Sunday, July 26, 2020

Post # 978 Bengali Amarchitra Katha 024

                                                                    ডাউনলোড করুন



প্রায় ৫০০ বছর আগের ভারতবর্ষ। একের পর এক ভিনদেশি দখলদার শাসকরা সুবিশাল সৈন্যবাহিনী, অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন অংশ একের পর এক আক্রমণ করে দখল করে নিচ্ছে। এদের মধ্যে আফগান, তুর্কি ও মোঘলরা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে সফলও হয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তার তাদের শাসন পাকাপোক্ত করে ফেলেছে। তখনও অজেয় রাজ্যগুলোকে নিজের পতাকাতলে এনে সমগ্র ভারতবর্ষে একচ্ছত্র শাসন কায়েম করার উদ্দেশ্য নিয়ে কখনও যুদ্ধ, কখনও সন্ধির নাটক চলছে। এরকম পরিস্থিতিতে একটি রাজ্য এই বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তার নাম মেবার।
উত্তর ভারতের রাজস্থানের অন্তর্গত এই মেবার নানা ঐতিহাসিক নাটকীয় ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু। আর মেবারের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক নায়ক ছিলেন বীর যোদ্ধা মহারানা প্রতাপ সিং। মেবারের সিংহ নামে পরিচিত এই মহারানা প্রতাপ মুক্তিসংগ্রাম ও দেশপ্রেমের অপর নাম। মোঘলদের বারবার প্রতিরোধ করে সমগ্র ভারতবর্ষের মুক্তির লক্ষ্যে এক নতুন চেতনার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। এই দুর্দান্ত বীরের ইতিহাস যুগে যুগে যেকোনো স্বাধীনতাকামী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্যে তুখোড় প্রেরণার উৎস।
দুর্দান্ত মহারানা প্রতাপ সিং
১৫৪০ সালের ৯ মে রাজস্থানের কুম্বলগড়ে সিসোড়িয়া রাজপুত বংশে জন্ম নেন প্রতাপ সিং। তার পিতা মহারানা দ্বিতীয় উদয় সিং ছিলেন মেবারের রাজা। তার রাজধানী ছিল চিতোর। আর মা ছিলেন মহারানী জয়ন্ত বাই। উদয় সিং এর পঁচিশ জন পুত্রের মধ্যে সবার বড় ছিলেন প্রতাপ সিং। তাই পিতার উত্তরাধিকার তিনিই মনোনীত হন। তার পিতা বিদেশী আক্রমণকারীদের থেকে রাজ্যকে রক্ষা করতে বরাবর বেশ হিমশিম খেয়ে আসছিলেন। তাই উত্তরাধিকার হিসেবে রাজার মুকুটের সাথে এক বিশাল দায়িত্বের বোঝাও মাথায় নেন মহারানা প্রতাপ সিং।
রাজকীয় গুণাবলিতে কোনো অংশে কম ছিলেন না তিনি। ঘোড়সওয়ারী, অস্ত্রচালনা ও যুদ্ধনীতিতে জীবনের একদম গোড়া থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন প্রতাপ। একই সাথে উদারতা, দুর্বারতা ও নির্ভয়তার এক অনন্য সন্নিবেশ ঘটেছিল তার মধ্যে। রাজসভাসদগণ থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই তার গুণগ্রাহী ছিল। ১৭ বছর বয়সে প্রতাপ বিয়ে করেন বিজোলিয়ার সামন্ত বংশীয় আজাদবে পানওয়ারকে। মহারানী আজাদবের পাশাপাশি তার আরও দশজন রানী ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে ১৭ পুত্র ও ৫ কন্যার জনক ছিলেন প্রতাপ সিং।
চিতোরের সেই সুরক্ষিত দুর্গ
১৫৬৭ সালে সম্রাট আকবর ৬০,০০০ সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে চিতোরের দুর্গ অবরোধ করতে এলে প্রতাপের পুরো পরিবার নগর ছেড়ে গোগুন্ডার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এই দুর্গটির বিশেষত্ব, এটি ৫৯০ ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর অবস্থিত ছিল। এর দেয়ালগুলোও ছিল অনেক চওড়া। পূর্বেও অনেক বিদেশী আক্রমণকারী এই দুর্গ দখল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে আকবরের হাতে এর পতন ঘটে। এই দুর্গে পরপর তিনবার জওহর সংঘটিত হয়। শত্রু সেনাদের হাত থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে এক বিশাল সংখ্যক নারী একত্রিত হয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণ করার প্রথাকে জওহর বলে। রাজপুত নারীদের মধ্যে শেষ পথ হিসেবে এই আত্মহনন বেছে নেয়ার চল ছিল।
চিতোর দুর্গে প্রথম জওহর ঘটে রানী পদ্মাবতীর সময়ে, দ্বিতীয়বার ঘটে রানী কর্নাবতীর সময়, আর তৃতীয়বার ঘটে প্রতাপ সিং এর আমলে চিতোরের পতনের সময়। সেদিন ৬০,০০০ মোঘল সৈন্যের বিপরীতে দুর্গে ছিল মাত্র কয়েক হাজার রাজপুত সেনা, যারা প্রাণপণ যুদ্ধ করেও দুর্গ বাঁচাতে ব্যর্থ হয়। বাধ্য হয়ে সম্ভ্রম বাঁচাতে ৫,০০০ নারী আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন। নিজের চোখে এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে ২৭ বছর বয়সী প্রতাপ সিং তীব্রভাবে মর্মাহত হন। সম্রাট আকবরের সাথে তার পিতা উদয় সিং এর চলমান শত্রুতা তখন থেকেই তার নিজেরও শত্রুতায় পরিণত হয়। দেশকে মোঘল আগ্রাসন থেকে মুক্ত করা তার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
সম্রাট আকবর
উদয় সিং চিতোর ছেড়ে এসে উদয়পুর নামে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। ১৫৭২ সালে উদয় সিং পরপারে পাড়ি জমান। মুকুট পরেন প্রতাপ সিং। পিতার মৃত্যু এবং পিতা যে জীবদ্দশায় আর চিতোর দেখতে পেলেন না, এই গ্লানি তাকে গভীরভাবে পীড়া দিতো। তবে পীড়াগ্রস্ত তিনি একাই ছিলেন না, ছিলেন আরও একজন। স্বয়ং সম্রাট আকবর। আকবর চিতোর দখল করেছিলেন, কিন্তু পুরো মেবারের উপর তার আধিপত্য ছিল না। যতদিন মেবারের জনসাধারণ মহারানা প্রতাপের প্রতি অনুগত ছিল, ততদিন অবধি সমগ্র হিন্দুস্তানের একক জাঁহাপনা হবার শখ তার পরিপূর্ণ করা দুষ্কর ছিল।
আকবর কয়েকবার প্রতাপের কাছে সন্ধির জন্য দূত প্রেরণ করেন। কিন্তু প্রতাপ শুধু এমন চুক্তিতেই আগ্রহী ছিলেন যাতে মেবারের পূর্ণ সার্বভৌমত্ব বজায় থাকে। সন্ধির উদ্দেশ্যে পরপর কয়েকবার প্রতাপ সিং এর কাছে প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন আকবর। সর্বশেষ প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্ব দেন আকবরের বিশ্বস্ত সেনাপতি মান সিং। মান সিং নিজেও রাজপুত ছিলেন। একজন রাজপুত হয়েও রাজপুতদের হেনস্তাকারী আকবরের পক্ষ অবলম্বন করাতে মান সিং এর উপর তীব্র রাগান্বিত হন প্রতাপ সিং। বলা বাহুল্য, এই প্রতিনিধি দলও ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। এই ব্যর্থতা যুদ্ধ আর শান্তির মধ্যে মোটা দাগে একটি রেখা টেনে দেয়। আকবর বুঝতে পারেন সন্ধি নয়, যুদ্ধের পথেই তাকে এগোতে হবে।
এদিকে মহারানা প্রতাপও বুঝে নেন আকবরের পরবর্তী ভাষা হবে অস্ত্রের ভাষা। অনিবার্য যুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরুপ প্রতাপ তার রাজধানী নিজ জন্মস্থান কুম্বলগড়ে সরিয়ে নেন। জনসাধারণকে নির্দেশ দেন সবকিছু নিয়ে আরাবল্লি পর্বতের পেছনে চলে যেতে। তার পরিকল্পনা ছিল যুদ্ধটি আরাবল্লির পাহাড়ি এলাকায় সংঘটিত করার। এ ধরণের ভূমিতে রাজপুতরা লড়াই করে অভ্যস্ত ছিল, কিন্তু মোঘলরা ছিল একেবারেই অনভ্যস্ত। এ সুযোগটাই কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন প্রতাপ। তার একটি বাহিনী সবসময় হলদিঘাটি গিরিপথের উপর নজর রাখতো। উত্তর দিক থেকে উদয়পুর প্রবেশের একমাত্র পথ ছিল এই হলদিঘাটি।
১৫৭৬ সালের ১৮ জুন (কোনো বর্ণনামতে ২১ জুন) সংঘটিত হলো হলদিঘাটির সেই বিখ্যাত যুদ্ধ। আকবর মান সিং এর নেতৃত্বে ৮০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন মহারানা প্রতাপের বিরুদ্ধে। এই বিশাল বাহিনীর বিপক্ষে প্রতাপের দলে ছিল মাত্র ২০,০০০ রাজপুত সেনা। গোয়ালিয়রের রাম শাহ তানওয়ার ও তার তিন ছেলে ছিল ছিলেন প্রতাপের বাহিনীর মূল সেনাপতি। এছাড়া হাকিম খান শূরের নেতৃত্বে আফগান সেনার একটি দল এবং ভিল আদিবাসী গোষ্ঠীর একটি তীরন্দাজ বাহিনী প্রতাপের নেতৃত্বাধীন ছিল।
প্রথম ধাক্কায় মোঘল বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে দেয় রাজপুত সেনা। প্রতাপ সিং ‘লোনা’ ও ‘রাম প্রসাদ’ নামে দু’টি হাতি নামিয়ে দেন যুদ্ধক্ষেত্রে। তীর ও গোলার আঘাত অগ্রাহ্য করে এরা মোঘল বাহিনীকে তছনছ করে এগোতে থাকে। শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে একেকটা ঘোড়াকে তুলে ছুঁড়ে ফেলে এরা মোঘল সৈন্যদের লাশের উপর দিয়ে এগোতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না এদের মাহুত মোঘল সেনাদের হাতে নিহত হয়। মহারানা প্রতাপ প্রবল বিক্রমে শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আকবরের এক সেনাপ্রধানকে তিনি তলোয়ারের আঘাতে চিরে দ্বিখন্ডিত করেন।
এক আঘাতেই দ্বিখন্ডিত আকবরের সেনাপ্রধান
হাতির পিঠে বসে যুদ্ধের সামগ্রিক অবস্থা দেখছিলেন মান সিং। বাম ও ডান উভয় দিকের সৈন্যদের পর্যুদস্ত হতে দেখে মাঝের দলটি নিয়ে এগিয়ে যান তিনি। কিন্তু তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখেই ছুটে আসেন মহারানা প্রতাপ। নিজের ঘোড়া চেতকের মাথায় হাতির মতো একটি কৃত্রিম শুঁড় লাগিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। এই ভয়ানক দর্শন ঘোড়াটি চালিয়ে সরাসরি মান সিং এর হাতির উপরে ঝাঁপ দিয়ে উঠে আক্রমণ করে বসেন তিনি। তার বর্শার আঘাত থেকে অল্পের জন্যে বেঁচে যান মান সিং। পরবর্তীতে চেতক এই যুদ্ধে মারা পড়ে। মহারানা প্রতাপের বাহিনী এই অসম যুদ্ধে পরাজিত হতে বাধ্য হয়।
মান সিং এর উপর মারমুখী মহারানা প্রতাপ
হলদিঘাটের যুদ্ধের পরে আকবর আরও অনেকবার মেবার দখলে নেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হন। এই সময়ের মধ্যে প্রতাপও চিতোর পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাতে থাকেন। কিন্তু মোঘল বাহিনীর লাগাতার প্রহারে তার বাহিনী এক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। পাশাপাশি সেনা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থেরও অভাব পড়ে যায় তার। এমন অবস্থায় ভামা শাহ এগিয়ে আসেন এবং তাকে বিশাল পরিমাণ অর্থ দান করেন। এই অর্থ ১২ বছর ধরে মেবারের ২৫,০০০ সৈন্যের বাহিনীকে চালিয়ে নিয়ে যায়।
১৫৮৭ সালের পরে আকবর উত্তর-পশ্চিম ভারত ও পাঞ্জাবের দিকে তার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেন। মহারানা এই সুযোগে মেবারের বেশিরভাগ এলাকা পুনর্দখল করে নেন। কিন্তু চিতোর তিনি আর হস্তগত করতে পারেননি। অবশ্য জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি হৃত নগর পুনরুদ্ধারের আশাও ত্যাগ করেননি, লড়াই থেকেও পিছু হটেননি।
উদয়পুর মহারানা প্রতাপ মিউজিয়ামে সেই বিখ্যাত দৃশ্যটির ভাস্কর্য
১৫৯৭ সালে এক শিকার অভিযানের সময় দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে আহত হন মহারানা প্রতাপ। এই দুর্ঘটনাই তার মৃত্যুর কারণ হয়। ২৯ জানুয়ারী, ১৫৯৭ মেবারের এই সিংহ, বীর যোদ্ধা, ভারতবর্ষের অন্যতম স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা পরপারে পাড়ি জমান।  তিনি আমৃত্যু শত্রুর বশ্যতা স্বীকার করেননি, স্বাধীনতার জন্যেই তিনি বেঁচেছেন, লড়েছেন, স্বাধীনতার স্বপ্ন দু’চোখে নিয়েই তিনি নিজের জীবনকাল পূর্ণ করে পৃথিবী ছেড়েছেন। একজন মহারানা প্রতাপ মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা আদায়ে বিরামহীন প্রয়াসের মূর্ত প্রতীক। মুক্তিকামী মানুষের চিরন্তন প্রেরণার উৎস হয়েই থাকবেন তিনি।
সংগ্রামী জীবন নিয়ে গৌরবান্বিত একজন মহারানা প্রতাপ  pictur source: mmnewstv.com





8 comments:

  1. Dada expectation bere gache. Roj e bhabi ekta notun ACK pabo.😃😃😃
    Anyway, another excellent comics and again so much information from you.
    Thank you again.

    ReplyDelete
  2. মহারানা প্রতাপকে নিয়ে আপনার লেখাটি মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। অনেক সুন্দর করে ধাপে ধাপে লেখাটি শেষ করেছেন। সাথে প্রয়োজন অনুযায়ী দুর্দান্ত সব ছবি। অসাধারণ! কমিকসের থেকে আপনার ইতিহাস বিষয়ক লেখাই আমার প্রধান আকর্ষণ। ধন্যবাদ দাদা।

    ReplyDelete
  3. Dada onek dhonnobad. Apni amader ke time machine er moto amader anondomoi dinguli firiye anchen. Apnar jonne roilo onek subhechha.

    ReplyDelete