সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত সম্ভাব্য ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন এবং ৩৮০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে তাঁর মৃত্যু হয়। প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সম্রাটের ইতিহাস পুনর্গঠনের বেশ কিছু উপাদান রয়েছে। এগুলাের মধ্যে রাজকবি হরিষেণ রচিত ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’, এরন, নালন্দা ও গয়ালিপি, পাঁচ ধরনের মুদ্রা, চৈনিক বিবরণ, পুরাণ, স্মৃতিশাস্ত্র, ‘কৌমুদী মহােৎসব’ নামক একটি নাটিকা, কালিদাসের ‘রঘুবংশম’ ইত্যাদি বিখ্যাত। এ সকল উপাদানের মধ্যে ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে ঐতিহাসিক মহলে সমাদৃত। এলাহাবাদের দুর্গে রক্ষিত এই প্রশস্তিখানি সম্ভবত সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পরই উত্তীর্ণ করা হয়েছিল। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, সমুদ্রগুপ্তের দক্ষিণ ভারত বিজয়ের পর এটি রচিত হয়। প্রশঙুিটি আংশিক পদ্যে, আংশিক গদ্যে রচিত। হরিষেণ যেহেতু সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি সেহেতু তাঁর বর্ণিত দিগ্বিজয় কাহিনীতে কিছু অতিশয়ােক্তি থাকতে পারে। অলংকৃত সংস্কৃতে রচিত এই লিপিটির ছত্রে ছত্রে সমুদ্রগুপ্তের ‘সাম্রাজ্যবাদী দম্ভ’ ছড়িয়ে আছে বলে ড. কোশাম্বী মত ব্যক্ত করেন। তবে এই রাজপ্রশস্তিটি সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের শিক্ষা, বিদ্যোৎসাহিতা, রাজ্য জয় ও রাজ্যশাসন এবং ব্যক্তিগত প্রতিভা সম্পর্কে বিশদ তথ্য প্রদান করে।
সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য বিস্তার
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে রাজ্য বিজেতারূপে যে সকল সম্রাট খ্যাতি লাভ করেছেন, সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে স্থান পেয়েছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত গাঙ্গেয় উপত্যকার স্থানীয় একটি রাজ্যকে তিনি সর্বভারতীয় এক সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। প্রাচীন ভারতের তৃতীয় সাম্রাজ্যবাদী পুরুষ হিসাবে সমুদ্রগুপ্ত বিখ্যাত। বস্তুত চন্দ্রগুপ্ত মউরজ এবং কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের পর এতাে বড় বিজয়ী বীর ভারতের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি দেখা যায় না।
সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয় সম্পর্কে হরিষেণ রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তিতে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। প্রশস্তি অনুসারে সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত উত্তর ভারতের নয় জন রাজাকে পরাজিত করেন। এঁরা হলেন অচ্যুত, নাগসেন, রুদ্রদেব, মতিল, নাগদত্ত, চন্দ্রবর্মণ, গণপতিনাগ, নন্দী ও বলবর্মণ। এঁদের মধ্যে গণপতিনাগ (মথুরার নাগবংশের রাজা), নাগসেন (পদ্মাবতী বা গােয়ালিয়র অঞ্চলের রাজা), অচ্যুত (অহিচ্ছত্র বা উত্তর প্রদেশের রামনগর ও রায়বেরিলি’র রাজা) এবং চন্দ্রবর্মণের (পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়া অঞ্চলের রাজা) পরিচয় জানা যায়। বাকি পাঁচ জনের সঠিক সনাক্তকরণ এখনও সম্ভব হয়নি। যাহােক, উত্তর ভারত বা আর্যাবর্ত জয়ের ক্ষেত্রে সমুদ্রগুপ্ত কৌটিল্য ও ম্যাকিয়াভেলীর নীতি পূর্ণমাত্রায় অনুসরণ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, যিনি অধিকতর ক্ষমতাশালী তিনি যুদ্ধ করবেন। যার প্রয়ােজনীয় অস্ত্র-শস্ত্র ও অর্থ থাকবে তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করবেন। আর্যাবর্তের রাজাগণের প্রতি তাঁর যুদ্ধনীতি ছিল সম্পূর্ণ উচ্ছেদের। উল্লিখিত ৯ জন রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত তাদের রাজ্য নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত কেবল আর্যাবর্তের রাজগণের উচ্ছেদ সাধন করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি মধ্যভারতের আটবিক রাজ্য অর্থাৎ অরণ্য রাজ্যগুলােও পদানত করেছিলেন। এ সকল অরণ্য রাজ্য বা আটবিক রাজ্য গাজীপুর, জব্বলপুর প্রভৃতি অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। এরণ লিপিতে এ সংক্রান্ত তথ্য লিপিবদ্ধ আছে।
আটবিক রাজ্যজয়ের পর সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারত জয় করেন। এ সংক্রান্ত তথ্য এলাহাবাদ প্রশস্তিতে উৎকীর্ণ করা হয়েছে। সমুদ্রগুপ্ত দাক্ষিণাত্যে রাজ্য জয় করলেও রাজ্যগুলােকে অধিগ্রহণ করে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেননি। রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি এবং প্রশাসনিক সুবিধা-অসুবিধার বিচারে সমুদ্রগুপ্ত দাক্ষিণাত্যে অনেকটা ধর্ম বিজয়ী’র ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি পরাজিত রাজাদের আনুগত্য আদায় করে রাজ্যগুলাে ফিরিয়ে দেন অথবা করদ রাজ্যে পরিণত করেন। সভাকবি হরিষেণ বলেন, সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত ‘গ্রহণ-পরিমােক্ষ নীতি’ নেন। এ নীতির অর্থ হলাে- প্রথমে গ্রহণ অর্থাৎ শত্রুকে শক্তির জোরে বন্দি করা এবং তাঁর বশ্যতা আদায়ের পর মােক্ষ দান বা মুক্তি দেয়া। পরাজিত রাজা রাজ্য ফিরে পেতেন কিন্তু সার্বভৌমত্ব পেতেন না। যাহােক, সমুদ্রগুপ্তের অভিযান সাধারণত: মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণ ও পূর্বভাগ, উড়িষ্যা এবং দাক্ষিণাত্যের পূর্ব উপকূলের কাঞ্চী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। এই ভূ-ভাগের বারাে জন রাজা ও রাজ্যের নাম এলাহাবাদ প্রশস্তি সূত্রে জানা যায় যাদের ওপর ‘গ্রহণ পরিমােক্ষ নীতি’ প্রয়ােগ করা হয়েছিল। এঁরা হলেন কোশলের (দক্ষিণ কোশল বা বিলাস ও মধ্যপ্রদেশের রায়পুর জেলা এবং উড়িষ্যার সম্বলপুর জেলা) মহেন্দ্র, মহাকান্তারের (মধ্য ভারতের বনাঞ্চল) ব্যাঘ্ররাজ, কৌরলের (মধ্যপ্রদেশের শােনপুর জেলা) মন্তরাজ, কোতুরের (গঞ্জাম জেলার কোটুর) স্বামীদত্ত, পিষ্ঠপুরমের (অন্ধ্রের গােদাবরী জেলা) মহেন্দ্রগিরি, ইরন্দপল্লের (ভিজাগাপট্টম জেলা) দামন, কাঞ্চির (তামিলনাড়ুর কাঞ্চিভরম জেলা) বিষ্ণুগােপ, বেঙ্গীর (কৃষ্ণা গােদাবরী জেলার ইলাের) হস্তিবর্মণ, অবমুক্তার (কাঞ্চির নিকটবর্তী স্থান) বা আরামকুটের নীলরাজ, পল্লাকের (নেল্লোর জেলা) উগ্রসেন, দেবরাষ্ট্রের (সম্ভবত: ভিজাগাপট্টম) কুবের এবং কুস্থলপুরের (উত্তর আর্কট জেলা) ধনঞ্জয়।
সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের দ্বিমুখী নীতির (সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের অন্তর্ভুক্ত করা কিংবা সামন্তরাজ্য হিসাবে চলতে দেয়া) ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সীমান্তের বেশ কয়েকজন রাজা বা গােষ্ঠীপতি সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এদের মধ্যে সমতট (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা), ডবাক (আসামের নওগাঁ জেলা বা বাংলারর ঢাকা জেলা), কামরূপ (উত্তর আসাম), নেপাল ও কর্তৃপুরের (সনাক্তকরণ বিতর্কিত) নাম উল্লেখযােগ্য। অন্যদিকে উত্তরপশ্চিম ভারতে পশ্চিম ভারতের শক রাজগণ, পশ্চিম পাঞ্জাব ও আফগানিস্থানের কুষাণ রাজগণও সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের প্রাধান্য স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এছাড়া পূর্ব রাজপুতানা ও মান্দাসর এলাকার ‘মালব’, রাজস্থানের জয়পুর ও আলােয়ারের ‘অর্জুনায়ন’, পাকিস্তানের ভাওয়ালপুর রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত শতদ্রু নদীর উভয় তীরের বাসিন্দা ‘যৌধেয়’, মধ্যপ্রদেশের সাঁচী এলাকার আবীর’, ‘খরপরীক’, ভিলসার ‘কাক’ জাতি সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের প্রভুত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
প্রশস্তি অনুযায়ী সমুদ্রগুপ্ত কনৌজ বা পুপুর হতে সমস্ত অভিযান পরিচালনা করেন। আর্যাবর্তের সকল রাজাকে পরাজিত করে তিনি ‘সর্বরাজোচ্ছেত্তা’ উপাধি গ্রহণ করেন। হরিষেণের মতে, পরাজিত রাজন্যবর্গ ‘কর প্রদান করে, আদেশ পালন করে ও বশ্যতা জ্ঞাপন করে সমুদ্রগুপ্তের সম্রাটোচিত নির্দেশ পালন করেছিল।’ সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য ছিল প্রভুত্ব ও স্বায়ত্তশাসনের এক অপূর্ব সমন্বয়। দিগ্বিজয় সম্পন্ন করে তিনি ‘অশ্বমেধযজ্ঞ’ অনুষ্ঠান করেন এবং এই যজ্ঞের স্মৃতিরক্ষায় স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করেন।
সাম্রাজ্যসীমা
সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যবিস্তার নীতি ও যুদ্ধ বিগ্রহের আলােচনা থেকে তাঁর সাম্রাজ্যসীমা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। উত্তর প্রদেশ, বিহার, বাংলা ও মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশ নিয়ে তিনি প্রত্যক্ষ শাসন স্থাপন করেন। তার বাইরে সামন্তরাজ্যের পরিমন্ডল তিনি স্থাপন করেন। পূর্ব ভারতে সমতট, ডবাক, নেপাল ; পশ্চিমে মালব, উত্তর-পশ্চিমে খরপরিকগণ এই পরিমন্ডল রচনা করে। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার প্রত্যক্ষ ও করদ রাজ্য মিলিয়ে সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যসীমা ধরেছেন- কাশ্মির, পশ্চিম পাঞ্জাব, পশ্চিম রাজপুতানা, সিন্ধু, গুজরাট ব্যতিত সমগ্র উত্তর ভারত; দক্ষিণে উড়িষ্যার ছত্তিসগড় হয়ে পূর্ব উপকূল ধরে তামিলনাড়ুর চিঙ্গেলকোট জেলা পর্যন্ত। এছাড়া সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যসীমার বাইরে প্রতিবেশীরাও তাঁর পরাক্রম অনুভব করে দ্রুত তাঁর সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। অর্থাৎ সাম্রাজ্যের বাইরেও তাঁর ‘প্রভাব বলয়’ বিস্তৃত ছিল।
রাজ্য জয়ের প্রকৃতি
সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত এই নীতি নিয়ে কখনােই ইতড়ত করেননি, রাজ্য অধিগ্রহণ করাই হলাে রাজার প্রধান কর্তব্য কাজ। তিনি ছিলেন প্রচন্ড সাম্রাজ্যবাদী। ড. স্মিথ সম্ভবত এ কারণেই সমুদ্রগুপ্তকে “ভারতীয় নেপােলিয়ন” আখ্যা দিয়েছেন। ভারতের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত ভারতভূমিকে এক শাসনে আবদ্ধ করাই ছিল সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের লক্ষ। অনেকে সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয়ের মধ্যে ব্রাহ্মণ্যধর্মের সাম্রাজ্যবাদ লক্ষ করেছেন। অধ্যাপক রােমিলা থাপারের মতে, সমুদ্রগুপ্ত সারা ভারতে ব্রাহ্মণ্যসভ্যতার ধ্বজা উড়িয়ে দেন। অনেকে আবার সমুদ্রগুপ্তকে ‘ধর্মবিজয়ী’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। গ্রহণ-পরিমােক্ষ’ নীতির ভিত্তিতে তাঁরা বলেন, সমুদ্রগুপ্তকে সাম্রাজ্যবাদী বা আগ্রাসী বলা যুক্তিযুক্ত নয়। ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন অর্থাৎ অখন্ড ভারত সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল সমুদ্রগুপ্তের প্রধান চালিকাশক্তি। অবশ্য অনেকে সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যবাদী নীতির পেছনে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য লক্ষ করেছেন। দক্ষিণের অপরিমিত সম্পদ সংগ্রহ, গঙ্গাযমুনা উপত্যকার কৃষি সম্পদ হস্তগত করা ইত্যাদি কারণেই সমুদ্রগুপ্ত যুদ্ধ বিগ্রহ করেছেন। যাহােক, একথা বলা প্রয়ােজন যে, গুপ্ত সাম্রাজ্য একটি বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে উদ্ভূত হয়েছিল। কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের রাজনীতিতে যে শক্তিশূন্যতা দেখা দেয় গুপ্ত সাম্রাজ্য তা দূর করে।
সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব
এলাহাবাদের শিলালিপি অনুযায়ী সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি গান গাইতে ও বীণা বাজাতে পারতেন। কতিপয় স্বর্ণমুদ্রায় তাঁকে বীণাবাদক রূপে পালঙ্কে উপবিষ্ট দেখা যায়। কবিতা রচনাতেও তার যথেষ্ট পারদর্শিতা ছিল। কবিরাজ’ উপাধি দেখে মনে হয় সম্ভবত তিনি প্রথম শ্রেণীর অজস্র কবিতা লিখেছিলেন। কিন্তু কালের কবলে পড়ে তা বিলীন হয়ে গেছে। অশােকের ন্যায় সমুদ্রগুপ্ত পরাক্রমের সাহায্যে দিগ্বিজয়ের পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু উভয়ের পরাক্রম ও দিগ্বিজয়ের মধ্যে ছিল আকাশ-পাতাল তফাৎ। একজনের অস্ত্র হলাে ন্যায়, ধর্ম ও পরােপকারিতা এবং অপরজনের অস্ত্র, সামরিক শক্তি ও বুদ্ধি । অশােক আধ্যাত্মিক শক্তিতে শক্তিমান; আর সমুদ্রগুপ্ত বাহুবলে বলীয়ান। অশােকের ব্যক্তিত্বকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। আবার সমুদ্রগুপ্তের প্রাধান্য স্বীকার না করার উপায় নেই। সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত কেবল দিগ্বিজয়ী যােদ্ধাই ছিলেন না, ছিলেন একজন সুদক্ষ শাসকও। দক্ষিণ ভারতে তাঁর মিত্ৰতামূলক নীতি তাঁর। কূটনৈতিক জ্ঞানেরই পরিচয় দেয়। সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত তাঁর সামরিক প্রতিভা এবং কূটনৈতিক শক্তিতে ভারতব্যাপী রাজনীতিক একতার সূত্রপাত ঘটান। অশােকের ধর্ম-বিজয় অপেক্ষা তা কম গৌরবের নয়। অশােকের ধর্মনীতি, কর্মনীতি ও বাস্তব বুদ্ধির ন্যায় সমুদ্রগুপ্তের উদারতা, বিদ্যোৎসাহিতা, পরমত সহিষ্ণুতা ও রাজনীতিক দূরদর্শিতা প্রশংসনীয়। কথিত আছে, বিখ্যাত বৌদ্ধ পন্ডিত বসুবন্ধু তাঁর মন্ত্রী এবং হরিষেণ তাঁর সভাকবি ছিলেন। তিনি নিজে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপােষক হয়েও বৌদ্ধ, জৈন বা অন্য কোন ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ছিলেন না। হরিষেণের প্রশস্তিতে, সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত সম্পর্কে অত্যুক্তি থাকলেও তাঁর কৃতিত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না। সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন সাধুব্যক্তিদের আশাস্বরূপ, আর অসাধুদের জন্য প্রলয়। হরিষেণ সমুদ্রগুপ্তকে মানুষের আকৃতিতে দেবতা তুল্য ‘অচিন্ত্যপুরুষ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
প্রাচীন ভারতের সাম্রাজ্যকেন্দ্রিক ইতিহাসের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত হচ্ছেন প্রধান ব্যক্তিত্ব। তার দিগ্বিজয়ের কাহিনী প্রাচীন ইতিহাসের অন্যতম আলােচ্য বিষয়। সভাকবি হরিষেণের প্রশস্তি থেকে এই দিগ্বিজয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। তবে এ বিবরণে কিছুটা অতিশয়ােক্তি থাকতে পারে। তা সত্তেও অন্যান্য উপকরণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় আর্যাবর্তের বিশাল এক অঞ্চলে সমুদ্রগুপ্তের প্রত্যক্ষ শাসন এবং এর সংলগ্ন এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল পরােক্ষ শাসনাধীন ছিল। তিনি বিজয়সূচক ‘সর্বরাজোচ্ছেত্তা’ উপাধি ধারণ করেন। তাঁর সামরিক কৃতিত্বের সূত্র ধরেই তাকে ‘ভারতীয় নেপােলিয়ন বলা হয়েছে। লিচ্ছবি দৌহিত্র সম্রাট সমুদ্রগুপ্তকে ‘অচিন্ত্যপুরুষ’ও বলা হয়। কেবল দিগ্বিজয়ী যােদ্ধাই নয় তিনি একাধারে সুদক্ষ শাসক এবং কবিতা ও সঙ্গীত রসিক ব্যক্তিত্ব হিসাবেও পরিচিত। বহুমুখী প্রতিভাবান এই সম্রাটই কার্যকরভাবে ভারতকে এক সুতাের মালায় গাঁথবার চেষ্টা করে কিছুটা সাফল্য অর্জন করেন।
No comments:
Post a Comment