাইব্রেরিতে এপর্যন্ত পৃথিবীর ছত্রিশটি ভাষায় গীতার যে পঁচিশ শতাধিক সংস্করণ হইয়াছে তাহার মধ্যে সাতাশটি ভাষায় প্রায় এগার শত সংস্করণের নমুনা-গীতা সংগৃহীত আছে । গীতা-প্রেমিকের এইগুলি অবশ্য দর্শনীয় ।

10.1) ইংরেজী অনুবাদ

রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী স্বরূপানন্দ, স্বামী পরমানন্দ, স্বামী প্রভবানন্দস্বামী নিখিলানন্দ-কৃত গীতার ইংরেজী অনুবাদ দেশে ও বিদেশে বিশেষ খ্যাতিলাভ করিয়াছে । কোন কোন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামী স্বরূপানন্দের গীতা পাঠ্যপুস্তকরূপে নির্বাচিত হইয়াছে । স্বামী প্রভবানন্দ ইংরেজ কবিক্রীস্টোফার ঈশারউডের সহযোগে গদ্যে ও পদ্যে গীতার ইংরেজী অনুবাদ করিয়াছেন । বিখ্যাত ইংরেজ মনীষী অলডাশ হাক্সলীইহাতে একটি মনোজ্ঞ ভূমিকায় লিখিয়াছেন, ‘জগতে যে সনাতন দর্শন আবিষ্কৃত হইয়াছে, উহার প্রাঞ্জলতম ও পূর্ণতম সংক্ষিপ্তসার গীতায় আছে । শুধু ভারতীয়গণের জন্য নহে, সমগ্র মানবজাতির জন্য উহার স্থায়ী মূল্য আছে । সনাতন দর্শনের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক বিবৃতি ভগবদ্‌গীতা দিয়াছেন ।’ মাদ্রাজ রামকৃষ্ণ মঠ হইতে উক্ত গীতার একটি ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে ।

স্যার চার্লস্‌ উইলকিন্স-কৃত গীতার ইংরেজী অনুবাদ ১৭৮৫ খ্রীঃ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক লণ্ডন হইতে প্রকাশিত হয় । ইহাতে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম গভর্ণর জেনারেলওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক লিখিত ভূমিকা আছে । ইহাই বিদেশীয় ভাষায় মূদ্রিত ও অনূদিত সর্বপ্রথম ভারতীয় গ্রন্থ ও গীতার প্রথম ইংরেজী অনুবাদ ।

এ্যানি বেসান্ত কর্তৃক অনূদিত ইংরেজী গীতার লক্ষাধিক কপি বিক্রীত হইয়াছে । এ ছাড়া স্যার এডুইন আরনল্‌ড-কৃত গীতার পদ্যানুবাদ; জন ডেভিস্‌, অধ্যাপক ফ্রাঙ্কলিন এডগার্টন, হোলডেন, এডোয়ার্ড সাম্ফশন, উইলিয়াম কিউ. জাজ, চার্লস্‌ জনস্টোন, রেভারেণ্ড আর. ডি. গ্রিফিথ, রাইডার এফ্‌. টী. ব্রুকস্‌, ই. ওয়াশবার্ণ হপ্‌কিন্স প্রভৃতি-কৃত গীতার ইংরেজি গদ্যানুবাদ বিশেষ প্রচলিত ।

10.2) অন্যান্য বিদেশী ভাষায় অনুবাদ

ফরাসী অনুবাদ : আন্না কামেস্কী, এমিল বার্ণফ, এ. এন্ডিউড শুল্‌ফ

জার্মান অনুবাদ : গদ্যে – রিচার্ড গার্বে, পল ডয়সন, লিওপল্‌ড ফন শ্রেডার; পদ্যে – ফ্রাঙ্ক হার্টম্যান ও থিওডর স্প্রিংম্যান

ল্যাটিন অনুবাদ : আগাস্টাস গিলেলমাস শ্লেগেল

ইটালিয়ান অনুবাদ : এন. ডি. ফ্লোরেন্স

সুইডিশ অনুবাদ : নিনো রুনেবার্গ, উইলিয়াম জাজ ও ফ্রাঞ্জ লেক্ষাউ

রাশিয়ান অনুবাদ : ম্যাঞ্জিয়ারলি ও কামেস্কী

ডাচ্‌ অনুবাদ : ল্যাবার্টন ও ডাঃ জে. ডবলিউ. বৈশেডাইন

স্পানিশ অনুবাদ : এ. ত্রিমিশভ ও জে. আর. বোরেল

বোহেমিয়ান অনুবাদ : ডাঃ এ. হটিম্যান

হাঙ্গেরিয়ান অনুবাদ : লেগ্রাডি ন্যম্‌দা কন্যুকিয়াডো

জাপানী অনুবাদ : অধ্যাপক জে. তাকাকুশু

তিব্বতী অনুবাদ : জনৈক লামা

10.3) বাংলায় অনুবাদ

রামদয়াল মজুমদার, দামোদর মুখোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রবিজয় বসু, রাজেন্দ্রনাথ ঘোষ, কৃষ্ণানন্দ স্বামী, অবিনাশ শর্ম ও জগদীশচন্দ্র ঘোষ-কৃত গীতার বাংলায় অনুবাদ প্রসিদ্ধ । পণ্ডিত প্রমথনাথ, পণ্ডিত ভূতনাথ সপ্ততীর্থ ও পণ্ডিত পার্বতীচরণ যথাক্রমে গীতার শাঙ্করভাষ্য, গূঢ়ার্থদীপিকা ও সুবোধিনী টীকার বঙ্গানুবাদ করিয়া অমর হইয়াছেন । বাংলায় গীতায় বহু পকেট-সংস্করণ আছে ।

10.4) গীতার অন্যান্য প্রচার

শ্রীশ্রীচণ্ডীর ন্যায় গীতারও অখণ্ড পাঠ হইয়া থাকে । কোথাও কোথাও গীতার নিত্য পাঠ হয় । সুর-তান-লয়-যোগে বহুস্থানে গীতা গীত হয় । ইহার পাঠে মহাশান্তি ও স্বস্ত্যয়ন হয় । বিশ্বষতঃ বিশ্বরূপদর্শন (১১শ) অধ্যায় (যাহা ব্রহ্ম অধ্যায়রূপে বর্ণিত) শুচি, অশুচি, সর্বাবস্থায় পাঠ করা যায় । লাহোর, করাচি প্রভৃতি শহরে ‘গীতা-হল্‌’ নির্মিত হইয়াছিল । মহারাষ্ট্রে গীতার জ্ঞানেশ্বরী ব্যাখ্যা শুনিবার জন্য সহস্র সহস্র নরনারীর সমাগম হয় । বরোদা ও আমেদাবাদে যে বিশাল ‘গীতা মন্দির’ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, তাহাতে গীতাদেবীর মূর্তি নিত্য পূজিত হয় । বাঙ্গালোরে জনৈকা স্ত্রীভক্ত গীতার সকল শ্লোক কাপড়ের উপর রেশমের সেলাই দ্বারা লিখিয়াছেন । উক্ত গ্রন্থখানি দেখিবার সৌভাগ্য আমাদের হইয়াছে । অনেক পণ্ডিত এখনও আছেন যাঁহাদের সমগ্র গীতা কণ্ঠস্থ । কোন কোন কলেজে গীতা পাঠ্যপুস্তকরূপে পঠিত হয় ।

11) গীতা ও উপনিষদাবলী

গীতা একটি উপনিষদ্‌ । প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে বেদ-ব্যাস গীতাকে উপনিষদ্‌ বলিয়াছেন । উপনিষদ্‌-তত্ত্বই গীতায় পত্রপুষ্পে শোভিত ও পরিবর্ধিত । উপনিষদ্‌রূপ গাভীসমূহের দুগ্ধই এই গীতামৃত [গীতার ধ্যান, ৪] । উপনিষদের নিগূঢ় নির্যাস শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের জন্য গীতামৃতরূপে পরিণত করিয়াছেন ।

উপনিষদ্‌সমূহের ন্যায় গীতাও কম্বুকণ্ঠে আত্মতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্ব ঘোষণা করিয়াছেন । ব্রহ্মতত্ত্বের এমন সুললিত ও সহজবোধ্য ব্যাখ্যা অন্য কোন গ্রন্থে দেখা যায় না । শঙ্করাচার্যসেইজন্য তাঁহার উপনিষদ্‌ ও গীতার ভাষ্যে একই তত্ত্ব প্রচার করিয়াছেন । অদ্বৈতনিষ্ঠ প্রস্থানত্রয়ের মধ্যে গীতা অন্যতম ।

11.1) উপনিষদ্‌ এবং গীতার শ্লোকে সাদৃশ্য

উপনিষদের কয়েকটি শ্লোক গীতায় কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে পাওয়া যায় । উদাহরণস্বরূপ নিম্নে কিছু সমানার্থক শ্লোক উদ্ধৃত করা হইল । আরও সাদৃশ্যযুক্ত শ্লোক উদ্ধৃত করা যাইতে পারে । অতএব গীতাপাঠ করিলেই উপনিষদ্‌পাঠ হয় । গীতা উপনিষদের শ্রেষ্ঠ ভাষ্য ।

কঠোপনিষদের ১|২|১৫ : গীতার ৮|১১
কঠোপনিষদের ২|৭,১৫,১৮-১৯ : গীতার ৮|১১, ২|২০, ২|১৯
ঈশোপনিষদের ৫ : গীতার ১৩|১৬ ও ৬|২৯
মুণ্ডক উপনিষদের ২|১|২ : গীতার ১৩|১৫

11.2) গীতা এবং ব্রহ্মতত্ত্ব

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অন্তে অর্জুন গীতার উপদেশ বিস্মৃত হওয়ায় পুনর্বার উহা প্রার্থনা করিলে ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছিলেন – “যে ব্রহ্মতত্ত্ব তোমাকে পূর্বে যোগযুক্ত হইয়া বলিয়াছিলাম, তাহা সম্পূর্ণরূপে পুনরায় বলা অসম্ভব ।”[মহাভারত, অশ্বমেধ পর্ব, ১৬শ অধ্যায়]

বেদতুল্য গীতার ভাগবত বাণী নিত্য ও অপৌরুষেয় । গীতা পঞ্চম বেদ । গীতাতত্ত্ব ও বেদবাণী অভেদ । সেইজন্য স্বামী বিবেকানন্দবলিয়াছেন যে, গীতা বেদের সর্বোত্তম ভাষ্য । গীতা ব্রহ্মযোগ-শাস্ত্র ও অদ্বৈতামৃতবর্ষিণী । ব্রহ্মবিদ্যাই গীতার প্রতিপাদ্য তত্ত্ব । গীতায় ব্রহ্মযোগ বিবৃত । ব্রাহ্মীস্থিতি বা ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করা, গুণাতীত যোগারূঢ় বা স্থিতপ্রজ্ঞ হওয়াই গীতার উপদেশ ।

11.3) যুদ্ধক্ষেত্রে গীতা কিরূপে উপদিষ্ট হইল ?

ইহা অসম্ভব নহে । ইতিহাসে দৃষ্টান্ত আছে । রোমান সম্রাট্‌ মার্কাস্‌ অরেলিয়াস যে যুদ্ধে যাইয়া নিহত হন, সেই যুদ্ধে যাইবার পূর্বে তিনি তিন দিবস স্বীয় রাজধানীর বিদ্বদ্‌বর্গকে প্রাসাদে আহ্বানপূর্বক দর্শনালোচনা করিয়াছিলেন ।

12) গীতা ও ভাগবত

গীতা ও ভাগবতে একই তত্ত্ব উপদিষ্ট । উভয় গ্রন্থে একই অবতারের উপদেশ প্রবিবৃত । গীতার বক্তা কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীমদ্‌ভাগবতে বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণের বাণী গ্রথিত । গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে এবং ভাগবতের একাদশ স্কন্ধে জ্ঞানযোগ বর্ণিত । গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ে এবং ভাগবতের দশম স্কন্ধে ভক্তিযোগ বিবৃত । উভয় গ্রন্থেই সমানভাবে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি ও যোগতত্ত্ব স্থান পাইয়াছে ।
“অব্যভিচারিণী ভক্তি দ্বারা ত্রিগুণাতীত হওয়া যায়” [গীতা ১৪|২৬]
“আত্মারাম মুনিগণ অহৈতকী ভক্তি লাভ করেন” [ভাগবত]

আবার গীতার ন্যায় ভাগবতেও আত্মতত্ত্ব উপদিষ্ট । ভাগবতের ১২শ স্কন্ধের শেষেশুকদেব রাজা পরীক্ষিৎকে আত্মজ্ঞানের উপদেশ দিতেছেন । ভাগবতের বেদস্তুতিতে আছে – “আত্মতত্ত্ব প্রকাশের জন্যই ভগবান্‌ মানবরূপে অবতীর্ণ হন ।” গীতার মতে যুগে যুগে অবতার আগমন করেন । ভাগবতেও উক্ত হইয়াছে ‘অবতার অসংখ্য’ ।

গীতায় শ্রীভগবান্‌ ভক্তকে সর্বধর্ম পরিত্যাগ পূর্বক তাঁহার শরণাগত হইবার জন্য উপদেশ দিয়াছেন [১৮|৬৬] । তদ্রূপ শ্রীমদ্‌ভাগবতেও আছে “সর্বপ্রযত্নে সকল প্রাণীর আত্মস্বরূপ আমার শরণাগত হও । তাহা হইলে আমার দ্বারা অকুতোভয় (সর্বত্র নির্ভয়) হইবে [১১|১২|১৫] ।” শরণাগতি দ্বারাই ভক্ত অভয় লাভ করেন । শ্রীশ্রীচণ্ডীর অন্তে মেধা ঋষিও রাজা সুরথকেভবভয়নাশের জন্য পরমেশ্বরী ভগবতীর শরণাগত হইতে বলিতেছেন ।

13) গীতার উদারতা

গীতা সার্বজনীন ধর্মগ্রন্থ । গীতা সকল ধর্মের, সকল সম্প্রদায়ের, সকল শ্রেণীর ধর্মগ্রন্থ হইবার যোগ্য । গীতাশাস্ত্রে কোন ‘গোড়ামি’ বা সংকীর্ণতা স্থান পায় নাই ।

“যে যেভাবে আমায় আরাধনা করে, আমি সেই ভাবে তাহাকে কৃপা করি । সকল ধর্মপিপাসু মৎপথেই বিচরণ করিতেছে ।” [৪|১১]

“যাহারা ঈশ্বরের যে কোন রূপ শ্রদ্ধাপূর্বক অর্চনা করিতে ইচ্ছা করে, আমি তাহাদিগকে সেই মূর্তিতে ভক্তি ও বিশ্বাস প্রদান করি ।” [৭|২১]

“যাহারা শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া অন্য দেবতা উপাসনা করে, তাহারাও অবিধিপূর্বক আমারই উপাসনা করে ।” [৯|২৩]

এইরূপ সার্বজনীনতা ও উদারতা অন্য ধর্মগ্রন্থে দুষ্প্রাপ্য । ভগবানের অসংখ্য নাম ও অসংখ্য রূপ । তাঁহার যে কোন একটি নামে ও রূপে আমাদের নিষ্ঠা হইলেই মুক্তি করতলগত হইবে । নিষ্ঠাপূর্বক তাঁহার একটি নাম জপ ও একটি রূপ ধ্যান করিলেই মোক্ষলাভ হয় । অপরের ইষ্টকে শ্রদ্ধা করা ইষ্টনিষ্ঠার একটি প্রধান সাধন । অপরের ইষ্টকে অশ্রদ্ধা করা অনুচিত । কর্মযোগ, ভক্তিযোগ, রাজযোগ ও জ্ঞানযোগ প্রত্যেকটি অন্যনিরপেক্ষ স্বতন্ত্র মুক্তি-মার্গ, এই ভাবটি গীতার কয়েকটি শ্লোকে পরিস্ফুট হইয়াছে । স্বামী বিবেকানন্দ গীতার উক্ত বৈশিষ্ট্য মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন । রুচির বৈচিত্রহেতু ঋজু, কুটিল যে পথে মানুষ চলুক না কেন, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা থাকিলে সাধকের ঈশ্বরলাভ হইবেই । ভগবান্‌ শ্রীরামকৃষ্ণ তাই বলিতেন, “যত মত তত পথ” । এক-একটি ধর্মমত যে ঈশ্বরলাভের ভিন্ন ভিন্ন পথ, তাহা তিনি তাঁহার অভূতপূর্ব ও অলৌকিক জীবনে সাধন করিয়া দেখাইয়াছেন ।

14) গীতায় আত্মার অমরত্ব

কুরুক্ষেত্রে অর্জুন আত্মীয়বর্গকে যুদ্ধার্থে উপস্থিত দেখিয়া দুঃখিত হইলেন । তিনি স্বজনগণকে বিনাশপূর্বক রাজ্যলাভের ইচ্ছা ত্যাগ করিলেন । তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের মৃত্যুভয় দূর করিবার জন্য তাঁহাকে আত্মার অমরত্ব শিক্ষা দিলেন । শ্রীভগবান্‌ বলিলেন – “এই নরপতিগণ ও আমরা পূর্বে ছিলাম না, বা পরে থাকিব না – ইহা সত্য নহে ।” অর্থাৎ আমরা ও ইহারা আত্মারূপে জন্মের পূর্বেও ছিলাম এবং মৃত্যুর পরেও থাকিব । আত্মার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই; আত্মা অমর । মানুষ দেহমাত্র নহে । মানুষ আত্মাই । দেহের জন্ম বা মৃত্যু হয় । মৃত্যু আত্মাকে স্পর্শ করিতে পারে না । মৃত্যুতে স্থূল দেহের ধ্বংশ হয় মাত্র । “বস্ত্র জীর্ণ হইলে যেমন উহা পরিত্যাগ করিয়া আমরা নূতন বস্ত্র পরিধান করি, তেমনি আত্মা ভগ্ন ও জীর্ণ দেহ ত্যাগ করিয়া নূতন দেহ গ্রহণ করে [২|২২] ।” মৃত্যুর পরে পুনর্জন্ম হয়; পুনর্জন্ম দেহান্তরপ্রাপ্তি মাত্র । কৌমার, যৌবন ও জরার ন্যায় মৃত্যুও দেহের একটি অবস্থামাত্র । “আত্মাকে মৃত্যু বিনাশ করিতে পারে না, অস্ত্র ছেদন করিতে পারে না, অগ্নি দগ্ধ করিতে পারে না, জল সিক্ত করিতে পারে না এবং বায়ু শুষ্ক করিতে পারে না [২|২৩] ।” ইহাই গীতার প্রথম ও প্রধান শিক্ষা ।

আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করিলে অর্জুনের ন্যায় আমাদেরও মৃত্যুভয় বিদুরিত হইবে, শোক অন্তর্হিত হইবে । শ্রীমদ্‌ভাগবতের ১২শ স্কন্ধেশুকদেব রাজা পরীক্ষিৎকে মৃত্যুভয় দূর করিবার জন্য আত্মজ্ঞানের উপদেশ দিবার উদ্দেশ্যে বলিতেছেন, “আত্মা দেহ হইতে পৃথক্‌ । তুমি অমর আত্মা – এই জ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুভীতি যাইবে না ।”

গ্রীসের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী সক্রেটিস আত্মজ্ঞান লাভ করিয়া মৃত্যুঞ্জয় হইয়াছিলেন । মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হইয়া শেষ জীবনে তিনি যখন কারাগারে আবদ্ধ ছিলেন, তখন তাঁহার জনৈক শিষ্য তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “মৃত্যুর পর আপনার দেহ কিভাবে সৎকার করিব ?” সক্রেটিস তদুত্তরে বলিয়াছিলেন, “আমার দেহের সৎকার যেভাবে ইচ্ছা করিও, তবে ইহা নিশ্চিত জানিও যে, এই দেহ সক্রেটিস নহে ।”

জন্মের পূর্বে যে আমরা ছিলাম এবং মৃত্যুর পরেও থাকিব, বিনষ্ট হইব না – এই ধারণা আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের হৃদয়ে বিদ্যমান । মন একটু অন্তর্মুখীন ও একাগ্র হইলেই উক্ত সত্য প্রতিভাত হয় । ইংলণ্ডের প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বার্ট্রাণ্ড রাসেল(Bertrand Russel) তাঁহার নবম বা দশমবর্ষীয় পুত্রকে খ্রীষ্টান ধর্মের একটি তত্ত্ব শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যে বলিলেন, “মিশরের পিরামিড যখন নির্মিত হয়, তখন তোমার অস্তিত্ব ছিল না । জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তোমার অস্তিত্ব আসিয়াছে ।” (খ্রীষ্টানগণ জন্মান্তরে বিশ্বাসী নহেন ।) পুত্র পিতাকে জিজ্ঞাসা করিল, “সে (পুত্র) তখন কি করিতেছিল ?” পিতা তাহাকে বারবার বলা সত্ত্বেও বালক কিছুতেই তাহার জন্মের পূর্বের অনস্তিত্ব বিশ্বাস করিতে পারিল না । মানুষ দেহাতিরিক্ত আত্মা, সুতরাং কিরূপে এইরূপ বিশ্বাস করা সম্ভব ?

দেহবুদ্ধির প্রাবল্যহেতু আত্মবুদ্ধি সম্প্রতি অন্তর্হিত হইয়াছে । আত্মবুদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গেই ক্ষুধাতৃষ্ণা, জন্মমৃত্যু, জরাব্যাধি প্রভৃতি জড়ধর্মের অধীনতা দূর হয়; সকল দুর্বলতা, দূঃখ ও দৈন্য পলায়ন করে; মানব মৃত্যুঞ্জয় ও মহাবীর হয় ।

15) গীতায় অবতারবাদ

শ্রীমদ্‌ভাগবতের ন্যায় শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাও অবতারবাদ প্রচার করেন । সম্ভবতঃ সর্বপ্রথম গীতাতেই অবতার-তত্ত্ব সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাত ।  গীতায় [৪|৭-৯] ভগবান্‌ স্বয়ং বলিয়াছেন –

“যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের উত্থান হয় তখনই আমি অবতীর্ণ হই । সাধুরক্ষা, দুষ্টবিনাশ ও ধর্মস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে নরদেহ ধারণ করি ।”

অবতারে বিশ্বাস হইলে মুক্তিলাভ হয়, আর পুনর্জন্ম হয় না । শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাই বলিতেন, “অবতারে বিশ্বাস পূর্ণ জ্ঞানের লক্ষণ ।” মূঢ়গণই মনুষ্যতনুধারী ভগবানে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারে না । অবতারবাদেই ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব নিহিত ।

অবতার মায়ামনুষ্য । তিনি মায়াধীশ; জীবের ন্যায় মায়াধীন নহেন । তিনি যেন দেহবান্‌ হন, যেন জাত হন । অবতার নরদেহধারী ভগবান্‌ । দেহধারণকালে তিনি তাঁহার ভাগবতস্বরূপ বিস্মৃত হন না । অবতার দেব-মানব, ‘নির্গুণ গুণময়’, ‘নিরঞ্জন নররূপধর’ ।

দেবত্ব ও মানবত্বের অপূর্ব মিলন অবতারে দৃষ্ট হয় । ভক্তিতে মানবের অন্তর্নিহিত দেবত্ব প্রস্ফুটিত হয় । ঈশ্বর ও মানবের মিলনভূমি এই অবতার । অবতারকে দর্শন করিলেই ঈশ্বরদর্শন করা হয় । অবতারগণের জন্ম অলৌকিক; কারণ তাঁহারা জীবের ন্যায় কর্মাধীন নহেন । ঈশ্বরের নরলীলাই সর্বোত্তম । অবতারের লীলাস্মরণ, তাঁহার নামজপ ও তাঁহার মূর্তিধ্যানই ধর্মজীবনের প্রধান সাধন । এইজন্য ভগবান্‌ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখাইলেন ।

নিরাকার, নির্গুণ ব্রহ্ম কিরূপে সাকার ও সগুণ হন, কিরূপে রক্তমাংসের শরীরে আবির্ভূত হন – এই গভীর রহস্য দুর্ভেদ্য । অবতারকে আশ্রয় করিলে ধর্মসাধন সহজ হইয়া যায় । বিশ্বরূপ দর্শনান্তে শ্রীকৃষ্ণে অর্জুনের ভগবদ্বুদ্ধি আসা মাত্র অর্জুনের মোহরাত্রি অতীত হইল । যীশুখ্রীষ্টের অবতারত্বে বিশ্বাস আসিতেই সল পলে পরিণত হইলেন । মানবের দেবত্ব এবং ভগবানের মানবত্ব প্রকটিত হয় অবতারবাদে । অবতারকে চিন্তা করিলেই ঈশ্বরকে চিন্তা করা হয় । বেদে অবতারবাদ ব্যক্ত হয় নাই । পরবর্তী যুগে ভক্তিধর্মের উৎপত্তির সঙ্গে অবতারবাদ উৎপন্ন হয় । পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মে উক্ত মত কোন-না-কোন প্রকারে বিকশিত হইয়াছে ।

16) গীতোক্ত কর্মযোগ

নিষ্কাম কর্মযোগই গীতার শ্রেষ্ঠ বাণী । বর্ণধর্ম ও আশ্রমধর্ম অনাসক্তভাবে পালন করিলে ভগবদ্দর্শন হয় । অনাসক্ত হইয়া কর্তব্য কর্ম করিলে ক্রমে ক্রমে চিত্তশুদ্ধি ও পরে জ্ঞান লাভ হয় ।

মহাভারতে [১২|১৮|৩১] অর্জুন বলিতেছেন – “যে অনাসক্ত বন্ধনহীন পুরুষ শত্রু-মিত্রে সমদর্শী এবং সক্তবৎ ব্যবহারশীল হন, তিনি মুক্ত । হে মহীপতে ইহাই গীতোক্ত মুক্তির আদর্শ ।”

যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতিতে [৩|২০৪-০৫] সন্ন্যাসীর অবস্থা বর্ণনান্তে কথিত আছে, ‘সত্যশীল, জ্ঞাননিষ্ঠ গৃহী সন্ন্যাসগ্রহণ না করিয়াও মুক্তিলাভ করেন ।’

গান্ধীজীর মতে গীতায় অনাসক্তিযোগ কথিত । অনাসক্তি যতই মনে দৃঢ়মূল হইবে, ততই চিত্ত শুদ্ধ হইবে, ততই আধ্যাত্মিক তত্ত্বের আস্বাদ পাওয়া যাইবে ।

গীতা কর্ম ত্যাগ করিতে উপদেশ দেন নাই; কর্মে অনাসক্তি, কর্মফলত্যাগই গীতার মহীয়সী বাণী । জগতের অন্য কোন ধর্মগ্রন্থ এত মুক্তকণ্ঠে এই অদ্ভুত তত্ত্ব প্রচার করেন নাই । সচন্দন পুষ্প ভগবানের চরণে অর্পণ করিলে যেমন পূজা হয়, তেমনি স্ব স্ব কর্ম ঈশ্বরে সমর্পণ করিলেও তাঁহার উপাসনা হয় । নিষ্কাম কর্মও এক প্রকার ঈশ্বরারাধনা ।

স্বামী বিবেকানন্দ বলিতেন, “বুদ্ধদেব ধ্যানের দ্বারা ও যীশুখ্রীষ্ট প্রার্থনার দ্বারা যে আধ্যাত্মিক অবস্থা ও দিব্যভাব লাভ করিয়াছিলেন, অনাসক্ত কর্মী নিষ্কাম কর্মের দ্বারাও সেই উচ্চাবস্থা লাভ করিবেন ।” তাই স্বামীজী কর্মসঙ্কুল বর্তমান যুগে নারায়ণজ্ঞানে জীবসেবা ধর্মের প্রধান অঙ্গরূপে প্রবর্তন করিলেন ।

চৈনিক ঋষি লাউৎজে (Laozi also Lao-Tzu or Lao-Tze) প্রাচীন চীনে wa wei wei বা নিষ্কাম কর্মযোগ শিক্ষা দিয়াছেন । লাউৎজে তাঁহার ‘তাও তে-কিং’ (Tao Te Ching) নামক জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থে বলেন – “অনাসক্ত মানবই জগতে পূর্ণ স্বাধীনতা ও শান্তি উপভোগ করিতে সমর্থ । তিনি জগতে বাস করিয়াও জগদতীত হন ।”

প্রসিদ্ধ ইংরেজ মনীষী অলডাশ্‌ হাক্সলী (Aldous Huxley) তাঁহার “Ends and Means” নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন যুগে প্রচলিত আদর্শ মানবের বহু সংজ্ঞা সমালোচনাপূর্বক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে, গীতোক্ত অনাসক্ত মানবই আদর্শ পুরুষ । যিনি যত অনাসক্ত তিনি তত উন্নত ।

ফরাসী দেশের ভূতপূর্ব প্রধান মন্ত্রী ক্লেম্যান্সো(Georges Benjamin Clemenceau) বলিয়াছেন – গীতোক্ত কর্ম-কৌশল যদি জানিতাম তাহা হইলে আমার কর্ম-জীবন ধর্ম-জীবনে পরিণত হইত । খ্রীষ্টান সাধক ব্রাদার লরেন্সনিষ্কামভাবে পাচকের কর্ম করিয়াই সর্বত্র ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করিয়াছিলেন ।

ব্যাধগীতাতে আছে যে, ব্যাধ মাংসবিক্রয়রূপ স্বীয় বর্ণধর্ম অনাসক্তভাবে পালন করিয়াই আত্মজ্ঞান-লাভ করিয়াছিলেন । মহাভারতে দেখা যায়, অনাসক্তচিত্তে পতিসেবা দ্বারাই সতীসাধ্বী স্ত্রীর জ্ঞান-চক্ষু উন্মীলিত হইয়াছিল । অনাসক্তভাবে স্বধর্মপালনই শ্রেষ্ঠ সাধনা । সকল সময়ে সকল অবস্থায় অনাসক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হইলে মানুষ পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় ।

17) বৌদ্ধধর্ম ও গীতা

ডাঃ রাধাকৃষ্ণনের মতে “গীতার প্রভাব পুরাকালে চীন ও জাপান পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল । মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রধান গ্রন্থদ্বয় ‘মহাযানশ্রদ্ধোৎপত্তি’ এবং ‘সদ্ধর্মপুণ্ডরীক’ গীতাতত্ত্বের নিকট গভীরভাবে ঋণী ।” হিন্দুধর্মে গীতা যে স্থান অধিকার করিয়াছে, বৌদ্ধধর্মে ধম্মপদও সেই স্থান পাইয়াছে । ধম্মপদ ও গীতার মধ্যে ভাবসাদৃশ পরিলক্ষিত হয় ।

17.1) যোগক্ষেম শব্দের ব্যবহার

যে ভক্ত অনন্যচিত্ত হইয়া নিরন্তর ঈশ্বরের উপাসনা করেন, ঈশ্বর স্বয়ং তাঁহার যোগক্ষেমবহন করেন [গীতা ৯|২২] ।

সেই সকল সতত চেষ্টাশীল এবং নিত্য দৃঢ়পরাক্রম ধ্যানিগণ পরম শান্তি (যোগক্‌খেমং)-রূপ নির্বাণ লাভ করেন [ধম্মপদ, অপ্পমাদো বগ্‌গো, ৩] ।

মন্দবুদ্ধিগণ শ্রেয় (যোগক্ষেমাদ্‌) অপেক্ষা প্রেয়কে বরণ করেন [কঠোপনিষদ, ১|২|২] ।

ব্রহ্মই যোগক্ষেমরূপে প্রাণাপানে অবস্থিত[তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ৩|১০|২] ।

যোগক্ষেম শব্দটি গভীর অর্থপূর্ণ । যোগ অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তি এবং ক্ষেম প্রাপ্ত বস্তুর সংরক্ষণ ।শঙ্করমতে যোগক্ষেম আহারাদি সকল প্রয়োজনীয় বস্তু । শ্রীধর শব্দটি ‘মুক্তি’ অর্থে ব্যাখ্যা করিয়াছেন । ধম্মপদ-মতে যোগক্‌খেমং=যোগক্ষেম=মুক্তি । শ্রীধর ও ধম্মপদ এক অর্থেই যোগক্ষেম শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন । শব্দটি অতি প্রাচীন, সম্ভবতঃ উপনিষৎ ও গীতা হইতে উহা ধম্মপদে গৃহীত ।

18) গীতায় যোগচতুষ্টয়ের সমন্বয়

গীতায় যে ধর্ম-সমন্বয় ধ্বনিত হইয়াছে, তাহা ধর্মেতিহাসে অপূর্ব । (নিষ্কাম) কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও রাজযোগ – এই চারটি অন্যনিরপেক্ষ মোক্ষমার্গের এরূপ অপূর্ব সমন্বয় অন্য শাস্ত্রে নাই । শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী – “যত মত তত পথ” গীতাতেই ব্যাখ্যাত । পূজ্যপাদস্বামী জগদানন্দজী যখন আমার গীতাখানি সংশোধন করিতেছিলেন তখন তিনি গীতার এই সমন্বয়-সূত্রটি আমাকে ধরাইয়া দেন ।

18.1) নিষ্কাম কর্মযোগ দ্বারা মুক্তি

শ্রীভগবান অর্জুনকে বলিতেছেন [৩|১৯] – সেই হেতু সদা অনাসক্ত হইয়া কর্তব্য কর্ম অনুষ্ঠান কর । মানুষ অনাসক্ত হইয়া কর্ম করিলে পরম পদ প্রাপ্ত হয় ।

18.2) জ্ঞানযোগ দ্বারা মুক্তি

শ্রীভগবান বলিতেছেন [১২|৩-৪] – যাঁহারা ইন্দ্রিয়সমূহ সংযত করিয়া এবং সর্বত্র সমবুদ্ধি ও সদা সর্বভূতের হিতে রত হইয়া অক্ষর, অনির্দেশ্য, অব্যক্ত, সর্বব্যাপী, অচিন্ত্য, কূটস্থ, অচল, নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাঁহারা আমাকেই প্রাপ্ত হন ।

18.3) ভক্তিযোগ দ্বারা মুক্তি

শ্রীভগবান বলিতেছেন [১১|৫৪] – কেবলমাত্র অনন্যা ভক্তি দ্বারাই আমাকে স্বরূপতঃ জানিতে, প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ করিতে এবং আমাতে বিলয়রূপ মোক্ষলাভ করিতে ভক্তগণ সমর্থ হয় ।

18.4) রাজযোগ দ্বারা মুক্তি

শ্রীভগবান বলিতেছেন [৫|২৭,২৮] – বাহ্য বিষয় মন হইতে বাহির করিয়া দৃষ্টি ভ্রূযুগলের মধ্যে স্থির করিয়া নাসিকার মধ্যে বিচরণশীল প্রাণ ও অপান বায়ুর ঊর্ধ্ব ও অধোগতি রোধ করিয়া এবং ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি সংযমপূর্বক ইচ্ছা, ভয় ও ক্রোধশূন্য হইয়া যে মুনি সর্বদা বিরাজ করেন তিনি জীবন্মুক্ত ।

19) গীতাকবচ

শ্রীশ্রীচণ্ডীর যেমন কবচ আছে, গীতারও তদ্রূপ কবচ আছে । যেমন দেবীকবচ পাঠান্তে চণ্ডীপাঠ বিহিত, সেইরূপ গীতাকবচ পাঠান্তে গীতাপাঠ করিতে হয় । বার্ণেল সাহেবের ক্যাটালগ [১১৪৬নং, ১৮৬ পৃঃ] অনুসারে তাঞ্জোরের মহারাজা সরফৌজির সরস্বতীমহল গ্রন্থাগারে তেলেগু অক্ষরে লিখিত পুঁথিতে একটি গীতাকবচ আছে [‘শ্রীভারতী’ পত্রিকায় – ২য় বর্ষ, ৭ম সংখ্যা – শ্রীজিতেন্দ্রনাথ বসু কর্তৃক প্রকাশিত] ।

যাহা ধারণ করিলে শত্রু-নিক্ষিপ্ত অস্ত্রশস্ত্রাদি হইতে আত্মরক্ষা করা যায়, তাহাকে কবচ বলে । যিনি গীতাতত্ত্বে প্রবেশ করিতে অগ্রসর হন, তাঁহার বাহ্য ও আভ্যন্তর নানা প্রবল শত্রু থাকে । ইহাদের আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য গীতাকবচ অবশ্য ধারণীয় । গীতাকবচে ষড়ঙ্গ রক্ষা করিবার বিধি ও কৌশল বিশেষভাবে উল্লিখিত আছে । উক্ত কবচের বৈশিষ্ট এই যে, ইহাতে গীতার ছয়টি মূল শ্লোক উল্লিখিত । বিশদ

20) গীতামাহাত্ম্য

সাধারণতঃ দুইটি গীতামাহাত্ম্য দেখা যায় । তন্মধ্যে যেটি বৃহত্তর সেটি বৈষ্ণবীয় তন্ত্রসারেউক্ত । ইহাতে ৮৪টি শ্লোক আছে । স্বামী কৃষ্ণানন্দ কর্তৃক সম্পাদিত গীতায় উক্ত মাহাত্ম্য সানুবাদ প্রদত্ত । আর যেটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র এবং ২৩টি শ্লোকে সমাপ্ত, সেটি অনুবাদ সহিত এই গীতায় দেওয়া হইয়াছে । উক্ত মাহাত্ম্যটি কাহারো কাহারো মতে বরাহপুরাণোক্তবোম্বাই নির্ণয়সাগর প্রেস হইতে প্রকাশিত এবং বহুটিকাসমন্বিত গীতার মত এইরূপ । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, উক্ত প্রেস হইতে প্রকাশিত বরাহপুরাণে এই গীতামাহাত্ম্য নাই ।মহাভারতে এবং স্কন্দপুরাণে দুইটি গীতামাহাত্ম্য পাওয়া যায় । কিন্তু সেগুলি প্রচলিত নহে । হরি ওঁ । বিশদ


ঋণ স্বীকার https://sanatandharmatattva.wordpress.com





14 comments:

  1. ইন্দ্রবাবু, আপনার লেখা পড়তে পড়তে এতটাই মগ্ন হয়ে গেলাম যে বইটি ডাউনলোড করতেই ভুলে গেলাম... তবে আপনার লেখাটি উপলব্ধি করতে হলে আরো কয়েকবার পড়া প্রয়োজন... ইতিমধ্যে বইটি পড়ে নিই

    ReplyDelete
  2. Onek information dile Indra da. Thanks.

    ReplyDelete
  3. আপনার লেখার প্রথম ১১টি প্যারা ভাইরাল করে দিতে ইচ্ছে করছে । কিন্তু জানি চেষ্টা করলেও পারব না, বহুল শেয়ারিং হবে না । কেননা, আমরা আজকাল জাতীয়তাবাদের অমৃত পান করি না, জাতীয়তাবাদের চোলাই পান করে নেশা করি ।

    ReplyDelete
  4. অমূল্য শিক্ষা।

    ReplyDelete
  5. ব্লগের লেখাটা কপি করে ফেসবুক বা হোয়াটস্যাপে দিতে পারি আপনার নামসহ?

    ReplyDelete
    Replies
    1. দিন কোন অসুবিধা নেই।

      Delete
  6. "জল যেমন পদ্মপত্রকে সিক্ত করিতে পারে না, তদ্রূপ যিনি গীতার ধ্যান করেন, মহাপাপ ও অতিপাপসমূহ কখনও তাঁহাকে স্পর্শ করে না।" ... এর ব্যাখ্যা কি? চলতি মত অর্থাৎ যে গীতা পড়েনি তার মত ... "যে গীতা পড়বে, মহাপাপ করলেও তার পাপ হবে না।" আর যে গীতা সম্যক ভাবে পড়েছে তার মত ...... "যে গীতা পড়বে সে মহাপাপ করতেই পারবে না।" একই কথার নানা ব্যাখ্যা হতে পারে। আমরা কোনটা নেব তা শেখাবে গীতা পাঠ।।
    সপ্তদশ অধ্যায়ের গীতার তত্ব আর অষ্টাদশতম অধ্যায়ের তত্ব এতোটাই পরস্পরবিরোধী যে একই গ্রন্থের অংশ বলে মানতে কষ্ট হয়। গীতমাহাত্ম পড়লে সেমিটিক ধর্মের লেখা পড়ছি বলে মনে হয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. দারুণ ব্যাখ্যা করেছেন। ধন্যবাদ ।

      Delete